ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন আজ

ট্রেনের নতুন বাড়ি এখন সৈকত শহরে

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ১০ নভেম্বর ২০২৩

ট্রেনের নতুন বাড়ি এখন সৈকত শহরে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ কক্সবাজারে আইকনিক ঝিনুক আকৃতির রেলস্টেশন উদ্বোধন করবেন

‘ঝক ঝকাঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই
ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?’
শামসুর রাহমানের এই কবিতা থেকে প্রশ্ন জাগে, ট্রেনের কি কোনো বাড়ি আছে? বাড়ি বলতে যা বোঝায়, তা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু হুইসেল বাজিয়ে সুনির্দিষ্ট লাইন ধরে ছুটে চলা ট্রেনকে থামতে হয় তার জন্য তৈরি করা স্টেশনে। সড়ক যানের মতো যত্রতত্র চলার স্বাধীনতার তার নেই। যেখানে সেখানে যেতে ও থাকতে পারে না এটি। চাই বিশেষ ব্যবস্থা, যার ওপরে থাকে শেড বা আচ্ছাদন। চট্টগ্রামে ট্রেনের সর্বদক্ষিণ বাড়ি ছিল দোহাজারিতে। অসম-বেঙ্গল রেলের অধীনে সর্বশেষ এই বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে। ব্রিটিশ আমলেই তার আরও বাড়ি হওয়ার কথা ছিল।

যাওয়ার কথা ছিল কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধসহ নানা  ঘটনায় ট্রেনের জন্য আর বাড়ি তৈরি হয়নি। প্রায় শতবর্ষ পরে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য কক্সবাজারে। ট্রেনের নতুন বাড়ি এখন সৈকত শহরে।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ার বাড়তি প্রাপ্তি হিসেবে সাধারণত যা পাওয়া যায়, তা হলো সেকেলে চেহারা ঝেড়ে ফেলে আধুনিকতার ছোঁয়া। সঙ্গত কারণেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন। এই রেলপথ দেশের অন্যসব রেলপথের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকবে এর নান্দনিকতায়। এই লাইন ধরে চলবে অপেক্ষাকৃত আধুনিক ট্রেন, যাতে চড়ে যাত্রীরা যাবেন সুনীল সাগরের সুউচ্চ ঢেউকে আলিঙ্গন করতে।

