ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের পরিবারের দীর্ঘ প্রতীক্ষা

এক কিলোমিটার সড়কের নামকরণে ১০ বছর

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১২ মার্চ ২০১৬

এক কিলোমিটার সড়কের নামকরণে ১০ বছর

আনোয়ার রোজেন ॥ একজন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে এক কিলোমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যরে একটি সড়কের নামকরণে কত সময় লাগে? যদি বলি, ১০ বছর! একটু হয়ত ভ্রƒ কুঁচকে তাকাবেন তথ্যটির দিকে। কিন্তু যদি জানেন, জীবন বাজি রেখে নয় মাসে পরাধীন দেশকে মুক্ত করেছেন যে যোদ্ধা, স্বাধীন দেশে কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে তার নামে সড়কের নামকরণ ঝুলে আছে ১০ বছর! এবার ভ্রƒ কুঁচকানোর বদলে হয়ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের পরিবার ও এলাকাবাসীর দীর্ঘশ্বাসও এখন পরিণত হয়েছে দীর্ঘ প্রতীক্ষায়। ২০০৫ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক ও স্বনামধন্য ব্যক্তিদের অবদান স্মরণীয় করে রাখতে নগরের বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়কের নামকরণ করার উদ্যোগ নেয়। সেই ধারাবাহিকতায় প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের নামে রায়েরবাজার হাইস্কুল মোড়ের হোল্ডিং নম্বর ২৩১ সুলতানগঞ্জ থেকে ২৯৫/বি টালি অফিস রোড পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করার আবেদন করে স্থানীয় বাসিন্দারা। আবেদনের সঙ্গে গণস্বাক্ষরও সংযুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালের ২০ জুন ডিসিসির রাস্তা নামকরণ উপ-কমিটির নবম সভায় ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুর সড়ক’ নামে সড়কের নামকরণের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক অনুমোদন করা হয়। এরপর থেকে এ নিয়ে ডিসিসিতে চলেছে একের পর এক চিঠি চালাচালি। অবিভক্ত ডিসিসির নির্বাচিত পর্ষদের অধীনে ৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নামে নগরের ৬০টি সড়ক ও সাতটি স্থাপনার নামকরণ করা হয়। কিন্তু সেই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের নাম নেই। মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় তৎকালীন ডিসিসি প্রশাসন ও মেয়র মুরাদ ঠাকুরের নামে সড়কের নামকরণে তৎপরতা দেখাননি। সে সময় এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ‘দ্রুততম সময়ের’ মধ্যে সড়কের নামকরণের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। মেয়রের দেয়া সেই আশ্বাস কেবল স্থানীয় বাসিন্দা ও মুরাদ ঠাকুরের পরিবারের দীর্ঘশ্বাসই বাড়িয়েছে। অনুমোদনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সড়কের নামকরণ না হওয়ায় বর্তমান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) স্থানীয় ১৪ নম্বর ওয়ার্ড (সাবেক ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড) কমিশনারসহ এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বর্তমান ডিএসসিসি মেয়রের কাছে তাদের দাবি, দ্রুত সড়কটির নামকরণ করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুরাদ ঠাকুরের স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান জানানোর। পারিবার, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন ও রায়েরবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, মুরাদ ঠাকুর তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সুবেদার মেজর ছিলেন। ইপিআরের পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসাররা বাঙালী সৈনিকদের সঙ্গে সব সময় চরম দুর্ব্যবহার ও হয়রানি করতেন। এসবের প্রতিবাদে মুরাদ ঠাকুর ইপিআরের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর একাত্তরে দেশমাতৃকার টানে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমের অধীনে যুদ্ধ করেন মুরাদ ঠাকুর। শুধু নিজে যুদ্ধ করেননি, রায়ের বাজারের অসংখ্য তরুণ ও যুবককে সশস্ত্র প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। তরুণদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাপতি হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। তাঁর সহোদর দুই ভাইও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে একজন পুলিশের এসআই ছাত্তার ঠাকুর যুদ্ধে শহীদ হন। মুরাদ ঠাকুরের সহযোগিতায় রায়েরবাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী গোপন ঘাঁটি গড়ে ওঠে। এখান থেকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় প্রায়ই চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হতো। মুক্তিযুদ্ধের পর সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এ এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ শুরু করেন তিনি। এ ছাড়া এলাকার উন্নয়নেও তার অবদান রয়েছে। স্থানীয় অভাবী, দুস্থ মানুষের চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য আজীবন কাজ করেছেন। রায়েরবাজারে বহু শিক্ষা, ধর্মীয় ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গঠনে এলাকাবাসীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন মুরাদ ঠাকুর। ২০০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দাফন সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুরাদ ঠাকুরের নামে ২০০০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট ইস্যু করে, যার নম্বর ৪৯৯৬০। এরপর ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্টিফিকেটে ও ২০১৫ সালের ৪ নবেম্বর প্রকাশিত গেজেটেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম উল্লেখ রয়েছে। এমনকি স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও তাকে ভোলেনি এলাকার মানুষ। একজন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে রায়েরবাজার এলাকার সর্বত্র পরিচিতি তার। সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রায়েরবাজার হাইস্কুল মোড় থেকে টালি অফিস পর্যন্ত এক কিলোমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যরে সড়কটির বিভিন্ন জায়গায় পাঁচটি ব্যানার টাঙানো। মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের নামে সড়কটির নামকরণের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সংগঠনসহ স্থানীয় কমিশনার এবং আওয়ামী লীগ নেতারা এসব ব্যানার টানিয়েছেন। রায়েরবাজার হাইস্কুল মোড়ের একটি দোকান ঘেঁষে একটি নামফলক রয়েছে। দোকানদার জানালেন, মুরাদ ঠাকুরের নামে রাস্তার নামকরণের জন্য এই ফলক বসানো হয়েছিল। কিন্তু এতদিনেও ফলকে তাঁর নাম ওঠেনি। রাস্তাসংলগ্ন একাধিক দোকানদারের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপ হয়। তারা প্রত্যেকেই জানান, মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুর একজন সমাজসেবী ও সজ্জন মানুষ ছিলেন। কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুত সড়কটির নামকরণ তার নামে করে সেই দাবিও জানান তারা। এ প্রসঙ্গে মুরাদ ঠাকুরের ছেলে আহ্সানুজ্জামান ঠাকুর স্বপন জনকণ্ঠকে বলেন, নিজের নামে সড়কের নামকরণ করা হবে এই আশায় আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেননি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এলাকার মানুষ তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। তার মৃত্যুর পর শোকসভায় এলাকার মানুষ রায়েরবাজার হাইস্কুলের সুলতানগঞ্জ থেকে টালি অফিস পর্যন্ত সড়কটি তার নামে নামকরণের দাবি জানায়। এরপর ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সড়কটির নামকরণ করা হয়নি। আমি নিজেও অনেকবার তৎকালীন মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাত করেছি। তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি। অভিমানী কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এই গর্বটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট। এই গর্ব আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নামে সড়কের নামকরণ হলে রায়েরবাজারের বাসিন্দা হিসেবে আলাদা গর্ববোধ করতাম। ডিএসসিসির বর্তমান মেয়রের বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আশা করি, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তিনি রায়েরবাজারবাসীর আবেগ বিবেচনায় নিয়ে সড়কটির আনুষ্ঠানিক নামকরণের ব্যবস্থা করবেন। একই দাবি জানান স্থানীয় ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার মোঃ সেলিম। জনকণ্ঠকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই মুরাদ ঠাকুরকে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবী হিসেবে চিনতাম। এলাকার মানুষের জন্য তার ভীষণ দরদ ছিল। এলাকার উন্নয়নেও তিনি অবদান রেখেছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার নামে সড়কটির নামকরণের ব্যাপারে আমি উদ্যোগ নেব। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, ডিএসসিসির সড়ক বা স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর আগে কর্পোরেশন সাধারণ সভায় প্রস্তাবিত নামের ব্যাপারে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুর সড়কের ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়নি। নামকরণের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন জনকণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের নামে সড়কের নামকরণের ব্যাপারে আমি খোঁজ নিয়েছি। আগের ডিসিসি প্রশাসন নামকরণের প্রস্তাবটি যথাযথভাবে অনুমোদন করেনি। নামকরণ উপ-কমিটি অনুমোদন দিলেও ডিসিসির বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত করা হয়নি। এ জন্য নামকরণের ব্যাপারে নতুন একটি আবেদন করার পরার্মশ দেব। আবেদনটি পেলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×