ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় নিহত হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে যেভাবে গুনে গুনে বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে সে রকম ঘটনা বিরল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দীর্ঘদিন হতে দেয়া হয়নি। সেটি আমাদের জানা। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা জড়িত ছিলেন তারাই ইনডেমনিটি দিয়েছিলেন। তারাই ছিলেন বেনিফিশিয়ারি। এটি বোঝার জন্য গভীর কোন গবেষণার প্রয়োজন নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে যে রায় দেয়া হয়েছে তা পড়লেই ষড়যন্ত্র ও এর কুশীলবদের পরিচয় জানা যায়। কিন্তু এর বাইরেও কিছু থেকে যায় বা গেছে। যারা খুনী তারা ছাড়া অন্য যারা ছিলেন তারা কারা, তাদের ভূমিকা কীÑ সেটা খুব একটা জানা যায় না। এর একটি উৎস হতে পারে সেনা কর্মকর্তাদের ভাষ্য। সে নিয়ে আমার একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশী জেনারেলদের মন (২০১৫)। এখানে তার কিছু অংশ ব্যবহৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় সব সময় তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর ওপর চাপানো হয়েছে। ১৫ আগস্ট এলে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন, যার কোন যৌক্তিকতা নেই। কারণ, এই খুনের সঙ্গে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের একাংশ জড়িত ছিলেন, যা প্রমাণিত এবং যারা এই সমালোচনা করেন তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও স্বচ্ছ নয়। অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা এ সম্পর্কে লিখলেও জেনারেল শফিউল্লাহ কখনও তেমন কিছু বলেননি। এখন বললেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার গ্রন্থÑ ফিফটিনথ আগস্ট : এ ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি। ১৮৪ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। গ্রন্থটি আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক। তার এ বইয়ে তিনি শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, যারা তাকে ‘অভিযুক্ত’ করেছেন তাদের বক্তব্যের প্রতিটি লাইনের জবাব দিয়েছেন। একই কথা বার বার লিখেছেন, যা অনেক সময় একঘেয়ে ও বিরক্তিকর। কিন্তু তিনি উকিলের মতো সওয়াল-জওয়াব করেছেন দেখে হয়ত এত পুনরাবৃত্তি। এ গ্রন্থে শফিউল্লাহ অনেক তথ্য দিয়েছেন, অনেক অজানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সৈনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই বোধহয় এখন একমাত্র জীবিত, যার লেখার কথা ছিল। তিনি তার কর্তব্য সমাপন করেছেন। তার ওই গ্রন্থটি অবলম্বনে এ প্রবন্ধ। দুই. ১৫ আগস্ট এলে মেজর জেনারেল (অব) শফিউল্লাহ বীরউত্তম হয়ে ওঠেন অনেকের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। বিশেষ করে তখন বীরবিক্রম হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে রাজনীতিবিদ শেখ সেলিম। তিনি বক্তৃতা মঞ্চ থেকে ঘোষণা করেন, শফিউল্লাহই দায়ী বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য। এই ধারণা বিষয়টিকে একপেশে করে ফেলে। শুধু শফিউল্লাহ দায়ী হলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, দেশীয় ষড়যন্ত্র যার প্রধান ছিলেন খন্দকার মোশতাক, যারা খুন করেছেন, খুনীচক্র লে কর্নেল ফারুক-রশীদ-ডালিম-মহিউদ্দিনÑএরা সবাই বাদ পড়ে যান। অবশ্য শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেনÑএ কথা বলা হয় না। বলা হয়, সেনাপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে তিনি রক্ষা করতে পারেননি। তিনি কাপুরুষ। সে অভিধা দিতে গেলে পুরো সেনাবাহিনীকেই দিতে হয়, শুধু শফিউল্লাহকেই নয়। বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীরই ছিল না। তাছাড়া আওয়ামী লীগের একাংশ যখন শফিউল্লাহকেই দায়ী করেন তখন প্রশ্ন ওঠে, তারা কোথায় ছিলেন? আওয়ামী লীগ নেতারাই তো শপথ নিয়েছিলেন নতুন মন্ত্রিসভায় এবং নানা কুৎসা রটনা করেছিলেন। তৎকালীন স্পীকার আবদুল মালেক উকিলের সেই মন্তব্যের কথা মনে নেই আপনাদের? যেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ফেরাউনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এবং লন্ডনে বসে যেখানে তার মৃত্যুভয় ছিল না। এখন সময় এসেছে, একে-ওকে অপবাদ না দিয়ে পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করার। এ পটভূমি দিতে হলো মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর সাম্প্রতিক গ্রন্থটি পড়ে। বার বার একতরফা অভিযুক্ত হওয়ার কারণে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি ইংরেজীতে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। শফিউল্লাহ জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার নাম। তিনি যখন বিদেশে ছিলেন তখন তাকে নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ‘বিষময় প্রচারণা’ চালানো হয়েছে যা কখনও চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। তিনি মনে করছেন এই রটনার সমাপ্তি হওয়া উচিত এবং প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছিল তা তিনি বর্ণনা করতে চান। সে জন্যই গ্রন্থটি রচিত। শফিউল্লাহ ভূমিকায় লিখেছেন, বাংলাদেশে কেউ ভাবেনি এমন ঘটনা ঘটতে পারে। বঙ্গবন্ধু নিজেও তা ভাবেননি। শফিউল্লাহ তাকে অনেকবার বলেছেন, ‘আপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুষ্ঠু নয়।’ তিনি বলতেন, ‘শফিউল্লাহ, চিন্তা কর না। বাঙালীরা আমাকে বা তোমাকে খুন করবে না।’ এ ছিল তার মানসিক শক্তি। শেষ নিশ্বাস ত্যাগের আগে তিনি নিশ্চয় বলেছেন শফিউল্লাহ বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি। কিন্তু যন্ত্রণায় জেনে গেছেন অনেকেই বিশ্বাস রক্ষা করেনি।’ [ও যধাব ঃযব পড়হারপঃরড়হ ঃযধঃ নবভড়ৎব ইধহমধনধহফযঁ নৎবধঃযবফ যরং ষধংঃ, যব ষবভঃ শহড়রিহম ঃযধঃ ঝধভরঁষষধয ফরফ হড়ঃ নবঃৎধু যরস. ইঁঃ যব সঁংঃ যধাব নৎবধঃযবফ যরং ষধংঃ রিঃয ঃযব ধমড়হু ড়ভ নবঃৎধুবফ নু ংড়সব.] মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর ভাষ্য আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, বিশ্বাস নাও করতে পারেন। কিন্তু তার ভাষ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই তার গ্রন্থটি পর্যালোচনা করছি এবং পর্যালোচনা করা উচিত। কেননা, অন্তিমে সেনাপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না পারার দায় তার ওপরই বর্তায়, তিনি দায়ী না হলেও। তিন. কেন ঘটল ১৫ আগস্ট, পটভূমিতে [অধ্যায়ে] তা বর্ণনা করেছেন শফিউল্লাহ। তার মতে, এটি নিছক কিছু অসন্তুষ্ট সেনা অফিসারের নিষ্ঠুর কাজ নয়, এর পেছনে ছিল ষড়যন্ত্র যা দেশের সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিল। আসলে ষড়যন্ত্রকারীদের কার্যসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল সেনাবাহিনীর সেই অংশ। পরিকল্পনাটি ক্ষমতা বলয়ের ভেতর থেকেই করা হয়েছিল যে কারণে তা নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে। খন্দকার মোশতাক ছিলেন ষড়যন্ত্রের হোতা। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী। তাকে সহায়তা করেছিলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষী। শফিউল্লাহর এই বক্তব্য অসত্য কিছু নয়। ষড়যন্ত্র হচ্ছিল এবং তা চিহ্নিত করার দায়িত্ব ছিল গোয়েন্দা সংস্থার। হয় তারা ব্যর্থ হয়েছে ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনে, নয় তারাও জড়িত ছিল এবং তারা যদি ষড়যন্ত্রের কথা জেনে থাকে তা হলে প্রথমেই তা জানানো উচিত ছিল সেনাপ্রধানকে। কিন্তু কখনই তা জানানো হয়নি। শফিউল্লাহ বলছেন, সেনাবাহিনী স্বাধীনতার পর একটি একক হিসেবে কাজ শুরু করলেও দুটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। এক. পাকিস্তান ফেরত সৈন্যদের [কর্মকর্তাসহ] বিনা স্ক্রুটিনিতে সেনাবাহিনীতে ফেরত নেয়া, দুই. অতিক্রান্ত কিন্তু অতিউচ্চাকাক্সক্ষী একজন যিনি সেনাপ্রধান হতে চেয়েছিলেন তাকে সেনাবাহিনীতে রাখা। এ দুটি সিদ্ধান্তই ভুল ছিল। কিন্তু সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাও নয়। শফিউল্লাহর এই পর্যবেক্ষণ সঠিক নয়, এমন বলা যাবে না। এ দুটি বিষয়ে তিনি পরে বিস্তারিত আলোচনা। তার প্রথম যুক্তি যা ঠিক, তা হলো, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ও তাকে রক্ষার দায়িত্ব সেনাপ্রধানের নয়। অন্যান্য এজেন্সি আছে যারা এ কাজটি করে বা দায়িত্ব তাদের এবং আজ পর্যন্ত কেউ জিজ্ঞেস করেনি, তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছিল কিনা। এ ছাড়া যারা সমালোচনা করেন তারা সেনা কাঠামো সম্পর্কে ঠিক জানেন না। সেনাপতি যুদ্ধ ও শান্তির সময় সেনাপ্রধান বটে কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে তিনি সেনা পরিচালনা করেন না [যব ফড়বং হড়ঃ পড়সসধহফ ঃযব ঃৎড়ড়ঢ়ং ফরৎবপঃষু]. তার অধস্তন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তিনি সেনা পরিচালনা করেন। ‘সেই দিন’, লিখেছেন শফিউল্লাহÑ ‘দুর্ভাগ্যবশত অধস্তন কর্মকর্তারা তাদের প্রধানের নির্দেশমতো বিদ্রোহীদের দমনে ব্যর্থ হয়েছেন।’ শফিউল্লাহর মতে, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল। তার ওপর ছিলেন খন্দকার মোশতাক যার ওপর বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল এবং এ সুযোগে তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, বিদেশী অনেক নেতা বার বার বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেনÑ তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। সেনাবাহিনীতে যে ক্ষোভ বিরাজ করছে তাও বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়েছিল। তিনি এসবে কর্ণপাত করেননি। শফিউল্লাহর ভাষায় ‘ওঃ রং ষবধংঃ ঃড় ংধু ঃযধঃ রহ ঃযরং ৎবমধৎফ যব ধিং সড়ংঃ ধঢ়ধঃযবঃরপ.’ সুতরাং সেনা ষড়যন্ত্র বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করা সমীচীন নয়। শফিউল্লাহর এ মন্তব্যও উড়িয়ে দেয়া যায় না। চলবে...
×