ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মনিপুরীদের নিজস্ব লিপি, ভাষা ও সাহিত্য আছে

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ৫ মার্চ ২০১৬

মনিপুরীদের নিজস্ব লিপি, ভাষা ও সাহিত্য আছে

বাংলাদেশে অনেক ভাষার মধ্যে একটি হচ্ছে মনিপুরী ভাষা। মঙ্গোলীয় মহাজাতির তিব্বত-ব্রহ্ম শাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীর অন্তর্গত মনিপুরী জাতি। অভ্যন্তরীণ কলহ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহজনিত নানা কারণে মনিপুরী জনগণ বিভিন্ন সময়ে তাদের আদি আবাসস্থল মনিপুর রাজ্য ছেড়ে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করে আজ থেকে আড়াই শ’/তিন শ’ বছর আগে। মনিপুরীদের নিজস্ব লিপি আছে। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে মনিপুররাজ পাখংবা লিপির উদ্ভাবন করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। তখন এর সংখ্যা ছিল ১৮। পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে মহারাজা খাগেম্বা আরও কিছু বর্ণ সংযোজিত করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মহারাজ গরিব নেওয়াজের শাসনামলে হিন্দু ধর্মের ব্যাপক বিস্তৃতি লাভের প্রেক্ষাপটে মনিপুরী লিপির স্থান গ্রহণ করে বাংলা লিপি, সেই থেকে মনিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতে লেখা হয়ে আসছে। প্রচুর বিতর্ক সত্বেও সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে, মনিপুরী লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। মনিপুরী লিপির অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রতিটি বর্ণমালার নামকরণ দেহের এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামানুসারে এবং এর গঠনও সংশ্লিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন প্রকৃতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বাংলা ‘ক’-এর মনিপুরী প্রতিবর্ণের নাম ‘কোক’ যার বাংলা অর্থ মাথা। এমনি করে বাংলা ‘স’-এর মনিপুরী প্রতিবর্ণ হলো ‘সম’ যার অর্থ চুল এবং বাংলা ‘ম’-এর মনিপুরী প্রতিবর্ণ ‘মিৎ’ যার অর্থ চোখ ইত্যাদি। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামানুসারে মনিপুরী বর্ণমালার নামকরণ অনন্য নিদর্শন এবং সম্ভবত পৃথিবীতে নজিরবিহীন। মনিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ॥ মনিপুরী ভাষা ও সাহিত্য অত্যন্ত প্রাচীন। এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুদীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ। উৎস বিচারে মনিপুরী ভাষা মঙ্গোলীয় মহাপরিবারের তিব্বত-ব্রহ্ম শাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। পরিতরাজ অতোম্বাপু শর্মা, যাকে ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রাচ্যের ঋষি অগস্ত্য বলে অভিহিত করেছেন, তার মতে ‘মৈতৈ’ বা মনিপুরী ভাষার বয়স অন্যূন তিন হাজার চারশ’ বছর এবং প্রাচীনতার দিক থেকে মনিপুরী সাহিত্যের স্থান ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য কৃষব্ধ-যজুর্বেদের পরই। ১৯৭২ সালে মনিপুরী ভাষা ভারতের সাহিত্য একাডেমির স্বীকৃতি লাভ করে। তারপর থেকেই শুরু হয় মনিপুরী কবি সাহিত্যিকদের একাডেমি এওয়ার্ড দিয়ে সম্মানিত করার পালা। এ ছাড়াও সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারত সরকার প্রদত্ত সবচেয়ে মর্যাদাবান উপাধি ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত হয়েছেন মনিপুরী সাহিত্যের অনেক কবি ও সাহিত্যিক। স্বকীয় সাহিত্যেই শুধু নয়, অনুবাদের ক্ষেত্রেও মনিপুরী সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। মনিপুরী ভাষায় অনূদিত হয়েছে রামায়ণ, মহাভারতের মতো কালজয়ী সাহিত্যকর্ম; মেঘদূত, ইলিয়াড, ওডেসির মতো ক্লাসিক সাহিত্য; শ্রীমদ্ভগবতগীতা, বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মের বিখ্যাত গ্রন্থাবলী; রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, টলস্টয়, হোমার, বার্নাড শ’, সোফোক্লিস, বঙ্কিম, শরৎসহ বিশ্ব-সাহিত্যের মহৎ রূপকারদের অনন্য সব সাহিত্যকর্ম। শরৎচন্দ্রের তো সমগ্র রচনাবলীই অনূদিত হয়েছে মনিপুরী ভাষায়। মনিপুরী সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অনেক সৃষ্টিকর্মও অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। বর্তমানে যারা মনিপুরী নামে পরিচিত, বা মনিপুরী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বলতে যে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়ে থাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত তা মৈতৈ জাতি বা মৈতৈ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নামে পরিচিত ছিল। -সালাম মশরুর, সিলেট থেকে
×