ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ৪০ বছরের দন্দ্ব

খাত সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ৩ মার্চ ২০১৬

খাত সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ আগামী অর্থবছরেও (২০১৬-১৭) সমাধান হচ্ছে না খাত সঙ্কটের। এ নিয়ে গত ৪০ বছর ধরে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখা হচ্ছে। গত বছর পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের প্রস্তাবিত ১৪টি খাত ধরেই তৈরি করা হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। তাই আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) বরাদ্দও সে অনুযায়ী হওয়া উচিত বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। গত সোমবার সাধারণ অর্থনীতি বিভাগে কমিশনের সকল সদস্যদের নিয়ে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে খাতভিত্তিক কর্মকৌশল সংক্রান্ত এক বৈঠকে এ বিষয়েও তাগিদ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের নীতিমালা নিয়ে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে অর্থ মন্ত্রণালয়। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ (বিআইডিএস) কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত থাকবেন। খাত সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, দুই মন্ত্রণালয়ের খাতগুলোকে এক সঙ্গে করে মোট ১৪টি খাত করার প্রস্তাব দিয়েছি। বর্তমানে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কার্যক্রমের ধরন এবং উন্নয়নের চাহিদা বিবেচনা করে এটা করা হয়েছে। কেননা দীর্ঘদিন ধরে দুই মন্ত্রণালয়ের খাত সংক্রান্ত অসামঞ্জস্যতা আছে। বাজেটে বরাদ্দ দুইভাবে প্রতিফলিত হতো। যেমন কৃষি খাত যখন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ধরা হতো তখন ৫টি মন্ত্রণালয়ের তথ্য থাকত। আবার একই কৃষি খাত যখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে ধরা হতো তখন ৯টি মন্ত্রণালয়ের তথ্য থাকত। ফলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসত না। তাছাড়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দিচ্ছিল, যাতে আমরা খাত সমন্বয় করি। এসব দিক বিবেচনা করে খাতগুলো সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে অনুযায়ীই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা এবং বাজেট ও এডিপির খাত এক হলেই সবচেয়ে ভাল হয়। এখন পর্যন্ত জানি না আগামী অর্থবছরে এটি করা হবে কিনা। এক প্রশ্নের জবাবে ড. আলম আরও বলেন, খাত সমন্বয় করতে গিয়ে কোন খাত বাদ পড়েনি। কেননা আমরা চেষ্টা করেছি দুই মন্ত্রণালয়ের খাতগুলোকে একখানে করে সমন্বিত করার। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকা- আরও বেশি গতিশীল হবে। সূত্র জানায়, বর্তমানে ১৭টি খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে খাত সংখ্যা কমিয়ে ১৪টিতে বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের মোট ৩০টি খাতের মধ্যে সমন্বয় করতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল এর মধ্য দিয়ে ৩০-৪০ বছর ধরে চলতে থাকা দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে খাত সংক্রান্ত জটিলতার অবসান ঘটবে। কিন্তু চলতি অর্থবছর অর্থ মন্ত্রণালয় সেই প্রস্তাবনা গ্রহণ না করে ১৭টি খাতেই বরাদ্দ দেয়। আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের নতুন এডিপিতে নতুন খাতে বরাদ্দ দেয়া হবে কিনা সে বিষয়ে এখনও কোন আলোচনাই শোনা যাচ্ছে না। এমনটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে খাত সঙ্কটের সমাধান সংশয়ের মধ্যেই থাকছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব তারিক-উল-ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়টি এখনও আমার নজরে আসেনি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, আগামী অর্থবছরেও ১৪ খাতে বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত নয়। কেননা এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এখনও কোন নির্দেশনা আসেনি। তাছাড়া এ করতে এখনও বেশ কিছুটা সময় লাগবে। সুতরাং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দ আগের মতোই ১৭ খাতেই হতে পারে। এ বিষয়ে এ সময় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এর আগে জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, অর্থ ও পরিকল্পনা এই দুটো মন্ত্রণালয়ের আলাদা আলাদা খাত রয়েছে। ফলে খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ, অর্থ বরাদ্দ ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা দেখা দেয়। মূলত এসব জটিলতা দূর করতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৪টি খাত ধরে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। অর্থ ও পরিকল্পনা উভয় মন্ত্রণালয়ই এটি অনুসরণ করবে। তবে খাতগুলোর অধীনে উপখাত এখনও নির্ধারিত হয়নি। এক্ষেত্রে আরও যাচাই বাছাই করতে হবে। সূত্র জানায়, বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) ১৭টি খাত রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন এসব খাত নির্ধারণ করে থাকে। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে খাত ১৩টি। উন্নয়ন কার্যক্রমের সুবিধার্থে এ খাতগুলোকে সম্বন্বয় করে ১৪টিতে নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ বিষয়ে এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন নির্ধারিত অভিন্ন খাতগুলো হচ্ছে, জেনারেল পাবলিক সার্ভিসেস, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা, কৃষি, বিদুত ও জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, গৃহায়ণ, স্বাস্থ্য, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম, শিক্ষা ও প্রযুক্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তা। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, এর জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ এবং এ সংক্রান্ত প্রশাসনিক জটিলতা দূর করতে ‘রেশনালাইজেসন অব সেক্টরস ইন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং এ্যান্ড বাজেটিং’ শীর্ষক একটি মূল্যায়ন উপস্থাপন করে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এতে বলা হয়, অর্থনীতির খাতগুলোকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ভিন্ন ভিন্নভাবে সজ্ঞায়ন ও নির্ধারণ করে থাকে। এর ফলে যে সমস্যা হয় তা হলো, পরিভাষাগত জটিলতা, একটি মন্ত্রণালয়ের একাধিক খাতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া, একই ধরনের প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া, এডিপি বাস্তবায়ন ও সম্পদ বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ণে জটিলতা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের নির্ধারিত ১৭টি খাত হচ্ছে, কৃষি-পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, পানিসম্পদ, শিল্প, বিদ্যুত, তেল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবহন, যোগাযোগ, ভৌত পরিকল্পনা,পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ, শিক্ষা ও ধর্ম, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবার পরিকল্পনা, গণযোগাযোগ, সমাজকল্যাণ, নারী ও যুব উন্নয়ন, জনপ্রশাসন, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের খাতগুলো হচ্ছে, পাবলিক সার্ভিস, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ, গৃহায়ণ, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম, জ্বালানি, কৃষি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা এবং পরিবহন ও যোগাযোগ।
×