ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

উত্তর কোরিয়ার প্রতি চীন কেন নমনীয়

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৯ মার্চ ২০১৬

উত্তর কোরিয়ার প্রতি চীন কেন নমনীয়

গত ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া কক্ষপথে তার সর্বশেষ কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে। তারও একমাস আগে সে তার চতুর্থ পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। দুটো ঘটনাই বিশ্বের দুই মহাশক্তি চীনও যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট বিরক্তি ও চিন্তার কারণ ঘটিয়েছে। তথাপি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকি মোকাবেলার প্রশ্নে এই দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্য এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিরোধও রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই বিরোধের একটা মস্ত কারণ হিসেবে কাজ করছে দক্ষিণ চীন সাগরের ক্রম উত্তপ্ত পরিস্থিতি। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, পরিস্থিতি যতই উত্তপ্ত হবে উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে চীন-মার্কিন মতানৈক্য ও বিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ নেবে। মহাকাশ ও পরমাণু প্রশ্নে পিয়ংইয়ংয়ের সর্বশেষ কার্যকলাপ চীন পছন্দ না করলেও প্রকৃত পক্ষে তেমন একটি অধ্যায়ের সম্ভবত অবসান ঘটবে যেখানে বেজিং তার এই অবাধ্য ক্লায়েন্টের প্রতি কঠোরতর ভূমিকা নেবে। এর প্রমাণ ২০১২ সালে উত্তর কোরিয়া সর্বশেষ কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠালে চীন এই দেশটির ওপর কঠোরতর অবরোধের ব্যবস্থা সম্ববলিত জাতিসংঘ প্রস্তাব অনুমোদনই শুধু করেনি, উপরন্তু কমিউনিস্ট পার্টি পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসের মাধ্যমে এই হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল যে, উত্তর কোরিয়া এমন করতে থাকলে চীন তার সাহায্য কমিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। এর তিন বছর পর উত্তর কোরিয়া আবার কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠালে শুধু বলেছে ‘ব্যাপারটা দুঃখজনক’। কেবল তাই নয়, চীন এই হুঁশিয়ারিও দিয়েছে যে, জাতিসংঘের এমন কোন প্রস্তাব নেয়া উচিত নয় যাতে কোরীয় উপদ্বীপে স্থিতিশীলতা ক্ষুণœ হয় অর্থাৎ চীনের ভূমিকা যে নমনীয় হয়েছে তা এতে স্পষ্ট। তবে চীনের এই ভূমিকা পরিবর্তনের মানে এই নয় যে, বেজিং পিয়ংইয়ং শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অধিকতর বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে চীনা নেতৃবৃন্দই শুধু নন, সাধারণ চীনারাও প্রেসিডেন্ট কিম জংউনের ওপর অতিশয় বিরক্ত ও ক্রব্ধ। তারপরও উত্তর কোরিয়ার কার্যকলাপের প্রতি চীনের ভূমিকা নমনীয় হবার কারণ এই দেশটিকে চীনারা তাদের স্ট্র্যাটেজিক সম্পদ বলে মনে করে। চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং গত গ্রীষ্মে এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে উত্তর কোরিয়া যদি পারমাণবিক অস্ত্রভা-ার গড়ে তুলে সেটা চীনের পছন্দ না হলেও সে দেশটি অস্থিতিশীল হওয়ার চাইতে স্থিতিশীল থাকাটা চীনের জন্য বাঞ্ছনীয়। স্ট্র্যাটিজর গুরুত্বের কারণেই চীন উত্তর কোরিয়ার পাশে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের অবনতিশীল সম্পর্কের কারণেই উত্তর কোরিয়ার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব চীনের কাছে বেড়ে গেছে। সে জন্যই আগের হুমকি অনুযায়ী চীন উত্তর কোরিয়ায় তার পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ বা কমিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তেমন কিছুই করেনি। বলাবাহুল্য উত্তর কোরিয়ার মোট বাণিজ্যের দশ ভাগের ৯ ভাগই হয় চীনের সঙ্গে। এই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বার্ষিক পরিমাণ ৭শ’ কোটি ডলার। উত্তর কোরিয়ার প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেক খাদ্যসামগ্রী, দশ ভাগের ৭ ভাগ এবং পাঁচ ভাগের ৪ ভাগ ভোগ্যপণ্য চীন থেকে আসে। চীন উত্তর কোরিয়ায় কোন অস্থিরতা দেখতে চায় না। চীনের বহু আগে থেকেই আশঙ্কা যে উত্তর কোরিয়ায় যে কোন টালমাটাল অবস্থা দেখা দিলে চীন অভিমুখে উদ্বাস্তর ঢল নামবে। এই উদ্বাস্ত সঙ্কট চীনেও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। এর উপরও কথা আছে। দক্ষিণ চীন সাগরের রাজনৈতিক ও স্ট্র্যটেজিক পরিস্থিতি দিন দিন উষ্ণ হয়ে উঠছে। চীনের ভাষায় যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে উস্কানিমূলক তৎপরতায় নিয়োজিত। চীন আশঙ্কা করে আমেরিকার এই তৎপরতা বাড়বে এবং দুই দেশ মুখোমুখি সংঘাতের অবস্থায় এসে দাঁড়াবে। এ অবস্থায় উত্তর কোরিয়া এই দুই দেশের মধ্যে বাফার অঞ্চল হয়ে দাঁড়াবে বলাবাহুল্য দক্ষিণ কোরিয়া বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের ঘোরতর মিত্র ও মার্কিন বাহিনীর ঘাঁটি। এশিয়ায় চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর হয়ে উঠায় এই বাফার দেশটির গুরুত্বও বেড়ে গেছে। তবে এই বাফার অঞ্চল বজায় রাখার মাশুল চীনের জন্য বেড়ে যেতে পারে। উত্তর কোরিয়ার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও পরমাণু পরীক্ষার পর থেকে মার্কিননীতির সুর ও বক্তব্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে। একদিকে আমেরিকা আরও কঠোর জাতিসংঘ অবরোধ আরোপের দাবি জানিয়েছে, অন্যদিকে এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে উত্তর কোরিয়াকে সাহায্য দেয়া হলে তার জন্য চীনের মতো তৃতীয় দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা সম্বলিত একটি বিল মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে পাস হয়েছে। আরও কথা আছে, এবারের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর দক্ষিণ কোরিয়া তার ভূখ-ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাÑ টার্মিনাল হাই অল্টিচুড এয়ার ডিফেন্স প্লাটফর্ম (থাড) মোতায়েন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। থাডের লক্ষ্য হলো উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা। কিন্তু চীন আশঙ্কা করে এই ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার স্যাটেলাইট ও পরমাণু বোমা নিয়ে চীন যতটা না উদ্বিগ্ন তার চেয়ে ঢেড় বেশি উদ্বিগ্ন এইথাড নিয়ে। এটির মোতায়েন ঠেকানোর জন্য চীন বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে আসছিল। সূত্র: দি ইকোনমিস্ট।
×