ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

আশার আলো ॥ রূপকথা নয়, ইতিহাস তামিমের

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৬ মার্চ ২০১৬

আশার আলো ॥ রূপকথা নয়, ইতিহাস তামিমের

সফল হওয়ার জন্য শুধু সামর্থ্য, যোগ্যতা থাকলেই চলে না, এর সঙ্গে খুব জরুরী আত্মবিশ্বাসটাও। সেই আত্মবিশ্বাস, ভাল কিছু করার জিদ এবং প্রচেষ্টার বিন্দুমাত্র কমতি নেই তামিম ইকবালের মধ্যে। কারণ, এবার টি২০ বিশ্বকাপ খেলতে ভারতের ধর্মশালা পৌঁছার পর দলের কোচ চান্দিকা হাতুরাসিংহেকে তিনি বলেছিলেন, ‘এই বিশ্বকাপে আমি আপনাকে একটি সেঞ্চুরি উপহার দেব।’ এখানেই শেষ নয়, এর আগেও একই কথা বলেছিলেন দলের অনুশীলনে। টি২০ ক্রিকেটেই শুধু সেঞ্চুরি নেই কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের। সেটা নিয়েই কথা হচ্ছিল এক সময়, ‘কে টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করবে? সে সময়ও তামিম বলেছিলেন, ‘আমিই করব।’ ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। কোন রূপকথার গালগল্পটাও করেননি। এবার সেটাকে সত্যি করে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস হয়ে গেছেন তিনি। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টি২০ ক্রিকেটে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। টি২০ বিশ্বকাপের প্রাথমিক রাউন্ডের শেষ ম্যাচে তামিম খেলেন ৬৩ বলে ১০ চার ও ৫ ছক্কায় ১০৩ রানের বিস্ফোরক একটি হার না মানা ইনিংস। কথা এবং কাজের ব্যবধান যেমন থাকল না, তেমনি সময়টাও বেশি নিলেন না ঘোষণাকে সত্য করার ক্ষেত্রে। একই দিনে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টি২০ ক্রিকেটে এক হাজার রান করা প্রথম বাংলাদেশী হয়ে আরেকটি ইতিহাস গড়েছেন তিনি। টি২০ ক্রিকেটের ইতিহাসে সবেমাত্র ২৫তম ব্যাটসম্যান তামিম এই কীর্তি গড়ার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের পক্ষে একাধারে ওয়ানডে, টেস্ট ও টি২০ ক্রিকেটে তিনিই সর্বাধিক রানের মালিক। এমনকি সর্বাধিক সেঞ্চুরি ওয়ানডে ও টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে। রূপকথার গল্প নয়, ইতিহাস লিখে যাচ্ছেন তামিম। সর্বশেষটি লিখলেন ধর্মশালায়। তিন ফরমেটেই সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানের সংখ্যা এতদিন ছিল ১০ জন মাত্র। কালের পরিক্রমায় হয়তো সংখ্যাটা বেড়ে কয়েকশ’ হয়ে যাবে একদিন। কিন্তু তামিমের ঐতিহাসিক সেঞ্চুরির পর ক্রিকেটের তিন ফরমেটেই (ওয়ানডে, টেস্ট ও টি২০) সেঞ্চুরি হাঁকানোর গৌরব অর্জনকারী ব্যাটসম্যানের সংখ্যা ১১ হয়ে গেছে। অর্থাৎ বিরল একটি একাদশ হয়ে গেছে তামিমকে দিয়ে! এই একাদশে আর ঢুকতে পারবেন না কেউ! ইতিহাস আগেও সৃষ্টি করেছেন। ক্যারিয়ার শুরুর পর থেকে পারফর্মেন্সের কারণে কখনও দল থেকে বাদ পড়েননি তিনি। টানা খেলেছেন অপরিহার্য ও নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য নতুন কিছু ইতিহাসও গড়েছেন আগেই। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস খেলে এখন পর্যন্ত শীর্ষস্থানে তিনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২০৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ২০১৫ সালে। ২০১২ এশিয়া কাপে টানা চারটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে নতুন নজির সৃষ্টি করেন। ওয়ানডে ক্রিকেটেও বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ১৫৪ রানের ইনিংসও তাঁর দখলে। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সেই টর্নেডো ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে শুধুমাত্র তামিমই। ক্রিকেট মক্কা লর্ডসে সেঞ্চুরি হাঁকানো একমাত্র বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে অনার্স বোর্ডে নামটাও তুলেছেন শুধুমাত্র তামিম। ইতিহাস পিছু ছাড়ছে না তামিমের। ক্রমেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য যে অবদান রাখছেন ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আগেই হয়তো জীবন্ত ‘কিংবদন্তি’ হয়ে উঠবেন তিনি। কারণ টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক ৭ সেঞ্চুরিসহ ৩৯.৪৬ গড়ে ৩১১৮ রান, ওয়ানডেতে ৩১.৬৩ গড়ে সর্বাধিক ৬ সেঞ্চুরি ও ৩২ হাফ সেঞ্চুরিসহ ৪৭১৩ রান। ওয়ানডে ও টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক চার-ছক্কাও তাঁর দখলে। ওয়ানডেতে ৬২ ছক্কা, ৫৩৬ চার এবং টি২০ ক্রিকেটে ২৫ ছক্কা, ১২০ চার হাঁকিয়েছেন তিনি। সত্যিকারের এক চ্যাম্পিয়ন তামিম! ওয়ানডে-টেস্টে রান করা এবং চার-ছক্কায় বাংলাদেশের রাজা হলেও বাকি ছিল টি২০ ফরমেটের সেরা হওয়ার। অথচ ব্যাটিং স্টাইলে স্বভাবগতভাবেই আক্রমণাত্মক মেজাজের তামিম। কিন্তু অভাটা ওমানের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে পুষিয়ে ফেললেন তিনি। ১০ চার ও ৫ ছক্কায় ১০৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ছাড়িয়ে গেলেন সবাইকে এবং এই ফরমেটেরও নতুন ইতিহাস গড়লেন বাংলাদেশের পক্ষে। এর আগে কোন বাংলাদেশী টি২০ ক্রিকেটে সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারেননি। বিশ্বকাপে দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৮৪ রানের ইনিংস ছিল সাকিব আল হাসানের। তিনি ২০১২ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেটি করেছিলেন ২৫ সেপ্টেম্বর পাল্লেকেলেতে। আর দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৮৮ রানের অপরাজিত ইনিংস এতদিন ছিল তামিমেরই দখলে। তিনি সেটি ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে মিরপুরে করেছিলেন। সবকিছুই ছাড়িয়ে নতুন উচ্চতায় পৌঁছুলেন তামিম। টি২০ ক্রিকেটে ১৮তম ব্যাটসম্যান হিসেবে শতক হাঁকিয়েছেন তিনি। সর্বমোট টি২০ সেঞ্চুরির সংখ্যা এখন ক্রিকেট ইতিহাসে ১৯টি। অথচ সেই সেঞ্চুরির দেখা এখন পর্যন্ত পাননি বিশ্বের নামী-দামী অনেক তারকাও। সেই বঞ্চিতের তালিকায় আছেন রিকি পন্টিং, ডেভিড ওয়ার্নার, বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনি, এবি ডি ভিলিয়ার্স, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও ইয়ন মরগানরা। আর বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি হয়েছে মাত্র ৭টি। সেক্ষেত্রে তালিকায় ঠাঁই হয়নি আরও বেশি তারকাদের। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এদিনই টি২০ ক্রিকেটে ১ হাজার রান পূর্ণ করেছেন। এখন তাঁর রান ৪৯ ম্যাচে ২৪.৮১ গড়ে ১০৯২। পরিসংখ্যানই কথা বলছে তামিম বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কি দিয়েছেন। আর বিভিন্ন সময়ে ধারাবাহিকতার নিদর্শন এখনও অটুট রেখে প্রমাণ দিয়ে চলেছেন সামর্থ্য ফুরোয়নি, বরং আরও বেড়েছে। এরপর কড়া সমালোচনা শুনতে হয়েছে তাঁকে। একেকটি ছক্কা হাঁকিয়েছেন তামিম সেটা ছিল নিন্দুকের গালে চপেটাঘাত, একেকটি দুর্দান্ত ইনিংস ছিল অকৃতজ্ঞ সমালোচকদের বুকে বজ্রমুষ্ঠির কষাঘাত আর একেকটি রেকর্ড তাদের মুখ কালো করে দিয়েছে। নিন্দুকের