ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জবাবদিহিতা ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ

গ্রাম উন্নয়নে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে লোকাল গবর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৫ মার্চ ২০১৬

গ্রাম উন্নয়নে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে লোকাল গবর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট

সমুদ্র হক ॥ মাঠ পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) গ্রাম উন্নয়নে লোকাল গবর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি) ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বছর ছয়েক আগেও যে গ্রামের প্রসূতি প্রসব বেদনা ওঠার সময় পথঘাট এবড়ো থেবড়ো থাকায় অত্যধিক ঝাঁকুনি ও সময় মতো হাসপাতালে পৌঁছতে না পাড়ায় সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মাকে নিয়েই ওপারে চলে যায়- সেই গ্রামে মসৃণ পাকা পথ ধরে এ্যাম্বুলেন্সও যায়। গ্রামে পল্লী বিদ্যুত না গেলে সোলার প্যানেলে বিদ্যুতায়িত হয় প্রতিটি ঘর। গ্রামের কোথায় কি করতে হবে চাহিদার নিরুপণ ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ ওয়ার্ডের লোকজনই করে ইউপিকে জানায়। ইউপি ওয়ার্ডের ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয় ও জবাবদিহিতা করে। পরিষদ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোটখাট অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করে। নারীর ক্ষমতায়নে নারী পরামর্শ তো দেয়ই কোন স্কিম বাস্তবায়িত করার আগে পুরুষ ও নারীর সমন্বয়ে দেখভাল (সুপারভাইজার) কমিটি গঠিত হয়। এলজিএসপি এভাবে সরাসরি গ্রামের মানুষের ভেতরে গিয়ে উন্নয়নে শরিক হয়েছে। দেশের ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদের সকল গ্রামে দ্বিতীয় পর্যায়ের এই কর্মসূচী ২ হাজার ১১ সালে শুরু হয়ে এ বছর শেষ হওয়ার পরই তৃতীয় পর্যায়ের কর্মসূচী শুরু হবে, এমনটি জানিয়েছে এলজিএসপি সূত্র। বগুড়ার স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক এসএএম রফিকুন্নবী জানিয়েছেন, গ্রামের মানুষের মতামতের আলোকে জনগণের চাহিদা নিরুপণ করে রাস্তাঘাট ছোট ব্রিজ, বক্স কালভার্ট, স্যানিটেশনসহ ছোটখাটো সকল কাজই এলজিএসপি জবাবদিহিতার ভিত্তিতে করে। যত প্রকল্প বা স্কিম নেয়া হয় তার এক তৃতীয়াংশ বাস্তবায়ন করে নারী। গ্রাম উন্নয়নের প্রতিটি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে গ্রামের মানুষ। গত ২ হাজার ১১ সালে দেশের ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়নে এলজিএসপির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। ব্যয়ের মোট প্রাক্কলন করা হয় ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে দাতাসংস্থা বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা দিয়েছে ২ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রদেয় ১ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। সূত্র জানিয়েছে, দাতাসংস্থা যাই দিক সরকারও এইসব খাতে টাকা দেবে। দেশ যেভাবে মধ্যম আয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা শুধু দাতাসংসস্থার অর্থ গ্রহণ নয় সম্মানজনক অবস্থানে সরকারও জোগান দেবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে এলজিএসপির কার্যক্রম এ বছর (২০১৬) শেষ হওয়ার কথা। এরপর তৃতীয় পর্যায় শুরু হবে। এলজিএসপি প্রথম পাইলট প্রকল্প করে সিরাজগঞ্জ। এর সাফল্যের পরই গ্রাম উন্নয়নে জবাবদিহিতার সহযোগিতা দিয়ে রিনিউ ভিত্তিক ৫ বছর মেয়াদের কর্মসূচী চালু করে। প্রথম পর্যায়ের সফলতা দ্বিতীয় পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এই কাজ শেষ হলেই তৃতীয় পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়নে প্রথমে থোক বরাদ্দ দেয়া হবে। কাজের সফলতার ওপর কয়েক পর্যায়ে বরাদ্দ দেয়া হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের সাফল্যের একটি ইউনিয়ন বগুড়ার শেখেরকোলা। এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমির মোহাম্মদ বশিরুল ইসলাম জানালেন, তিনি তিন টার্ম ধরে চেয়ারম্যান আছেন (এবারও নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন)। এলজিএসপির বরাদ্দ যেভাবে এবং যে জবাবদিহিতার মধ্যে আসে তাতে গ্রামের নারী-পুরুষের সরাসরি অংশগ্রহণে উন্নয়নের গতি বাড়ে। মাস দুয়েক আগে তিনি প্রথম পর্যায়ে প্রায় তিন লাখ টাকা পেয়েছেন। দ্রুত উন্নয়ন কাজ করার পর সাফল্যের ভিত্তিতে দিনদশেক আগে দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা ইউপি এ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে আরও কাজ করার জন্য এই অর্থ দিয়েছে। এই অর্থে কি কাজ করা যায় তা ওয়ার্ডের মানুষকে ডেকে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এবং কার্যাদেশ দেয়া হবে। ইতোমধ্যে মাটি কেটে একটি সংযোগ রাস্তা বানিয়ে দুই ধারে নারকেলের চারা রোপিত হয়েছে। কাজ মনিটরিং করার জন্যও থাকে একটি কমিটি। প্রতিটি কমিটিতেই নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। সবজি উৎপাদন প্রধান এই ইউনিয়নে ছোটখাট অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি জনস্বার্থের প্রয়োজনীয় সকল কাজই করা হয়। সবজি উৎপাদনেও এলজিএসপির অর্থে ইক্যুইপমেন্ট কেনা হয়। গ্রাম উন্নয়নে সরকারের কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) টেস্ট রিলিফ (টিআর) গম ও চাল বরাদ্দ আছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের আওতায় অবকাঠামো সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। সরকারী নির্দেশে টিআর ও কাবিখার মাধ্যমে যে কাজ হয় তার অর্ধেক ব্যয়িত হয় সোলার প্যানেলে। অর্ধেক অবকাঠামো উন্নয়ন সংস্কার কাজে। এর পাশাপাশি এলজিএসপি অর্থের বরাদ্দ উন্নয়নের সহযোগী হয়ে কাজ করে। এলজিএসপির প্রতিটি কাজেই গ্রামের নারী পুরুষ সকলের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। প্রতিটি কাজেরই জবাবদিহিতা আছে। একটি কাজের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী বরাদ্দ মেলে। এভাবেই এগিয়ে যায় কাজ। বগুড়ার স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক জানালেন বগুড়ায় দুই দফায় ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ আসে ১০৮টি ইউনিয়নের জন্য। স্পট কোটেশনের মাধ্যমে ওয়ার্ড কমিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পর সফলতা দেখে আরও বাড়িত বরাদ্দ আসে। এই কাজের মনিটরিংয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো- দেখভাল ও গ্রামের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গাঁয়ের মানুষের সঙ্গে বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিও থাকেন। একইভাবে বছরের বাজেট পেশ করা হয় সময়ের দুই মাস আগে। এই বাজেটের ওপর আলোচনা যোগ বিয়োগ করার পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তা অনুমোদন দেন। এলজিএসপির প্রতিটি কাজ জবাবদিহিতার মধ্যে থাকায় প্রতিটি গ্রামে এই কাজে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।
×