ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

এই চুরি ব্যাংক ডাকাতির চেয়েও বড়

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১৯ মার্চ ২০১৬

এই চুরি ব্যাংক ডাকাতির চেয়েও বড়

মাত্র দু’দিন আগে ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭তম জন্মদিন আমরা উদ্যাপন করলাম। যতদিন এই বাংলা, বাঙালী জাতি থাকবে, বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়বে, ততদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালিত হবে। পালিত না বলে উদ্যাপিত বলাই শ্রেয়। কেননা, তাঁর জন্ম একটি জাতির জন্ম, তাঁর জন্ম একটি জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। মানুষ স্বপ্ন দেখে-কেউ স্বপ্ন দেখে একটি বাড়ি বানাবার; কেউ স্বপ্ন দেখে কত দামী একটি গাড়ি কিনবে; কেউ স্বপ্ন দেখে তার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট কত মোটা করতে হবে; কেউ স্বপ্ন দেখে কয়টা ইন্ডাস্ট্রি করা যাবে; কিন্তু একজন মানুষ যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান; তিনি স্বপ্ন দেখেছেন মাত্র একটি এবং তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা বাঙালীর আপন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। কেন তিনি এ স্বপ্নটি দেখেছেন? দেখেছেন বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। যে কারণে এই ‘গরিব-দুঃখী’ শব্দ দুটি বারবার তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। বস্তুত মানুষটিই ছিলেন একেবারে আলাদা, তুলনাহীন। যেমন দীর্ঘদেহী (তবে অশোভন নয়), তেমনি সৌম্যকান্তি- এমন সুপুরুষ তো বাঙালী জাতির মধ্যে দেখলাম না। এত বড় মাপের মানুষ ছিলেন বলেই এত বড় স্বপ্ন (এর চেয়ে বড় স্বপ্ন আর কী আছে?) দেখেছেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শৌর্যে-বীর্যে, সাহসিকতায় দূরদর্শিতায় সবার ওপরে উঠতে পেরেছেন। জেল-জুলুম-হুলিয়া, ফাঁসির মঞ্চ তার কাছে তুচ্ছ ছিল। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ঘাতকরা তাঁকে কেড়ে নিল। বঙ্গবন্ধুর মতো কন্যা শেখ হাসিনাও ছোটখাটো স্বপ্ন দেখেন না। পিতা স্বপ্ন দেখেছেন সোনার বাংলার আর কন্যার স্বপ্ন পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন। অর্থাৎ সোনার বাংলা গড়ার মাধ্যমে গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে প্রথম ৬ বছর বিদেশে ও পরের ৩৫ বছর দেশে কখনও দলীয় সভাপতি, কখনও প্রধানমন্ত্রী, কখনও বিরোধীদলীয় নেতা, সর্বোপরি জননেত্রী হিসেবে দিনরাত পিতার মতোই মেধা, মনন ও সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। জেলে গেছেন, ১৯ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি আজও জাতির সেবা করে চলেছেন। বাংলাদেশকে আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যে কারণে খালেদা-তারেকের নেতৃত্বাধীন ষড়যন্ত্রকারীরা যেমন তৎপর, তেমনি তাদের বিদেশী প্রভুরাও সক্রিয়। তাবত দুনিয়া এখন অবাক-বিস্ময়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করছে। কিন্তু অতীতে যেমন জলদস্যু, বর্গি, ব্রিটিশ বেনিয়া, মোগল শাসন, পাকি সামরিক জান্তা বাংলাকে লুণ্ঠন করেছে। আজ লুণ্ঠন করতে পারছে না তাই চুরি করা শুরু করেছে। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলার অর্থ, সোনা রাখার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুক থেকে হ্যাক করে ৮০০ কোটি টাকা চুরি করে নিয়ে গেল দেশের বাইরে ম্যানিলায়। অন্য কোন দেশেও হতে পারে। কয়েক দিন আগে দেখা গেল ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকরা, মানে কতিপয় বিদেশী নাগরিক বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে কার্ড জালিয়াতি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেÑ যে ছবি সিসি টিভির ফুটেজ থেকে টেলিভিশনে জাতি দেখেছে। কী হচ্ছে এসব? কে দায়ী? আমাদের অর্থমন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দায়িত্ব এড়াতে পারে না, বাংলাদেশ ব্যাংকের লোক জড়িত। আবার আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাম-লীর সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, অর্থমন্ত্রী তার দায় এড়াতে পারেন না। কে দায়ী, কে দায় এড়াতে পারেন, কে এড়াতে পারেন নাÑ আমজনতার তাতে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। আমজনতার যেটি ঘামাবার তা হলো তার গচ্ছিত টাকা পোকায় খেয়ে ফেলছে। অথচ এখানে ফরমালিন-ডিডিটি কোন কিছুই কাজ করছে না। অনেক লেখায় আমি বলে আসছিলাম আমরা যারা ক্ষমতায় আছি, ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খাচ্ছি, হালুয়া-রুটির সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক থাকাটাও দরকার। বলেছি, এখনও খন্দকার মোশতাক, মিলিটারি জিয়া, সাংবাদিক তাহের ঠাকুররা চারদিকে সক্রিয়। তারা তাদের কাজগুলো করে যাচ্ছে আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারীরা একটার পর একটা সংগঠন গড়ে তুলছে, একটা-দুটো আলোচনা সভা কিংবা মানববন্ধন করে কয়েক মাসের সংসার খরচ পকেটে পুরে ঘরে বসে যাচ্ছে, যার সুযোগ নিচ্ছে বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলো। কয়েক দিন আগে শুনলাম বিএনপির যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘রুই-কাতলারা’ জড়িত। তারপর এলো বিএনপির সংস্কারপন্থী মিলিটারি মেজর হাফিজ, তিনিও একই কথা বললেনÑ অর্থ চুরির সঙ্গে ‘আওয়ামী লীগ নেতারা জড়িত?’ কে দেবে এসব কথার জবাব? বরং ক্ষমতাসীনদের একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন? বস্তুত যা যা করা দরকার তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান কাজ হবে বিএনপির ওই দুই নেতা মেজর হাফিজ ও রিজভীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা। কারা (তাদের ভাষায়) ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার ‘রুই-কাতলা’? বলছি না রিমান্ডে নিন, কারণ তারা জাতীয় নেতা। সম্মানের সঙ্গেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। যেভাবেই হোক তাদের কাছ থেকে নামগুলো জেনে নেয়া দরকার। জিজ্ঞাসাবাদ না করলে চুরি যাওয়া অর্থের মালিক জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করবে নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীনদের কেউ না কেউ জড়িত? নইলে সরকার রি-এ্যাক্ট করছে না কেন? অবশ্য এটাও ঠিক যে মুহূর্তে কাউকে আটক করা হবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলে বসবেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের আটক করা হয়েছে। কারণ তাদের ভাষায় রাজনীতিকরা সব ধোয়া তুলসিপাতা, তাতে কোন ময়লা নেই, এমনকি দুর্নীতির মামলায় আসামি তারেক রহমানও। কিন্তু তারপরও সরকারতো বসে থাকতে পারেন না। সরকারকে রি-এ্যাক্ট করতেই হবে, নইলে বিভ্রান্তিু সৃষ্টি হবে। বস্তুত দ্রুত কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছেÑ হলমার্ক কেলেঙ্কারি হলো, তাও ব্যাংকের ব্যাপার। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি হলো, ডেসটিনির কেলেঙ্কারি হলো, তারপর কী হলো আমজনতা কিছুই জানেন না। এর আগে ২০১০ সালের শেষের দিক থেকে শেয়ারমার্কেটে ধস নামল। কয়েক লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হলো। বিএনপি তখনও বলল, এর সঙ্গে ক্ষমতাসীনরা জড়িত(?) এমনকি খোদ খালেদা জিয়াও সম্ভবত বলেছিলেন ক্ষমতাসীনরা শেয়ারমার্কেট থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে গেছে। অবশ্য এটা ঠিক তিনি কথাটি বলেছেন আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলার জন্য? সেদিন আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী ‘রাবিশ’Ñ এসব বলে প্রথমদিকে উড়িয়ে দিলেও পরবর্তীতে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে দিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করেন। খন্দকার সাহেব তদন্ত করে কী পেলেন (অবশ্য তখন কয়েকজনের নাম শোনা গেছে), কী ব্যবস্থা নেয়া হলো, জাতি জানে না। হয় খন্দকার খালেদের চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিচার করা দরকার, নয়তো বেগম খালেদা জিয়ার অভিযোগ সত্যি হয়ে যাবে। আর যদি চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিচার না করা হয়, তবে ধরে নেয়া যাবে খন্দকার খালেদ সঠিক তদন্ত করেননি, সঠিক তদন্ত রিপোর্ট পেশ করেননি। সেক্ষেত্রে খন্দকার খালেদেরই বিচার করা উচিত। আমরা জানতাম একটি তদন্ত কমিটি করা হলে কমিটি তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট নিয়োগকর্তার কাছে জমা দেবেন। নিয়োগকর্তা রিপোর্টটি প্রকাশ করার সময় তদন্ত কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ করবেন। তার আগে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তকালীন প্রতিদিন সকাল-বিকাল প্রেসকে ইন্টারভিউ দেয়া নৈতিকতার দিক থেকে কতখানি সঠিক সেটি ভেবে দেখা দরকার। কেননা খালেদ সাহেব নিয়োগপ্রাপ্তির পর থেকে প্রতিনিয়ত এ কাজটি করেছেন। তিনি জানেন বলেই বিশ্বাস করি যে, শেয়ারমার্কেটে যে কোন গুজব, আগাম ধারণা ইত্যাদি মার্কেটকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে, ক্ষতিগ্রস্তও করে। কয়েক লাখ (৫-৬ লাখ হবে) বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। আর যারা তাদের পুঁজি উদরস্ত করেছে তারাও আর শেয়ারমার্কেটে ফিরে আসেনি। ফলে মার্কেটটি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা : ১৮ মার্চ ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×