ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমাদের মাঝে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন মুক্তিযোদ্ধা গবেষক সামছুল আরেফিন’

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

‘আমাদের মাঝে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন মুক্তিযোদ্ধা গবেষক সামছুল আরেফিন’

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় শক্ত হাতে অস্ত্র ধরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। দেশ স্বাধীন করার পর বিজয় অর্জন হলে নিশ্চুপ হয়ে ঘরে বসে থাকেননি। দিনরাত কঠিন পরিশ্রম করে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরতে প্রায় অর্ধশতাধিক গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশে কাজ করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। এমন গুণী মানুষ আমাদের মাঝে অনেকদিন বেঁচে থাকুক, সুস্থ থাকুক। মানুষটি মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক এএসএম সামছুল আরেফিন। এমন জীবন্ত কিংবদন্তি মানুষের গবেষণা কাজের ৪০ বছরপূর্তিতে আয়োজিত আলোচনা সভায় শনিবার বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। তাঁর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণার ৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানটি রূপ নেয় জন্মদিন পালন ও শুভকামনার অনুষ্ঠানে। কারণ এদিন ছিল তাঁর ৬৫তম জন্মদিন। এই অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্মান জানিয়ে বক্তব্য দেন দেশী-বিদেশী লেখক, প্রকাশক, গবেষক, রাজনীতিবিদ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। বক্তব্যে সবাই এই গুণী ব্যক্তির দীর্ঘায়ু এবং সুস্থতা কামনা করেন। অনুষ্ঠানে এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এবং সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুলের উপস্থাপনায় বক্তব্য রাখেনÑ বিমান রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, আবেদ খান, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, বাংলা একাডেমির পরিচালক শামসুজ্জামান খান, সাংসদ আদুল ওদুদ তারা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, প্রকাশক শ্রীতিদ্বীপ ভট্টাচার্য, শ্রী শঙ্কর ম-ল প্রমুখ। বিদেশে অনুষ্ঠানে একটি ছোট্ট চিরকুটে এএসএম সামছুল আরেফিন সম্পর্কে নিজের ভালবাসা ও শ্রদ্ধার কথা লিখে পাঠান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অনুষ্ঠানের শুরুতেই দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা দিয়ে অতিথিদের মুগ্ধ করেন শিল্পী নাহিয়ান ফারজানা সূচি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের হাসান আরিফ। এরপর শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোচনাপর্ব। বিমান রাশেদ খান মেনন বলেন, দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তেমন কোন ভাল কাজ হয়নি। যতটুকু হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করার চেষ্টা। সেই জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বের করে এনে তার তথ্যউপাত্তকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা একটি বড় ধরনের কাজ বলে আমি মনে করি। আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবকিছু ভুলে যাই। ভুলে যাই আমাদের প্রকৃত ইতিহাস। সে কারণেই হয়ত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কিছু লোক সম্মানের সঙ্গে এ দেশে বসবাস করে গেছে। সাম্প্রতিক বিচারের মাধ্যমে তাদের কয়েকজনের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে। তাঁর গবেষণার মধ্য দিয়ে আমরা সেই বিরোধিতাকারীদের তালিকা পাই। তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সত্য ইতিহাস জানতে পারবে। তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির সময়ে তাঁর লেখা বইসমূহ সত্যের প্রদীপ হয়ে আলো ছড়াচ্ছে। যাদের ইতিহাস নেই তাদের কাজই ইতিহাসকে বিকৃত করা। বিএনপি-জামায়াত ও তাদের দোসরদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার ষড়যন্ত্র কখনই সফল হবে না। গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, গবেষণার কাজটি খুবই কঠিন। খনির শ্রমিকের মতো। খুঁড়ে খুঁড়ে কষ্ট করে সত্য খুঁজে বের করতে হয়। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা সামছুল আরেফিনের মতো একজন গবেষককে পেয়েছি, যিনি মুক্তিযুদ্ধকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। অসংখ্য মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ পড়েন গবেষক এএসএম সামছুল আরেফিন। তিনি বলেন, আমি বিগত ৪০ বছরে যে কাজ করেছি, তা যদি কারও বিন্দুমাত্র কাজে আসে বা কাজে লেগে থাকে, তারাই বলতে পারবেন আমি সফল না ব্যর্থ। আমি জানতাম, মুক্তিযুদ্ধ শেষে সবাই মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখবে, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা লিখবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের কথা সবাই লিখবে না। আমার কাজ যদি আগামী প্রজন্মের কাজে আসে, গবেষণার সূত্র ধরিয়ে দেয়, তাহলেই নিজেকে সার্থক মনে করব। মুক্তিযুদ্ধাকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার গবেষক ভিনিউজের প্রধান সম্পাদক এএসএম সামছুল আরেফিন ১৯৫১ সালের ১৬ জানুয়ারি খুলনার পাইকগাছার বেতবুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র থাকাকালে ছাত্রলীগের সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং কলেজ সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধকালে খুলনা অঞ্চলে সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮টি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন। এ সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা কাজে ব্রত হন। শনিবার ছিল তাঁর গবেষণার ৪০ বছরপূর্তি এবং জন্মদিন। এ পর্যন্ত তাঁর গবেষণাধর্মী ২৭ বই প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং নির্বাচন নিয়ে তার বই সর্বত্র সমাদৃত।
×