ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

কারারাষ্ট্র উঃ কোরিয়া থেকে লোক পালাচ্ছে চীনে

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ১৬ মার্চ ২০১৬

কারারাষ্ট্র উঃ কোরিয়া থেকে লোক পালাচ্ছে চীনে

দীর্ঘ শীতার্ত মাসগুলোতে চীন-উত্তর কোরিয়া সীমান্তে ইখালু নদীর দুই তীরে দুই দৃশ্য দেখা যাবে। চীনের ড্যানডং নগরীর দিকে তাকালে চোখে পড়বে নিয়ন আলোর ঝলমলে চোখ ধাঁধানো দৃশ্য। ভেসে আসবে ডিসকো ক্লাবের বাদ্যের আওয়াজ। দেহ পসারিণীরা শিকারের খোঁজে বেরোবে। তাদের পদযুগল থকবে নগ্ন। নদীর অপর তীরটিতে ঠিক তার বিপরীত দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। সেখানে বর্ণিল আলোর খেলা নেই। সবকিছুই ধূসর। শুষ্ক, প্রাণহীন পাহাড়ের সারি। ট্রাকের সগর্জনে ছুটে চলার দৃশ্য। গুটি কয়েক কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া নির্গত হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাতের বেলা উত্তর কোরিয়া একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যায়। বিদ্যুত বাঁচাতে হবে যে! এক সময় চীন ও উত্তর কোরিয়া পরস্পরের অতি অন্তরঙ্গ ছিল। কোরিয়া যুদ্ধে চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষ নিয়ে লড়েছিল। সেই যুদ্ধে চেয়ারম্যান মাওয়ের ছেলে মৃত্যুবরণ করেছিল। কিন্তু চীন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তদ্বার নীতি গ্রহণ করলেও উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক নীতি আঁকড়ে থাকে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারী শাসন। বর্তমানে সেই শাসন ৩৩ বছর বয়স্ক একনায়ক কিম জং উনের। কিম পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন, মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছেন, অর্থনৈতিক সংস্কারকদের ফাঁসিতে ঝুঁলিয়েছেন এবং তার দেশের একমাত্র পৃষ্ঠপোষক চীনের ব্যাপারে নাক গলিয়েছেন। এসব কারণে হোক আর অন্য কারণে হোক উত্তর কোরিয়ার প্রতি চীনের উত্তরোত্তর অসহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। সেটা এমন পর্যায়ে গেছে যে গত মাসে চীন পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে ব্যতিক্রমী ধরনের কঠোর অবরোধ আরোপের প্রস্তাবে সমর্থন দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ পর্যন্ত দিয়েছে। বলাবাহুল্য সেই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হলো পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচী পরিত্যাগে পিয়ংইয়ংকে রাজি করানো। কিন্তু তারপরও চীনের পক্ষে বেশি কঠোর হওয়া বা অধিকতর চাপ দেয়া সম্ভব নয়। কেন? তার কারণ উত্তর কোরিয়া যদি ধসে বা ভেঙ্গে পড়ে তাহলে চীনের সীমান্ত এলাকায় উত্তর কোরীয় উদ্বাস্তুর ঢল নামবে। সেই ঢল রীতিমত প্লাবনের রূপ ধারণ করবে। সেটা নিশ্চয়ই চীনের কাম্য নয়। কারণ ওতে করে চীনে মারাত্মক আর্থ-সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে। উত্তর কোরিয়া আজ এক কারারাষ্ট্রের মতো। দেশটির সঙ্গে চীনের সীমান্ত বসেছে ১৪২০ কিলোমিটার। তবে সেই সীমান্ত নিñিদ্র নয় বরং রন্ধ্রময়। এই সীমান্ত বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে কৌতূহলী সাংবাদিক এবং উৎসাহী ট্যুরিস্টসহ পাঁচমিশালী লোকজনকে আকৃষ্ট করে চীনে আসার জন্য। ধর্ম প্রচারের বিরুদ্ধে চীনে কঠোর বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও এই সীমান্ত দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার ধর্ম প্রচারকরা এসে ধর্ম প্রচার করে থাকে। তবে চীনের ড্যানডং এলাকাটি হলো ওই অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশপথ এবং সেটা প্রধানত: অননুমোদিত পণ্য সামগ্রীর। তবে এখনও এই বাণিজ্যিক প্রবেশপথটা তেমন জমে উঠেনি। যদিও নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আকাশচুম্বী ভবনের প্রসার ঘটেছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কিমের সংস্কারপন্থী চাচা জ্যাং সুং তায়েকের ফাঁসি হয়ে যাবার পর থেকে দু’দেশের ব্যবসায়ীরা বেশ বেকায়দা রয়েছে। সোজা কথায় দু’দেশের ব্যবসার অবস্থা তেমন ভাল নয়। এই পরিস্থিতিতে সীমান্তের উভয় দিকে অপরাধ বেড়ে গেছে। উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতে খারাপ। সেটা আরও বেড়েছে দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা বাণিজ্যের কার্যত অনুপস্থিতির কারণে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত চীনা নাগরিকদের একাংশ আবার জাতিগতভাবে কোরীয়। এরা প্রায়শই আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করে। আতঙ্কের একটা কারণ উত্তর কোরিয়ার কোন সৈন্য পক্ষত্যাগ করে সীমান্তের এ পাড়ে এসে গুলি মেরে লোকজনের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সম্পদ লুটে নিতে পারে। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। এদিকে দুই দেশের সীমান্ত নদী ইয়ালু ও তুমেন পাড়ি দিয়ে উত্তর কোরীয় নাগরিকদের পালিয়ে চীনে আগমন অব্যাহত রয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে যে চীনারা যদি ওদের ধরে ফেলে স্বদেশে ফেরত পাঠায় তাহলে ওদের স্থান হবে সোজা শ্রমশিবির। কিন্তু কোন হুমকিতেই কাজ হয় না। উত্তর কোরীয় মেয়েরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসতে পারলে চীনের হোটেলে ওয়েস্ট্রেস হিসেবে কাজ করতে পারে কিংবা কোরীয় বংশোদ্ভূত পুরুষদের বিয়ে করে থেকে যেতে পারে। এভাবে তারা স্বদেশের দারিদ্র্যর কশাঘাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। আর যারা পালিয়ে আসতে পারে না তারা স্বদেশের কলকারখানায় খাটতে বাধ্য হয় যা তাদের কাছে কারাগারের মতো। মহিলাদের অনেকে বাইরে পাচার হয়ে দেহব্যবসায়ে নামতে বাধ্য হয়। ওদিকে অবস্থাপন্ন ও সুবিধাভোগী উত্তর কোরীয়রা ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠায় চীনের ব্যয়বহুল প্রাইভেট স্কুলে। এই এলিট শ্রেণী বিত্তশালী হয়েছে চীন থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে চোরাপথে পাচার হওয়া ইলেক্ট্রনিক্স, গৃহস্থালী সরঞ্জাম ও স্ন্যাকের গোপন ব্যবসায়ের মাধ্যমে। সূত্র : টাইম
×