ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দীপ্তি ইসলাম

গা বাঁচিয়ে চলার সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৫ অক্টোবর ২০১৫

গা বাঁচিয়ে  চলার  সংস্কৃতি

মধ্যম চলে তফাতে, উত্তম চলে সবার সাথে- এই উক্তি দিয়ে ফ্ল্যাট সংস্কৃতির চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য শুরু করা যাক। ফ্ল্যাটে বসবাসকারী বাঙালী নাগরিকদের জীবনযাপন, প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। এই প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থার কারণেই মূলত ফ্ল্যাটভিত্তিক জীবনযাত্রা আজ ফ্ল্যাটের মধ্যে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফ্ল্যাটে বিছিয়ে রাখা ঝলমলে মখমলের গালিচার ভাঁজে ভাঁজে ঘাতকতা, চোখ ধাঁধানো দৃষ্টিনন্দন অসুস্থ জীবনধারা, ভীতির শিহরণে করুণার উদ্রেক বাড়ে। যার কারণে সুষমা সরলতার সমন্বয়ে আসে না জীবনের সর্বক্ষেত্রে পূর্ণতা। আজন্ম মানুষ হিসেবে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক এ দুটি জীবনের মুখোমুখি হয়ে চলতে হয়। দুটি ধারার এই জীবন একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অসম্পূর্ণ। দুটি জীবনের প্রতি আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আদর্শিক ও কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে সমাজ আজ পরিণত হয়েছে কেবল সৌজন্যতায়। লোপ পেয়েছে মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতা। মানুষ এড়িয়ে চলে সমাজকে। চালু হয়েছে এক ধরনের গা বাঁচিয়ে চলার সংস্কৃতি। তার মধ্যে সংযোজন হয়েছে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। এই ধারণাকে মনে পুষে, মানুষ পরিবারমুখী বা পরিবার নির্ভর জীবনে অধিক মাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। পারিবারিক জীবনে পরিবার পরিজনদের ভরণপোষণসহ নানা রকম চাহিদা মেটানোর মধ্যেই সকল দায়বদ্ধতাকে সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ করে ক্ষুদ্র পরিসরে অন্তর্মুখী জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তফাত করে চলা, বিভাজন করে চলাই মধ্যম ধাঁচের সামাজিক ফ্ল্যাটধারী সভ্য নাগরিকদের বৈশিষ্ট্য। ফ্ল্যাটধারী সভ্য নাগরিকরা রুটিনমাফিক শান্তি শৃঙ্খলা ও স্ব^াধীনতার মধ্যে অতিবাহিত করে দিব্যি ফাঁপা সুখী জীবন। চার পাশের ছাইপাস জঞ্জাল নিখুঁতভাবে পরিহার করে চলে আপন অজ্ঞতার অন্ধকারে। অধমের প্রতি ঘৃণার আবেগে মন থাকে পরিপাটি। চরিত্রে উদারতার চেয়ে কপট নীতিবোধের আধিক্যই প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এই পরিবারনির্ভর মানুষগুলো আজ সামাজিক সুশীল বা স্বতন্ত্র সামাজিক, অচল মুদ্রার মতো। নিজের শ্বাসে নিজেই রুদ্ধ হই। এই নব্য ফ্ল্যাট ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সামাজিক জীবনে তৈরি হচ্ছে মানুষে মানুষে প্রভু-ভৃত্যের অসম সম্পর্ক। তৈরি হচ্ছে ‘একলা চল’ নীতি। একলা চল, একলা বিরহ, কেউ নেই কারও পাশে, যেমন খুশি তেমন সাজো। স্কুলে, কলেজে জিপিএ-৫ এর মহামারী। জীবনের লক্ষ্য আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া চকচকে তকতকে জীবনের স্বাদ নেয়া। কৃত্রিম শহরে-আরামে-আয়েশের, সুখের-স্বস্তির বিলাসে গৃহকাতর গৃহিণীরা হিন্দী-সিরিয়াল, মার্কেটে-শপিংয়ে আত্মহারা। ফলে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ব্যবস্থায় চলছে গভীর আদর্শিক/মূল্যবোধ সংকট। এই কথিত আদর্শবানেরা ইংলিশ প্যান্টের পকেটে রাখে ধর্মের বাণী আর বিনয়ী মুখচ্ছবি। এদের কৈশর, যৌবন এবং বার্ধক্য দেখে মনে হয়Ñ নির্বোধ বালক, অন্তঃসারশূন্য মোড়ল। মানবতা তাদের কাছে নিছক রসিকতা, কথার কথা। এদের দেখলে মনে হয় মৃত্যুপরবর্তী ভীতি আর পার্থিব সমৃদ্ধিতে আক্রান্ত উন্মাদ। দিবারাত্রি জীবিকার জন্য ফন্দি ফিকিরÑ যেখানে নেই জীবনের অবসর। আমাদের বাস্তবতার এ এক বেদনাদায়ক দুর্যোগ। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে সেবার মানসিকতা ও জ্ঞানার্জনের পিপাসা নিয়ে। সেবার মানসিকতা ও জ্ঞানার্জনের পিপাসা নিয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করতে হবে আজকের প্রজন্মকে। অনাগত প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে হবে মানবিক, প্রগতিশীল, বিজ্ঞান ও সাহিত্যমনস্ক সৃজনশীল সুস্থ ধারার পরিবেশ। ঢাকা থেকে
×