ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ॥ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

বাঙালীর প্রাণের বই মেলা শুরু হচ্ছে আজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাঙালীর প্রাণের বই মেলা শুরু হচ্ছে আজ

মোরসালিন মিজান ॥ ভাই হারানোর ব্যথা আর মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরব নিয়ে শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা, বিকাশ, বাঙালী সংস্কৃতির বহমান উদার অসাম্প্রদায়িক ধারায় অনন্য সংযোজন বইমেলা আজ সোমবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালী জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমির আয়োজনে মেলায় অংশ নেবে দেশের প্রায় সকল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন শুরু হয়ে মেলা চলবে শেষদিন পর্যন্ত। বইয়ের প্রদর্শনী ও বেচা-কেনার এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন সারাবিশ্বেই বিরল। সকল বাঙালীর আবেগ-ভালবাসার অনিন্দ্যসুন্দর প্রকাশ বইমেলা একই সঙ্গে প্রাণের মেলা হিসেবে খ্যাত। শুধু বইকে কেন্দ্র করা হলেও কালক্রমে এটি হয়ে উঠেছে বঙ্গ-সংস্কৃতির বৃহৎ উৎসব। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল বাঙালী। রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারের তাজা রক্ত গড়েছিল নতুন ইতিহাস। তাঁদের রক্তে নতুন প্রাণ পায় আমরি বাংলা ভাষা। অমর একুশের চেতনাকে ধারণ করেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। অনন্য সাধারণ সূচনা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউসের বটতলায় চট পেতে বসেছিলেন স্বপ্নবাজ এই প্রকাশক। মাত্র ৩২টি বই। বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা এসব বই প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী)। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। নিজের প্রকাশিত বই নিয়ে একাই উদ্যোগটি অব্যাহত রাখেন চিত্তরঞ্জন। যতদূর জানা যায়, ১৯৭৬ সালে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮ সালে মেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। কোন কোন সূত্রমতে, ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করেন। বর্তমানে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। এরই মাঝে চলতি বছরের আয়োজনের সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চ। কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য বর্ধমান হাউসের সামনে বিশাল এই মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানেই আজ সোমবার বিকেল ৩টায় মেলার উদ্বোধন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠান মঞ্চে থাকবেনÑ সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলা একাডেমির সভাপতি আনিসুজ্জামান ও মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বিদেশী অতিথিরা। বাংলা একাডেমির আমন্ত্রণে এসেছেন ব্রিটিশ কবি জীবনানন্দ ও অনুবাদক জো উইন্টার। চেক প্রজাতন্ত্র থেকে এসেছেন লেখক-গবেষক রিবেক মার্টিন। প্রথমবারের মতো যোগ দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি রিচার্ড ডেনিস পল শার্কিন ও সাধারণ সম্পাদক জোসেফ ফেলিক্স বুরঘিনো। অতিথিদের সকলেই বাংলা ভাষার অনুরাগী। নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বাংলা ভাষায় ব্যক্ত করবেন তাঁরা। একই অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০১৫ প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করবেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পৌত্রী অনিন্দিতা কাজী। এবারও গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হবে দুটি ভেন্যুতে। বাংলা একাডেমি চত্বরে থাকবে সরকারী প্রতিষ্ঠান ও এনজিওসহ বিভিন্ন মিডিয়ার স্টল। একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮২ প্রতিষ্ঠানকে ১১১ ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বহেড়াতলায় চালু হচ্ছে লিটলম্যাগ চত্বর। ৯২টি লিটল ম্যাগাজিনকে বর্ধমান হাউসের দক্ষিণ পাশে লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যাঁরা বই প্রকাশ করেছেন তাঁদের বই বিক্রি ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। একাডেমি প্রাঙ্গণে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ির আদলে লেখককুঞ্জ নির্মাণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও প্রস্তুত। এখানে অনুষ্ঠিত হবে মূল মেলা। প্রথমবারের মতো গুচ্ছাকারে সাজানো হয়েছে সবুজ খোলা প্রান্তর। বাংলা একাডেমিসহ ১৪ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মোট ৬০০০ বর্গফুট আয়তনের ১৫টি প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছে। এখানে মোট প্রতিষ্ঠান ৩২০টি। ইউনিট সংখ্যা ৫৪০। এবার শিশু কর্নারও থাকছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। জানা যায়, প্রকাশকদের দাবি ও বই বিক্রির সুবিধার্থে এই সিদ্ধান্ত। মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় থাকবে বিশেষ শিশুপ্রহর। শুক্র ও শনিবার সকালে বিশেষ আয়োজন থাকবে শিশুদের জন্য। একাডেমির নজরুল মঞ্চে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে। এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি থেকে আসছে শতাধিক নতুন বই। আসছে সদ্য প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’। একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের বিশেষ প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে মেলায়। একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলা একাডেমির দুটি প্যাভিলিয়ন, অভিধান বিক্রয়কেন্দ্র, শিশু-কিশোর প্রকাশনাভিত্তিক বিক্রয়কেন্দ্র এবং একাডেমির সাহিত্য মাসিক ‘উত্তরাধিকার’র বিক্রয়কেন্দ্র থাকবে। বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্র থেকে নতুন বই ৩০ ভাগ ছাড়ে বিক্রি হবে। আয়োজনের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার থেকে সমাপনী দিন পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ এবং বিশিষ্ট বাঙালী মনীষার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ ও বের হওয়ার আটটি পথ থাকবে। এবারই প্রথম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের সুবিধার্থে একটি নতুন সুপ্রশস্ত গেট নির্মাণ করা হয়েছে। টিএসসি ও দোয়েল চত্বরসংলগ্ন এলাকায় থাকছে দুটি মূল প্রবেশপথ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য থাকছে তিনটি পথ। গ্রন্থমেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিন সময় বেড়ে হবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে। সবদিক বিবেচনায় রেখে নেয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। মেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জানান, এবার মেলার প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্তসংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। নিñিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলা এলাকাজুড়ে দু’শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। রবিবার ডিএমপির মিডিয়া বিভাগে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, চাইলে বইমেলায় ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের বাড়তি নিরাপত্তা দেয়া হবে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে যারা হুমকি পেয়েছেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। মেলায় বিদেশী স্টল, বিদেশী অতিথি এবং ভাষাসৈনিকদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা থাকছে। মেলা চলাকালীন বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসাধারণের প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। সব মিলিয়ে প্রস্তুত বাংলা একাডেমি। এবারের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, এবারের মেলা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছর বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। একজন লেখক ও একজন প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। এই অবস্থায় সবদিক বিবেচনায় রেখে প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এবারের আয়োজনটি অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল এবং শ্রেষ্ঠ আয়োজন হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
×