
কুড়িগ্রাম সদরে ধরলা সেতুর পূর্বপাড়ে ধরলা নদীর তীরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের জায়গায় ‘বিনোদন পার্ক’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই পার্কের জন্য নির্ধারিত স্থানে বালু ভরাটের কাজ শুরু করা হয়েছে। পার্ক নির্মাণের উদ্যোগকে অনেকে স্বাগত জানালেও এর নামকরণ নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে ধরলা সেতুর পূর্বপাড়ে মাধবরাম মৌজায় কুড়িগ্রাম–ভূরুঙ্গামারী সড়কঘেঁষে সওজের প্রায় ৩০ একর জমি রয়েছে। স্থানটির পূর্বপ্রান্তে রয়েছে ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত এলাকা। এর সাথেই ধরলা সেতুর গ্রোয়েন বাঁধ। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব ও ছুটিতে এই জায়গায় বিনোদনপ্রেমীরা ভিড় করেন। জেলাবাসীর কাছে স্থানটি ‘ধরলা বাঁধ’ নামেই পরিচিত।
সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) নুসরাত সুলতানা সওজের ওই জমির ১৬ একর জায়গায় ‘বিনোদন পার্ক’-এর নামে ‘ডিসি পার্ক’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। স্থানীয়রা পার্ক নির্মাণের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও এর নামকরণ ও প্রকল্পের পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এছাড়া, সওজের জমি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরের আগেই সেখানে কাজ শুরু করায় এর আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পার্কের নামকরণ নিয়ে চলতি বছরের ২০ এপ্রিল একটি রেজ্যুলেশন স্বাক্ষর করেন ডিসি নুসরাত সুলতানা। রেজ্যুলেশনে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম বেবুকে এই নামের প্রস্তাবকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রেজ্যুলেশনে বলা হয়েছে, জেলার মানুষের বিনোদনের জন্য কোনো স্থান নেই—এমন যুক্তিতে পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে সীমানা প্রাচীরসহ মিনি চিড়িয়াখানা, রেস্তোরাঁ, পিকনিক স্পট, নামাজ ঘর, শিশু কর্নার, ফলজ ও বনজ গাছের বাগান স্থাপন করা হবে। গাছগুলো ইজারা দিয়ে প্রাপ্ত অর্থে পার্কে নিযুক্ত জনবলের খরচ চালানো হবে। এছাড়া, পার্কে দোকান ঘর নির্মাণ করে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
তবে সরকারি জমিতে সরকারি অর্থ ব্যয়ে পার্ক নির্মাণ করে এর নাম ‘ডিসি পার্ক’ রাখা নিয়ে জেলার অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন এবং আপত্তি জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনা চলছে। স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, ধরলা নদী কুড়িগ্রাম জেলার ঐতিহ্য। এ নদীর তীরে পার্ক নির্মাণ করে ‘ডিসি পার্ক’ নাম রাখা অনুচিত। তারা এর নাম ‘ধরলা পার্ক’ কিংবা ‘কুড়িগ্রাম পার্ক’ রাখার দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে, জেলা প্রশাসকের বাসভবনের ঠিক পেছনে রয়েছে একটি পরিত্যক্ত শিশু পার্ক এবং শহরের ডায়াবেটিক হাসপাতালসংলগ্ন স্থানে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত জেলা পরিষদ শিশু পার্ক এখনো চালু হয়নি। নতুন করে বড় বরাদ্দে আরেকটি পার্ক নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এর পেছনে ইজারা বাণিজ্যের মাধ্যমে জনগণের পকেট কাটার উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
কুড়িগ্রাম সদরের বাসিন্দা নারী উদ্যোক্তা ওয়াহিদা আফরিন বলেন, ‘ধরলা তীরে পার্কের নাম “ডিসি পার্ক” হবে কেন? জেলার সচেতন নাগরিকরা এ নামের বিরুদ্ধে। যারা এই নামকরণে ডিসিকে ইন্ধন দিচ্ছেন, তারা হয়তো কোনো সুবিধা নিচ্ছেন। পার্কের নাম হওয়া উচিত “ধরলা পার্ক” বা “কুড়িগ্রাম পার্ক”। এটা জেলার ঐতিহ্য রক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’
জেলা বারের আইনজীবী আবু সাঈদ শিথীল বলেন, ‘পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে ধরলা যেহেতু কুড়িগ্রামের ব্র্যান্ড, তাই এর নাম “ধরলা পার্ক” করা হোক।’
এনসিপি জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী রাশেদুজ্জামান তাওহীদ বলেন,
‘ডিসি কোনো নাম নয়, এটি একটি পদবি। এটি পার্কের নাম হতে পারে না। সরকারি টাকায় এরকম নামকরণ গ্রহণযোগ্য নয়। ধরলা তীরের পার্কের নাম “ধরলা পার্ক” হওয়াই যৌক্তিক।’
জেলা ছাত্রশিবির সভাপতি মুকুল হোসেন বলেন, ‘কুড়িগ্রামের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্যতা, নদী ভাঙন ও কর্মসংস্থানের অভাব। এই সময়ে পার্ক নির্মাণ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত নয়। আর হলে নাম অবশ্যই জেলার ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।’
জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আমিমুল ইহসান বলেন, ‘ধরলা কুড়িগ্রাম জেলার প্রতীক। পার্কের নাম “ধরলা পার্ক” হওয়া উচিত, এটাই জেলার মানুষের প্রাণের দাবি।’
সওজ জানিয়েছে, ধরলা তীরের ১৬ একর জমি বরাদ্দের জন্য তারা জেলা প্রশাসনের চিঠি পেয়েছে এবং তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সওজ কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জমির বরাদ্দ চেয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা সেটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। জমি বরাদ্দের আগে কোনো কাজ শুরু করার সুযোগ নেই।’
জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘নামকরণ নিয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে, আমরা সেটাকে স্বাগত জানাই।’
পার্কের নামকরণ ও নির্মাণ উদ্যোগ বিধিসম্মত কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পার্ক নির্মাণের উদ্যোগটা আমি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছি। এখানে বিধির কিছু নেই। যদি এটা সরকারি প্রকল্প হতো, তাহলে সেখানে বিধির উল্লেখ থাকতো।’
তবে সরকারি জমিতে সরকারি অর্থায়নে একজন জেলা প্রশাসক ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন কাজ করতে পারেন কি না—তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
সানজানা