ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাঞ্চারামপুর থেকে মৌসুমি ব্যবসায় পিতা-পুত্র

ধলেশ্বরীর ঘাটে ভেসে এলো মিষ্টি আলুর নৌকা

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ।

প্রকাশিত: ০০:৩৩, ৪ জুন ২০২৫

ধলেশ্বরীর ঘাটে ভেসে এলো মিষ্টি আলুর নৌকা

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার ধলেশ্বরী নদীর শান্ত জলে ধীরে ধীরে ভেসে আসে একটি ছোট গহনা নৌকা। প্রতিবছরের মতো এবারও রামকৃষ্ণদী ঘাটে এবং চান্দের চর ঘাটে নোঙর ফালায়। আলুভর্তি গহনা নৌকা।

কোলাহলহীন ঘাটে, ভোরের প্রথম আলোয় সেই নৌকাটি যেন একটি চলমান সবজির বাজার। পুরো নৌকাজুড়ে শুধু মিষ্টি আলু—কুমিল্লার বাঞ্চারামপুর থেকে আনা। মৌসুমি এই ব্যবসার পেছনে রয়েছেন এক পিতা-পুত্রের জুটি, সাথে আরও দুইজন শ্রমিক। বছরের এই সময়টাতে তারা নদীপথে ঘাটে ঘাটে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন এই কৃষিজ পণ্য।

নৌকা ভিড়তেই আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ ছুটে আসেন। নদীর ঘাটে নেমেই কেউ কেউ কিনে নিচ্ছেন কাঁচা, তাজা মিষ্টি আলু। অনেকেই বলেন, বাজারে এই দামে এতটা ভালো মানের মিষ্টি আলু পাওয়া কঠিন। এটি শুধু ক্রয়-বিক্রয়ের একটি পর্ব নয়, যেন গ্রামবাংলার এক অনন্য সাংস্কৃতিক চিত্র—নদী, নৌকা আর কৃষকের মুখোমুখি যোগাযোগ।

তবে সময় বদলেছে নৌকার ব্যবসা নিয়ে আগের মতো স্বস্তিতে নেই বিক্রেতারা। ৫৫ বছর বয়সী বিক্রেতা সাইফুল হক জানান, “একসময় ঘাটে ঘাটে নামলেই ভিড় জমে যেত, লোকেরা আগেই অপেক্ষায় থাকত। এখন কাস্টমার খুঁজে বের করতে হয়। বিক্রি আগের তুলনায় অনেক কম।”

তাঁর ছেলে রাকিব হক বলেন, “ডিজেল, চালকের মজুরি আর প্রতিটি ঘাটে ঘাটে ভিড়ানোর খরচ সব বেড়েছে। কিন্তু আলুর দাম বাড়ালে আবার বিক্রি কমে যায়।”

নৌকায় ৩০-৪০ মণ মিষ্টি আলু থাকে। সাধারণত বাঞ্চারামপুর থেকে যাত্রা শুরু করে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, এবং মাঝে মাঝে ঢাকা জেলার বিভিন্ন নদীপাড়ে গিয়ে নোঙর করেন। এই যাত্রা চলে প্রায় ১৫-২০ দিন পর্যন্ত। একটি মৌসুমে একাধিকবার নেমে আসেন তারা এই নদীপথে, তবে এবারই প্রথম বলে জানালেন রাকিব।

এই ব্যবসায় লাভ-লোকসানের বাইরেও রয়েছে মানুষের সাথে সম্পর্কের বন্ধন। ঘাটে ঘাটে তাদের চিনে ফেলে স্থানীয়রা। কেউ চেনা বিক্রেতাকে পেয়ে দাম না বলেই ব্যাগ ভর্তি আলু তুলে নেন, কেউ আবার আগেভাগে জানিয়ে রাখেন পরের দিনের জন্য।

“এইভাবে বিক্রি করতে পারলেই ভালো লাগে,” বলেন সাইফুল। “অন্তত গ্রামে গ্রামের মানুষদের মুখে হাসি ফোটে। আমরা জানি, বাজারে গেলে ওরা এতটা সাশ্রয়ী দামে পাবে না।”

একসময় নদীকেন্দ্রিক এই চলমান বাজার ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির চিরচেনা চিত্র। কিন্তু নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, ও গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থার আধুনিকায়নে এমন অনেক মৌসুমি ব্যবসা এখন বিলুপ্তির পথে।

তবু কিছু মানুষ এখনো ধরে রেখেছেন পুরনো ঐতিহ্য। ধলেশ্বরী নদীর বুকেই তাই এখনও মাঝেমধ্যে দেখা যায় এই ধরনের ভ্রাম্যমাণ নৌকা, যা কেবল পণ্য নয়, বহন করে গ্রামবাংলার জীবন, শ্রম, আর স্মৃতির। 

ফারুক

×