ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেমোরিয়াল ট্রাস্টের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী

৭ মার্চের ভাষণ যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা দেবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৩ মার্চ ২০১৬

৭ মার্চের ভাষণ যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা দেবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভয়াবহ অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, নাশকতা, জঙ্গীবাদসহ অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের কাছে মর্যাদা পেয়েছে। বাঙালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না ইনশাল্লাহ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। শনিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ উপলক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আয়োজিত আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশে করে বলেন, আজ নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমরা বীরের জাতি। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি। তাই আমরা প্রত্যেকে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলব। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আজও জাতিকে মাথা উঁচু করে চলার এবং যে কোন পরিস্থিতিতে শত্রুকে মোকাবেলা করার অনুপ্রেরণা দেয়। যুগ যুগ ধরে তাই বঙ্গবন্ধুর এই জাদুকরি কালজয়ী ভাষণ জাতিকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধুর কালোত্তীর্ণ ভাষণ : প্রস্তুতি ও প্রভাব’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান এবং ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী মাসুরা হোসেন। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দেশের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী হাশেম খান ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রনির্ঘোষ ৭ মার্চের ভাষণের প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে পথ দেখিয়ে গেছে। এ ভাষণের প্রত্যেকটি শব্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকেই আমাদের সেই চেতনাটা এনে দেয়। মাথা উঁচু করে পথ চলার মনোবল দেয়। যেকোন অবস্থা মোকাবেলা করার, শত্রুকে দমন করার পথ শেখায়। তাই এ ভাষণের আবেদন কোনদিন শেষ হবে না, শেষ হয়নি। ভাষণটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এ ভাষণের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তার কারণে একটি প্রজন্ম সত্য জানা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কালজয়ী এই ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ঐতিহাসিক এই ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের পথের দিশারী, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। যুগ যুগ ধরে এই ভাষণ বাঙালী জাতিকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে, যার আবেদন আজও বিন্দুমাত্র কমেনি। এ আবেদন কখনও শেষ হয় না, হবেও না। একটি মাত্র ভাষণে বঙ্গবন্ধু দেশের সব শ্রেণীপেশার মানুষকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, যা সত্যিই এক বিরল ঘটনা। তিনি বলেন, পরাজিত পাকিস্তানের সঙ্গে সংস্কৃতিসহ কোন কিছুতেই এদেশের সঙ্গে মিল ছিল না। তারা শুধু এ দেশকে শোষণ, শাসন করছিল। তাই বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকেই এ দেশকে স্বাধীন করতে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রাম করে গেছেন। আর ৭ মার্চের একটি মাত্র ভাষণে স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আর তার পথ বেয়েই আসে আমাদের স্বাধীনতা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগে পাকিস্তানীরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু একটা কিছু বলবেন, যার সূত্র ধরে তারা এদেশে গণহত্যা চালাবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী এই ভাষণে পাকিস্তানীরাও ভিরমি খেয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তাঁর কালজয়ী ভাষণে একদিকে যেমন বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করলেন, অন্যদিকে শত্রুরা এ ব্যাপারে সবকিছু বুঝতেই পারল না। পৃথিবীর আর কোন ভাষণ যুগ যুগ ধরে কোন জাতিকে অনুপ্রেরণা বা নতুন করে উজ্জীবিত করতে পারেনি, যেটি এখনও করে যাচ্ছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের সেই মাহেদ্রক্ষণে তাঁর মা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষণ দেয়ার আগে থেকে দলের নেতাসহ অনেকে অনেক পয়েন্ট লিখে দিচ্ছে, বলছে এটি না বললে হবে না। বস্তায় বস্তায় কাগজ জমা পড়তে লাগল ৩২ নম্বরে। কিন্তু আমার মায়ের দূরদৃষ্টির কোন তুলনা হয় না। যখনই কোন বড় কিছু ঘটনা ঘটে, তার আগে আমার মা বঙ্গবন্ধুকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগেই এ দেশের নাম বাংলাদেশ, লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ সবই নির্ধারণ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে ওই সময় পাশে থেকে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের পরামর্শ প্রদানের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ দেয়ার আগে আমার মা পিতা বঙ্গবন্ধুকে কিছু সময়ের জন্য আলাদা করে নিয়ে ঘরে গেলেন। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর মাথার কাছে বসা। মা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘তোমাকে অনেকেই অনেক কথা বলবে। সামনে লাখ লাখ মানুষ থাকবে। তাই কারোর কোন কথা শোনার কোন প্রয়োজন নেই। দেশের মানুষের জন্য তোমার যা মনের কথা সেটিই ভাষণে বলবে।’ তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ঠিকই এক জাদুকরী ভাষণের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং গেরিলাযুদ্ধের জন্য যা যা করার তারই সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে আমাদের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা পরবর্তী ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসবের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যখন ’৮১ সালে দেশে ফিরে আসি তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে নির্যাতনসহ জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, বাঙালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাঙালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন, পরাজিত শত্রুরা একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। এরপর থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়, চেতনাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলে। বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলে। ওই সময় একটি প্রজন্ম জানতেই পারেনি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের পদলেহন করে স্বাধীনতার চেতনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা দেশবাসী দেখেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তারা দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয়ী বীরের জাতি। আমরা মাথা নত করে চলব না। সারাবিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে চলব। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক সেই ভাষণে সেই পথই আমাদের দেখিয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস, দেশের নতুন প্রজন্ম বার বার জাতির জনকের সেই কালজয়ী ভাষণটি শুনে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশকে গড়ে তুলবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলবই। মূল প্রবন্ধে লেখক-সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, কালোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর অপূর্ব বাগ্মীতার এক অমর কীর্তি। এ ভাষণ আমাদের মুক্তির মন্ত্র, স্বাধীনতার প্রেরণা। একটিমাত্র ভাষণে বঙ্গবন্ধু চিরদিনের পদানত থাকা বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতাকামী জনগণকে জাগ্রত করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজও দেশের মানুষের কাছে সর্বজনীন প্রতীক। ভাষণটি শুনলে আজও দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। রামেন্দু মজুমদার বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অসামান্য ভাষণটি আজ সারাবিশ্বের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর এই কালজয়ী ভাষণটি ছিল রাজনীতির এক বড় কবিতা। বঙ্গবন্ধু অক্ষয়-অমর হয়ে থাকবেন দেশের মহার্ঘ স্বাধীনতা, শহীদ মিনার, রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে। অধ্যাপক মোঃ মশিউর রহমান বলেন, ষড়যন্ত্র এখনও বন্ধ হয়নি। অনেকে মধ্যপন্থার নামে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করার মতো সুযোগসন্ধানী পথ গ্রহণ করতে চান। কিন্তু তারা অতীতে সফল হয়নি, আগামীতেও সফল হবে না। এসব সুযোগসন্ধানী হয়ত আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন তৈরি করতে পারবে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বাঙালীর হৃদয় থেকে কোনদিনই মুঝে ফেলতে পারবে না। কেননা, বাংলাদেশের অপর নাম বঙ্গবন্ধু, কোন বুলেট দিয়ে এ নাম ফেলা যাবে না।
×