ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

যাত্রানট মিলন কান্তি দে’র আবৃত্তিসন্ধ্যায় মুগ্ধ দর্শক

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১১ জুন ২০১৫

যাত্রানট মিলন কান্তি দে’র আবৃত্তিসন্ধ্যায় মুগ্ধ দর্শক

সাজু আহমেদ ॥ আবৃত্তির আবেদন হলো মন-প্রাণের বিকাশ। শুধু শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে নয় যে কোন সৃষ্টি এবং শুদ্ধতার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে পরম প্রার্থনার বিকল্প নেই। আবৃত্তি হচ্ছে অন্যতম প্রার্থনা। মূলত, কবিতা হচ্ছে একজন কবির সৃষ্টিশীল বৈচিত্র্যতা ও শিল্পভাবনার অনবদ্য বহির্প্রকাশ। কবি তার কাব্যময়তাকে আবৃত্তিকার শৈল্পিক বাকশৈলীতে ফুটিয়ে তোলেন। সব চেয়ে বড় এবং সত্য কথা কবিতা ও আবৃত্তি হচ্ছে সুন্দরের প্রকাশ এবং সকল অশুভকে মোকাবেলার শাণিত হাতিয়ার। এমন বিশ্বাসকে অভিজ্ঞতার নিরিখে বাস্তবে প্রমাণ করলেন দেশ বরেণ্য যাত্রানট মিলন কান্তি দে। দীর্ঘ ৫০ বছরের অভিনয় জীবনের তিল তিল সঞ্চারিত অভিজ্ঞতার প্রায় সবটুকুই ঢেলে দিলেন শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে একক আবৃত্তি সন্ধ্যায়। সব চেয়ে অবাক করা বিষয় ১৫ জন জনপ্রিয় কবির অন্তত ১৬০০ লাইন টানা মুখস্থ আবৃত্তি করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের অনেকটাই চমকে দিলেন মিলনকান্তি দে। যা রীতিমতো উপভোগকারীদেরও হতবাক করেছে। পরিচ্ছন্ন উচ্চারণ, শাব্দিক গভিরতা, প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি এমনকি কাব্যিক শিল্পঢংয়ে মিলনায়তনপূর্ণ দর্শকদের বাচিকশিল্পের নান্দনিকতায় অভিভূত করে তোলেন মিলনকান্তি দে। মিলনকান্তি দে এমনই একজন যাত্রানট যিনি গতানুগতিক প্রমোট করা যাত্রা প্রদর্শনীতে অবলীলায় মুখস্থ বলে যান বড় বড় সংলাপ। সে কারণেই সম্ভবত এই কর্মটি তার জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়েছে । কবিতা আবৃত্তির সময় উপস্থিত দর্শকরা মোহিত ও বিমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন তার গুরুগম্ভির উচ্চারণ, কথার উঠানামা এবং ছান্দিক অভিনয়। দর্শকরা শুধু মুগ্ধই হলেন না মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি তারা। মজার বিষয় আবৃত্তির সময় মনেই হয়নি তিনি আবৃত্তি শিল্পী নন। তার উচ্চারণে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে শব্দ নিয়ে খেলা করতে হয়। কিভাবে কবির কথামালার জাদুতে ইমোশন আর ইল্যুশন তৈরির মাধ্যমে দর্শকদের একনিষ্ঠভাবে প্রতিটি শব্দে মনোনিবেশ করা যায়। যাত্রানট মিলন কান্তি দে’র এই একক আবৃত্তি সন্ধ্যার আয়োজনটি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি মাইলফলক বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন উপস্থিত নাট্যজনরা। অন্তত নাট্যকর্মীদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত বলে মনে করেন উপস্থিত দর্শক শ্রোতারা। অনুষ্ঠানে মিলন কান্তি দে দীর্ঘ ১৫টি কবিতা মুখস্থ আবৃত্তি করেন। শুরুতেই তার দরাজকণ্ঠে প্রকম্পিত হয় মহাকবি মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম স্বর্গ। এরপর একে একে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, ’দেবতার গ্রাস’, ‘সামান্য ক্ষতি’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী, ’মানুষ’, ’খেয়াপাড়ের তরণী’, জীবনানন্দ দাসের ’রূপসী বাংলা’, ’বনলতা সেন’, সুকান্ত ভট্টাচার্যের ’ছাড়পত্র’, ’উদ্যোগ’, শামসুর রাহমানের ‘অভিশাপ দিচ্ছি’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’, ‘নুরুলদিনের সারা জীবন’, কাব্যনাট্যের প্রস্তাবনা- ‘নীলক্ষা আকাশ নীল’ এবং নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। তার অবাক করা উচ্চারণে প্রতিটি কবিতার প্রতিটি লাইন যেন নতুন করে গ্রথিত হলো উপস্থিত দর্শকদের মনে। একক আবৃত্তি সন্ধ্যার উপস্থিত ছিলেন দেশ বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, এ রকম মুখস্থ আবৃত্তি এবং কণ্ঠের কারুকাজ দেখে আমি অভিভূত। আবৃত্তিতে তার ছন্দ এবং কণ্ঠের ওাঠানামা ভাব এবং আবৃত্তির মধ্যে তার অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ। আমার মনে হয় নাট্যকর্মীদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আমি মিলন দা’র নির্দেশনা এবং যাত্রাভিনয়ের পাশাপাশি তার আবৃত্তি বিষয়ে অবগত আছি। তিনি যে কোন কাজ নিয়ে দর্শকদের চমকে দেন। যা কোন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর পক্ষেও কোন কোন সময় সম্ভব হয় না। তার আবৃত্তি উপস্থাপনায় আমি চমৎকৃত হয়েছি। এ আয়োজনটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ আয়োজন প্রসঙ্গে মিলনকান্তি দে বলেন, আয়োজনে আমি দর্শকদের ব্যাপক সারা পেয়েছি। বিশেষ করে নাট্যজনদের প্রতিক্রিয়ার পর আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
×