মন্দ কথা, সমালোচকদের কটুক্তি পেছনে ফেলে যিনি নিজের কাজ করে যেতে পারেন, আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে দেশ ও জাতির গৌরব বয়ে আনতে পারেন তিনিই প্রকৃত বীর। তামিম সত্যিকারের সেই মহাবীর! এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকেই দারুণ ফর্মে ছিলেন তামিম। আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য টি২০ ম্যাচে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৫১, ৫৫*, ১৪, ৩৭, ৮০*, ৩০, ৭, ১৩, ৮৩*, ৪৭ ও ১০৩* রান। অর্থাৎ ১১ ইনিংসে ৭৪.২৮ গড়ে ৫২০ রান! এরপরও তামিমের ধারাবাহিকতা নিয়ে কানাঘুঁষা হয়। মাঝে মাঝে খারাপ সময় আসলে তাঁকেই দল থেকে বের করে দেয়ার দাবি ওঠে। এ কারণেই মাঝে বেশ ক্ষেপে গিয়েছিলেন তামিম। এমনকি বলেছিলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে আর ক্রিকেটই খেলব না।’ কারণ শুধু ব্যক্তি তামিমকেই কটূক্তি করা হয়নি, কটূক্তি করা হয়েছে তাঁর পরিবারকে নিয়েও। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তাঁকে ‘ডানো’ ও ‘ম্যাগি নুডলস’ এর বিজ্ঞাপন করাকে উপহাস করে ব্যাটিং নিয়েও সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু তামিম সেসব নিয়ে কোন প্রতিবাদই করেননি। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা সবসময়ই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে গেছেন তামিম কি করতে সক্ষম সে কথাটি। ব্যাট হাতেই বিভিন্ন সময়ে সমালোচনার মোক্ষম জবাব দিয়েছেন তামিম রানের ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে। তিনি এতটাই ধারাবাহিক যে বিভিন্ন ফরমেটে এখন পর্যন্ত তাঁর ওপেনিং সঙ্গী ১৪ জন বদলেছে, কিন্তু থেকে গেছেন তামিম। রূপকথার মতোই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটি। কিন্তু সবকিছুকেই একেবারে বাস্তব করে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলে চলেছেন তামিম। সমালোচনার জবাবে তামিমের আর মুখের ভাষা প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। ব্যাটই উপযুক্ত জবাব তাঁর। এরপরও যারা নিন্দার ঝড় তুলবেন তাদের উচিত তামিমের ক্যারিয়ার রেকর্ডস পর্যবেক্ষণ এবং বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস পর্যালোচনা করা। কারণ ব্যাট হাতে জবাবটা দিয়েই যাচ্ছেন তামিম। সেটা শুনলে অবিশ্বাস্য রূপকথা মনে হলেও একেবারে ধ্রুব সত্য, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রবেশ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু থামতে চান না তামিম। ওমানের বিরুদ্ধে শতক হাঁকানোর পর তিনি বলেন, ‘আমি আরও ৫/৭/৮ বছর যাই খেলি না কেন, রেকর্ডগুলো ভাঙ্গা যাতে কঠিন হয় তা নিশ্চিত করে যাব। এমন একপর্যায়ে রেকর্ডগুলো নিয়ে যেতে চাই যেন যেই ভাঙ্গুক তার যেন খুব কষ্ট হয়। আর জেনে রাখুন যখন এসব কেউ ভাঙ্গবে তখন বাংলাদেশ অন্যরকম এক দল হবে।’ ঠিক যেন ফ্রেড ট্রুম্যানকে মনে করিয়ে দিলেন তিনি। ইংলিশ সেই পেসার ৩০০ উইকেট শিকারের পর বলেছিলেন, ‘হুএভার ব্রেকস দিস রেকর্ড হি উইল বি দ্য ব্লাডি টায়ার্ড!’ তিন ফরমেটেই বাংলাদেশের পক্ষে শীর্ষ চুড়ায় উঠে ইতিহাস গড়া হয়ে গেছে এবার শুধু উচ্চতা বাড়ানোর লক্ষ্য তামিমের। সেই ঘোষণাটা তো দিয়েই দিলেন। এখন শুধু তা বাস্তব হওয়ার অপেক্ষা। শুধু কথায় নয়, কাজেও করে দেখাবেন সেই প্রমাণটা তো এবার বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েই প্রমাণ করলেন তামিম!
×