ট্রেনের নতুন বাড়িটি একটি আইকনিক স্টেশন, যার তুলনা দক্ষিণ  এশিয়ায় নেই। দেখে মনে হবে বিশালাকৃতির একটি ঝিনুক, যারমধ্যে ঢুকে আছে টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে সবকিছু। সেখানে আছে থাকার ব্যবস্থাও। এই স্টেশনে নেমেই যাত্রীরা বুঝতে পারবেন, তারা চলে এসেছেন অনিন্দ্য সুন্দর একটি বেড়াবার জায়গায়। বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই কানে আসবে সাগরের গর্জন।
চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারি পর্যন্ত রেলপথ আগে থেকেই রয়েছে। কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে রাজধানীর সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটতে যাচ্ছে পর্যটন রাজধানীর। মাঝে পাহাড়, নদী ও সাগরবেষ্টিত বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম, যেখানে এখন গাড়ি চলছে নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল ধরে। যাবার সময় ট্রেন এবং ফিরতিপথে বাস হলে দেখা হয়ে যাবে দুটোই। অর্থব্যয়ের ষোল আনাই উসুল হবে ভ্রমণের আনন্দে।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ১৫০ কিলোমিটারের (কিমি) রেলভ্রমণ হবে মনোমুগ্ধকর। কর্ণফুলী, শঙ্খ, ডলু, মাতামুহুরী, বাঁকখালী নদী অতিক্রম করে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবার পথে পড়বে উঁচুনিচু অনেক টিলা, গর্জন বাগান আর সবুজের সমারোহ। লোহাগাড়ার চুনতিতে রয়েছে বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য। হাতি চলাচলের পথ যেন কোনোভাবেই রুদ্ধ না হয় সেজন্য সেখানে তৈরি করা হয়েছে ‘এলিফ্যান্ট ওভারপাস’। ঘনবন আচ্ছ্বাদিত এই ওভারপাস দিয়ে পারাপার হবে বন্যহাতির দল, আর নিচ দিয়ে ঝক-ঝক করে ছুটে যাবে দ্রুতগতির ট্রেন। পথে পড়বে ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ আড়াই ঘণ্টা। দু’পাশের সৌন্দর্যে বিমোহিত যাত্রীদের এ সময়টুকু কেটে যাবে অপলক দৃষ্টিতে। সৈকত শহর কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশন পর্যন্ত পথটুকু অতিক্রম করা হয়ে যাবে একপ্রকারের ঘোরের মধ্যে। নীলাভ সাগরের ঢেউ দেখতেই কক্সবাজারে ছুটে যায় মানুষ।
কোনো একদিন ট্রেন ছুটে আসবে কক্সবাজারে, এমনটি কি ভেবেছিল সেখানকার মানুষ? অবশেষে সেটিই হলো শেখ হাসিনা সরকারের আমলে। গত ৫ নভেম্বর প্রথম পরিদর্শন ট্রেনটি যখন ধেয়ে এলো পাহাড় নদী পেরিয়ে, তখন সে কী উচ্ছ্বাস! পথে পথে সংবর্ধনা আর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ। শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে সকল বয়সী নারী পুরুষ দাঁড়িয়েছিল স্টেশনে ও পথে পথে। শিশুদের আনন্দ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই হয়তো এর আগে ট্রেনই দেখেনি। ট্রেন বরাবরই শিশুদের আকর্ষণ। সঙ্গত কারণেই তারা ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটেছে অনেকদূর। বাণিজ্যিক চলাচল শুরুর পর প্রতিদিনই তারা দেখবেন ঝমাঝম শব্দে হাওয়ার গতিতে ট্রেন চলার দৃশ্য।
১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পযন্ত ১০১ কিমি রেললাইন প্রকল্প আওয়ামী লীগ সরকারের সাহসী পদক্ষেপ। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর অনেকেই বলেছিলেন, এটি একটি স্বপ্নবিলাসী প্রকল্প। আদৌ কি বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু সে স্বপ্ন এখন ধরা দিয়েছে বাস্তবে। বাস্তবায়নের পর কক্সবাজার জুড়ে গেল সারাদেশের রেল নেটওয়ার্কে। এই কক্সবাজার দেশের পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। পুরোদেশের মানুষ পাবে ভ্রমণের আনন্দ ও নিরাপদ যাত্রা। ট্রেনে চড়ে কক্সবাজারে যাওয়া হবে বাড়তি পাওয়া। 
ট্রেন বা রেলগাড়ি নিয়ে অনেক গান, অনেক কবিতা। পুরনো চলচ্চিত্রে অনেকটা অপরিহার্য একটি অনুষঙ্গ ট্রেন। সেই ট্রেন নিয়ে রয়েছে অনেক আবেগও। বিশেষ করে মাঝরাতে যদি ট্রেনের শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায় তখন সেই আবেগটা হয় আরও প্রগাঢ়। ট্রেন ছুটে চলেছে তার বাড়িতে, আর এতে অনেক যাত্রী যাচ্ছেন তাদের নিজ বাড়িতে স্বজনদের সান্নিধ্যে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর ডিসেম্বরেই কক্সবাজার রেলপথে শুরু হয়ে যাচ্ছে ট্রেনের বাণিজ্যিক চলাচল, এমনই জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। তাহলে ট্রেন আর গল্প কিংবা স্বপ্নের বিষয় আর থাকছে না কক্সবাজারের মানুষের কাছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ যেমন ছুটে যাবে, তেমনিভাবে সেখানকার মানুষও হয়তো তাদের যাত্রায় প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেবে এই ট্রেনকেই।

উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ শনিবার উদ্বোধন হতে যাচ্ছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথ উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে জেলায় আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা আজ আসছেন জেনে জেলাজুড়ে সাজ সাজ রব পড়েছে। পর্যটন শহর কক্সবাজার উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। আজ শনিবার নবনির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন ও নান্দনিক আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

×