ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ কামালের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৫ আগস্ট ২০১৫

শেখ কামালের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ভোর সাড়ে ৫টা হবে। আমার চাচা আবদুর রশীদ (ব্যাংকার) প্রতিদিনের মতো ঘুম থেকে ওঠে ফজরের নামাজ পড়ে অভ্যাসবশত রেডিও শুনছিলেন। হঠাৎ দৌড়ে এসে আমাদের দরজায় আঘাত করলেন। বললেন, ওঠ ওঠ শুনে যা। তার ঘরে গিয়ে শোনলাম রেডিওতে বলছে ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ কোন একজন ডালিমের কণ্ঠ- ‘সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে।’ এতবড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটানোর পর বিশ্বটাই যেন তাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। রেডিও বন্ধ করে নিজ ঘরে এসে নির্বাক বসে রইলাম। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, কি করে সম্ভব? হিমালয়সম উচ্চতায় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে কেউ হত্যা করতে পারে- এ বিশ্বাস না করাই তো স্বাভাবিক। যে মানুষ জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে বাঙালীর স্বাধীনতা এনে দিলেন, নিজস্ব স্বাধীন ভূমি দিলেন, আপন জাতীয় পতাকা এনে দিলেন, জাতীয় সঙ্গীত দিলেন অর্থাৎ বাঙালীর আপন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিলেন, তাঁকে কোন বঙ্গসন্তান হত্যা করতে পারেÑ বিশ্বাস হচ্ছিল না। হয়ত ভিনদেশী কোন ঘাতক হবে। আবার রেডিও শোনলাম, না, এ ভ্রম নয়, ঘাতকরা বাঙালী সেনাই। মনে পড়ল মীরজাফর, রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ ওরাও তো এ মাটিরই সন্তান ছিল। আগের রাতে বেশ দেরি করে ইত্তেফাক থেকে বাসায় ফিরেছিলাম। নারিন্দার বাসায়। দেরি করে বাসায় ফেরার কারণ মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের ক্যাম্পাসে ছিলাম। পরদিন বঙ্গবন্ধু ক্যাম্পাসে আসবেন। সর্বত্র সাজ সাজ রব। দেখলাম ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে বরণ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদিন বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়েছিল, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু আসছেন। সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়ে বেরিয়ে আসা এবং দৈনিক ইত্তেফাকের তরুণ রিপোর্টার হিসেবে আমার নিজের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের (এলএলবি) ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ইন্টারমিডিয়েট এবং বিএ পাস করেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে। সে বছরই ভারত ভাগ হলে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আইনে স্নাতকোত্তর ক্লাসে ভর্তি হন। যাঁর রক্তে রাজনীতি তিনি কি এ থেকে দূরে থাকতে পারেন? প্রথমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন এবং সেই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে আসে তাঁর হাতেই। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর জীবনী আলোচনা করলে দেখা যাবে তিনি সারাজীবন নেতৃত্ব দিয়েছেন। সে যাই হোক, ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক। গ্রেফতারের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাব দেয় বঙ্গবন্ধু যদি মুচলেকা দেয় আর রাজনীতি করবেন না বলে তাহলে কিছু জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরও কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছিলেন, তারা মুচলেকা দিয়ে এবং ১৫ টাকা করে জরিমানা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুচলেকাও দিলেন না, জরিমানা তো নয়ই, যে কারণে তার ছাত্রত্ব কেড়ে নেয়া হয়। সেই কারাগারে বসেই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আজ কেউ কেউ নামের শেষে আপোসহীন শব্দ জুড়ে; কিন্তু আপোসহীন কাকে বলে? এর মানে কী? তা তারা সম্ভবত জানেনই না। কাকের ময়ূরপুচ্ছ গোঁজার মতো বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের দু’একটি বৈশিষ্ট্য নিজের কপালে সেঁটে ময়ূর হতে চান? কিন্তু ডাকটা বদলাতে পারেন না, কণ্ঠস্বর কর্কশই থেকে যায়। রেডিও শোনার পর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাব, কী আমার লক্ষ্য, কিছুই ঠিক না করে একটা রিক্সায় ওঠে বললাম ৩২ নম্বর চল। রিক্সা চলতে শুরু করল। রিক্সা চলছে, মনে হলো যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আনন্দঘন দিনগুলো একটার পর একটা চোখের সামনে দিয়ে ভেসে চলেছে। এক সময় সামনে ভেসে এলো এক তরুণের মুখচ্ছবিÑ উজ্জ্বল, টলমলে শ্যামলা গায়ের রং, ঘন কালো ব্যাকব্রাশ করা চুল, মোটা গোঁফ, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, মেদহীন পাতলা শরীর, বাবার (বঙ্গবন্ধু) মতো না হলেও আর দশটি তরুণের চেয়ে আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারীÑ শেখ কামাল। তবে কি ওকেও ঘাতকরা হত্যা করেছে? সবাইকে যখন হত্যা করেছে তখন সেও নিশ্চয়ই নিহত হয়েছে। মনে পড়ল কয়েক ঘণ্টা আগে অর্থাৎ আগের রাত ১১টার দিকেও তাকে দেখেছি ক্যাম্পাসে তদারকি করতে। কী প্রাণোচ্ছল একটি তরুণ, যে মেধাবী, উদ্যমী, কঠোর পরিশ্রমী, দক্ষ সংগঠক এবং সৃষ্টিশীল। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর এতবড় ক্ষমতার ছত্রছায়া অর্থাৎ পিতার রাষ্ট্রক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তরুণ কেবল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্য হয়েছেন। অথচ ইচ্ছে করলে বড় কোন পদ দখল করতে পারতেন। করেননি। এটাই ছিল তার পরিবারের শিক্ষা, কালচার। একটা কথা মনে পড়ছে, সম্ভবত ১৯৭৪। লাইব্রেরির পেছনে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন। ভদ্রলোক টিপিক্যাল ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন। আমরা তার ওখানে চা-সিঙ্গাড়া খেতাম। একদিন ঢুকে দেখি ছালার চট পরা কবি সাবদার সিদ্দিকীও চা খাচ্ছে। আমাকে সে চিনত, আমিও তাকে চিনতাম; কারণ কবি নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান, সেলিম আল-দীন, আখতারুন্নবীদের (কবি ও লেখক) সঙ্গে আমার সখ্য ছিল। একপর্যায়ে সাবদার সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার সম্পর্কে খুব আপত্তিকর কিছু মন্তব্য করল। তাকিয়ে দেখলাম ছাত্রলীগের কিছু কর্মী কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছে। আমি প্রমাদ গুনলাম, সঙ্গে সঙ্গে বললাম, সাবদার তোমার কথাটি উইথড্র কর। সে করল না, তখন আমি ওর হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় আমার চেনা এক ছাত্রলীগ কর্মী দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, শফিক ভাই, ওকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। ও নাকি গাঁজা খায়, ওকে ভাল করে গাঁজা খাওয়াব। আমি ওকে নিয়ে লাইব্রেরির পূর্ব পাশে এসে একটা রিক্সা ডাকলাম এবং হাতে ১০টা টাকা দিয়ে বললাম, এই পথে চলে যাও, আজ আর ক্যাম্পাসে এসো না। এই বলে আমি কলাভবনের দিকে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর কবি রফিক আজাদ ও কবি মহাদেব সাহা এসে বললেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা সাবদারকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি তাদের সঙ্গে যেতে যেতে দেখলাম শেখ কামাল কলাভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদল ছাত্রলীগ কর্মীর সঙ্গে কথা বলছে। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি এলো, কাছে গিয়ে কামালকে ঘটনাটা বললাম। উত্তরে সে বলল, শফিক ভাই আপনিও চলুন। এই বলে শরীফের ক্যান্টিনের কাছে যেখানে সাবদারকে ঘিরে আছে একদল তরুণ। সাবদারকে আমি রিক্সায় তুলে দিয়েছিলাম কিন্তু যায়নি, ফিরে আসে শরীফের ক্যান্টিনে। কামাল সরাসরি ওদের ভিড় থেকে সাবদারকে হাত ধরে বের করে নিয়ে এলো এবং ওকে গাড়ির (টয়োটা) পেছনে এবং আমাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে বলল, কোথায় যাবেন? বললাম প্রেসক্লাবে নামিয়ে দাও। কামাল তা-ই করল। গাড়ি থেকে নামিয়ে সাবদারের হাতে একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলল, দু’তিন দিন আর ক্যাম্পাসে যাবেন না। নোটটা ভাল করে দেখিনি, পঞ্চাশও হতে পারে, এক শ’ও হতে পারে। টাকাটা হাতে দিয়ে বলল, এত সুন্দর কবিতা লেখেন, গাঁজা খান কেন? ছাত্রলীগ কর্মীদের ভিড় থেকে যখন সাবদারকে বের করে আনছিল তখন কামাল বলছিল, কবিরা অনেক দ্ব্যর্থবোধক অর্থে কথা বলে কিন্তু তারা আমাদের কবিতা উপহার দেয়। তাছাড়া একজন কবি কি বললেন না বললেন তাতে বঙ্গবন্ধু ছোট হয়ে যাবেন না। এই শেখ কামালকেও মিলিটারি ঘাতকের দল মেরে ফেলল। রিক্সায় বসে কথাটিও বার বার মনে পড়ছিল। ক্যাম্পাস জীবনটা বারবার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল। সেই কবে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স নিয়ে স্নাতক প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়েছিলাম, মনে হয়েছিল এই মাটির পৃথিবীতে আমার মতো ভাগ্যবান বঙ্গসন্তান বুঝি আর কেউ নেই। এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। সেই ১৯৬৭ সাল। জায়গা হলো হাজী মুহম্মদ মহসিন হলে। প্রথম আবাসিক ছাত্র। পাড়াগাঁর এক মধ্যবিত্ত পরিবেশ থেকে ওঠে এসে অভিজাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে আবাস, নিজেকেই দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসিন ভাবতে শুরু করলাম। এ এক অন্যরকম সুখের সময়। ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব, হলে থাকব, ক্লাস শেষে মধুর ক্যান্টিন, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে চা খাব, হলোও তাই। বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সময়টাতে ছেলেবেলার স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিল। ক্যাম্পাস তখন ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে। সময়-অসময় নেই, যখন-তখন মিছিল হচ্ছেÑ ‘জেলের তালা ভাঙ্গব, শেখ মুজিবকে আনব’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’ কোন মিছিলে শেখ হাসিনা, কোন্্টাতে শেখ কামাল। সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের মতোই দারুণ হ্যান্ডসাম বাঙালী সবচেয়ে সাহসী তরুণ লিডার শেখ মুজিবুর রহমান ছেষট্টির ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সর্বদলীয় শীর্ষ বৈঠকে তার ৬ দফা পেশ করলেন। অল্পদিনেই ৬ দফা বাঙালীর মুক্তিসনদে পরিণত হলো। পাকিস্তানী মিলিটারি স্বৈরশাসক আইয়ুব খাঁর ভিত কেঁপে ওঠল। ভীত আইয়ুব শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করল এবং তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তথা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনল, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। শেখ মুজিবের পাশাপাশি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ গুরুত্বপূর্ণ অন্যসব কেন্দ্রীয় নেতাকেও গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হলো। প্রতিবাদে ফেটে পড়ল ছাত্রসমাজ, গোটা দেশবাসী। জনগণ ৬ দফাকে তাদের মুক্তিসনদ হিসেবে মনের মধ্যে ঠাঁই দিল। ছাত্রসমাজ সংগঠিত হয়ে ৬ দফার ভিত্তিতে ১১ দফা রচনা করে আন্দোলনের গতি সঞ্চারিত করল। তখন আমরা যেমন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, শামসুজ্জোহা, আবদুর রউফ, খালেদ মুহম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনকে নেতা হিসেবে