ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাস্তবায়ন হচ্ছে না প্রশাসনের সিদ্ধান্ত

চাঁপাইয়ে ‘ঢলন’ প্রথা বহাল, কমিশনে ‘না’ প্রান্তিক আম চাষিদের

জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

প্রকাশিত: ২২:৩২, ১৩ জুন ২০২৫

চাঁপাইয়ে ‘ঢলন’ প্রথা বহাল, কমিশনে ‘না’ প্রান্তিক আম চাষিদের

.

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট আম বাজারের আড়তগুলোতে আমের মণ ৪০ কেজির বদলে ধরা হতো ৪৫ কেজিতে। শুধু আম নয়, কাঁচামালের সকল পণ্যে এমন ঢলন প্রথা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের এ চিরাচরিত ‘ঢলন’ প্রথায় ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি মণে নেওয়া হতো ৪৫ কেজি করে। এরপর ২০১৬ সালে ডিজিটাল স্কেল চালু করার পর তা এক কেজি বেড়ে হয় ৪৬ কেজি। তখন এ নিয়ে কথা উঠলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যদিও তা বস্তবায়ন হয়নি। ২০১৮ সালে আবারও ওজন সংক্রান্ত সমস্যা হওয়ায় আড়তদাররা ৫ দিন আম কেনা বন্ধ করেন। তারপর ৪৮ কেজিতে মণ দিয়ে এর সমাধান হয়। ২০২০ সালে প্রশাসন ৪০ কেজিতে মণ চালু করলে আড়তদাররা তা ৪৮ থেকে ৫০ কেজিতে নিয়ে যান। ২০২৩ সালে আরও দুই কেজি বেড়ে গিয়ে ৫২ কেজিতে মণ নেওয়া শুরু করে আড়তদাররা। ২০২৪ সালে আম মৌসুমের শেষদিকে কোনো কোনো আমে তা আরও দুই কেজি বেড়ে গিয়ে তা দাঁড়ায় ৫৪ কেজিতে। যদিও জেলার রহনপুর আম বাজার এবং ভোলাহাটের আম বাজারে আমের মণ ৫৫-৫৬ কেজিতে নেওয়া হয় বলে জানা যায়।
একদিকে, কাঁচামালের চিরাচরিত ঢলন প্রথা বাতিলের দাবি। অন্যদিকে, আড়তদারদের ৫২-৫৪ কেজিতে আমের মণ নিয়ে শুরু হওয়া উদ্ভূত পরিস্থিতে ৫ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আলোচনায় কেজি দরে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত হয়। এর তিনদিন পরই আড়তদাররা কেজিপ্রতি ৩ টাকা কমিশন দাবি করেন। এতে সৃষ্টি হয় আরেক জটিলতা। এরপর ১১ জুন আবারও জেলার চাষি, ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের নিয়ে আয়োজিত বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে ঢলন প্রথা বাদ দিয়ে কেজিপ্রতি দেড় টাকা বা এক মণ আমে ৬০ টাকা কমিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।  কিন্তু পরদিন বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় কানসাট আম বাজার ঘুরে দেখা যায়, সবই চলছে আগের মতো। এখনো ঢলন অনুযায়ী আম বিক্রি হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে ৫২-৫৪ কেজি মণ হিসাব ধরে।
আড়তদাররা নিচ্ছেন, চাষিরাও দিচ্ছেন ॥ কানসাট আম বাজারে সৈয়দ আলী নামে এক আড়তদাররা বলেন, আমরা তো কমিশনে কেজি দরেই আম নিতে চাইছি কিন্ত চাষিরা নিজ থেকেই ৫২-৫৪ কেজি হিসেবে আম দিয়ে যাচ্ছেন। এতে আমাদের তো কিছু করার নেই।  চাষিরা বলছেন, কেজি দরে আম নিতে আড়তদাররা হিসেবে কারচুপি করছেন, তাই কেজি দরেই আম দিচ্ছি। আড়তদারদের হিসেবে কারচুপি সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্যামপুর এলাকার আম চাষি ইউসুফ আলী এ প্রতিবেদককে খাতা-কলমে বোঝান বিষয়টি। তিনি জানান, কিভাবে কেজি দরে কমিশন হিসেবে ঠকছেন চাষিরা।
ইউসুফ বলেন, ধরেন আমের মণ ২,০০০ করে। এখানে কেজি দরে বিক্রি করলে আড়তদাররা ২,০০০ কে ৫৪ দিয়ে ভাগ করে আম নিচ্ছেন ৩৭ টাকা করে। সে হিসেবে ৪০ কেজি আমের মূল্য হচ্ছে ১,৪৮০ টাকা। এখান থেকে আবার কমিশন কেটে নিচ্ছেন ১.৫ টাকা হারে মোট ৬০ টাকা। সে হিসেবে কেজি দরে এক মণ আমের দাম পড়ছে ১,৪২০ টাকা।   
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, যে হিসেবেই যাবেন চাষিরা সেদিকেই ঠঁকে আসছে। ঢালাওভাবে ঢলন প্রথা বাতিলের বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না, এসব নিয়ে আন্দোলনকারী-আড়তদারদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট রয়েছে বলেন দাবি তার। চাষিদের বাঁচাতে প্রকৃত চাষিদের নিয়ে তিনি কানসাটে একটি ‘আম চাষি সমিতি’ গঠনেরও দাবি করেন শ্যামপুরের ইউসুফ আলী।  আরেক আম চাষি কয়লা দিয়ারের গোলাম মোস্তফা জানান, আমি ৭ মণ খিরসাপাত আম নিয়ে এসেছিলাম। কেজিতে বিক্রি আরও লস, তাই ৫৪ কেজিতে দিয়ে এলাম। দাম পেয়েছি ২,৮০০ টাকা করে।
উমরপুর এলাকার আম চাষি সোহেল আহমেদ রাগান্বিত স্বরে বলেন, আমার উৎপাদিত পণ্য ‘মণ’ নাকি ‘কেজি’ দরে বিক্রি করবো, তা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। যে হিসেবে আমি লাভবান হবো সে হিসেবেই আমি বিক্রি করব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চিরাচরিত প্রথায় প্রশাসনকে জড়িত করা ভুল সিদ্ধান্ত। কেননা, প্রশাসন ৪০ কেজির বাইরে যেতে পারবে না। আম ৪৫ কেজিতে মণ হওয়া সবচেয়ে উত্তম বলে মনে করে এ ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, আমের ওজন নির্ধারণ করার সময় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খিরসাপাত আম রপ্তানিকারক হিসেবে তালিকাভুক্ত এক আম ব্যবসায়ী ঢালাওভাবে ঢলন প্রথা বাতিলের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমের মণ নাকি কেজি-কমিশন ? এমন জটিলতার জন্য তিনি সরাসরি দায়ী করেন ঢলন প্রথা বাতিলের পক্ষে জড়িত কয়েকজনকে। তিনি বলেন, এদের সঙ্গে এমন কয়েকজন আছেন যারা বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি অনুদান নেওয়ার জন্য আম নেতা সেজেছেন। ঢালাওভাবে ঢলন প্রথা বাতিলের পক্ষে জড়িত কয়েকজনকে তিনি প্রান্তিক আম চাষিদের জন্য ক্ষতিকারক বলে উল্লেখ্য করেন।
বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মোবারকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদ হায়দারি। তিনিও বলেন, কাঁচামাল ব্যবসায় ‘৪০ কেজিতে মণ’ বাস্তবায়ন করা দূরহ। ৪৫ কেজির পক্ষেও তিনি। কেন সেখানে ৪৫ কেজির পক্ষে মত দেননি প্রশ্ন করলে তিনি জানান, অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু কয়েকজনকে বোঝাতে পারিনি বলেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে। তবে এখানে প্রশাসনের কোনো দোষ নেই, প্রশাসনতো আইনের বাইরে যেতে পারবে না।  
শিবগঞ্জ উপজেলা আম আড়তদার সমিতির সভাপতি আবু তালেব। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিষয়টি নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি ভোলাহাটে আছেন বলে জানান এবং প্রথমে এ বিষয়ে তথ্য দিতে রাজি হননি। পরে সন্ধ্যায় তার অফিসে সরাসরি উপস্থিত হয়ে তথ্য নিতে বলেন। সন্ধ্যায় তার বক্তব্য নিতে কানসাটে উপস্থিত হলে তিনি তখনো ভোলাহাটে আছে বলে জানান। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শুক্রবার বিকেলে দেখা করার জন্য আবারও সময় দেন তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব ও আমে ঢলন প্রথা বাতিলের দাবিতে নেতৃত্ব দেওয়া আহসান হাবিব জানান, কেজি হিসেবে কমিশনে আম বিক্রয়কে স্বাগত জানাচ্ছি। তিনি বলেন, মণপ্রতি অতিরিক্ত আম নেওয়ায় চাষিদের বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশাররফ হোসেন জানান, আম সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি আমি গণমাধ্যমে প্রথম জানতে পেরেছি। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজাহার আলী বলেন, ৪০ কেজিতে মণ এবং কেজিপ্রতি দেড় টাকা কমিশনের বাইরে যাওয়া যাবে না। এ সিদ্ধান্ত সব জেলায় কার্যকর করা হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরফ উদ্দিন বলেন, আমের ওজন নিয়ে অরাজকতা অনেকদিন আগে থেকেই বিরাজমান। এটি সমাধানের জন্য সকলেই চাচ্ছিলেন প্রশাসনের উদ্যোগ। ইতোমধ্যে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আম সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তবে, এতে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে এখনো জটিলতা রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আম অত্যন্ত পচনশীল ফল এবং যার ওজন প্রতিদিন কমতে থাকে। জাতভেদে প্রতিদিন ৪০ কেজি আমে এক থেকে দেড় কেজি ওজন কমে যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমলে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বিক্রেতা, ভোক্তা, আড়তদার সকলের জন্যই মঙ্গলজনক হত। ওজন কমে যাওয়া ও পচনশীলতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ৪২ থেকে ৪৫ কেজিতে মণ নির্ধারণ করলে তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন সহজ হতো বলেও মনে করেন ড. শরফ উদ্দিন।

প্যানেল

×