পেয়েছিলাম, তেমনি ক্লাসে পেলাম কবি নির্মলেন্দু গুণ, নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল-দীন, নূহ-উল আলম লেলিন এবং আরেকজন শেখ হাসিনা। বড় বোনের সহপাঠী হিসেবে শেখ কামালকে দেখেছি দারুণ স্মার্ট অথচ আদব-কায়দাসম্পন্ন এক তরুণ হিসেবে। স্বাধীনতার পর প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীরা যেভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের কুৎসা রটাচ্ছিল ঠিক একইভাবে শেখ কামাল সম্পর্কেও যা তা বানোয়াট কাহিনী প্রচার করছিল। তৎকালীন জাসদের মুখপাত্র ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকা বা ভাসানী ন্যাপের ‘হক কথা’ এক্ষেত্রে জঘন্য ভূমিকা পালন করে। আমি কাজ করতাম ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায়। তাতে নিউজ সেকশনের সতর্কতায়, বিশেষ করে মরহুম আসাফ-উদ-দৌলা বা রেজা ভাইয়ের নেতৃত্বের কারণে হার্ড নিউজে গণ্ডগোল করার সুযোগ না থাকলেও সম্পাদকীয় পাতায় খন্দকার আবদুল হামিদ, আবুল মনসুর আহমদরা গণকণ্ঠের ভূমিকা পালন করেছে। শেখ কামালের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করা হয়েছিল ‘ও নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকে ডাকাতি (?) করেছে।’ এ যে কতবড় মিথ্যা তার প্রমাণ হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বোল্ট কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে ভাঙ্গা সম্ভব নয়। বোমা ফাটিয়েও নয়। তাছাড়া শেখ কামাল যে কেবল রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের ছেলে তা তো নয়, সে বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মদাতা পিতার সন্তান, তার অর্থের প্রয়োজন পড়লে কি ব্যাংক ডাকাতি করতে হয়? অথচ একশ্রেণীর মতলববাজ বা গর্দভ মানুষ তা বিশ্বাস করেছে, মুখে মুখে প্রচার করেছে। কিন্তু বিশাল হৃদয়ের বঙ্গবন্ধু এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। শেখ কামাল যে কত বড়মাপের তরুণ ছিলেন তার কয়েকটি উদাহরণ দিতে হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনে পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের একটি উপদেশ সর্বক্ষণ কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেনÑ ‘১৯৪২ সালে রিলিফের কাজ করছিলেন। আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ, এটা তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখÑ ঝরহপবৎবষু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ধহফ যড়হবংঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব থাকলে জীবনে পরাজিত হবে না। এ কথা কোনদিন আমি ভুলি নাই।’ বঙ্গবন্ধু যেমন কথাটি ভুলেননি তেমনি সন্তানদেরও একই শিক্ষা দিয়ে গেছেন, যা আমরা শেখ কামালের মধ্যে যেমন দেখেছি, তেমনি দেখছি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যেও। যে কারণে দেশের এক নম্বর ক্ষমতাধর পরিবারের সন্তান হয়েও শেখ কামাল ব্যবসায় নামেনি, হাওয়া ভবন-খোয়ার ভবন-ডান্ডি ডায়িং-কোকো ওয়ান টু গড়ে তোলেননি, বরং লেখাপড়া করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি যেমন করেছে (ছাত্রলীগ), তেমনি আবাহনী ক্রীড়াচক্র, স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী, ঢাকা থিয়েটার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। যেগুলো আজ এত বছর পরও আধুনিক স্পোর্টস, সঙ্গীত এবং নাট্যাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। এ কৃতজ্ঞতা অন্য কেউ স্বীকার করুক বা না করুন, আমরা যারা তাকে দেখেছি তারা কোনদিন ভুলব না। তাই এবারের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশেষ করে শেখ কামালের প্রতি আমার অন্তহীন শ্রদ্ধাঞ্জলি। ঢাকা, ১৪ আগস্ট ২০১৫ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
×