ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ রকিবুর রহমান

প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের সুফল পাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ২৯ মার্চ ২০২০

প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের সুফল পাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা

করোনাভাইরাস আতঙ্কে যখন বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাজার ধসে পড়ছে, কোন প্রণোদনাই কাজ করছে না এবং বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যখন ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে, বাজারে যখন শেয়ারের দাম ফ্রি-ফল হচ্ছে, লাখো বিনিয়োগকারী যখন দিশেহারা তখন প্রধানমন্ত্রীর একটি সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে দরপতন ঠেকাতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। বাজারে শেয়ারের দামের ফ্রি-ফল বন্ধ হয়েছে এবং লাখো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী স্বস্তিতে আছে। কারণটি হলো শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস ঠিক করে দেয়া অর্থাৎ একটি শেয়ারের দাম নির্দিষ্ট দামের নিচে নামতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং সঠিক। পুঁজিবাজারে যখনই কোন বড় ধরনের সঙ্কট হয়েছে আমরা দেখতে পাই সরকার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যা প্রথমে সবাই সমালোচনা করলেও পরবর্তীতে সবাই স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। যেমন, গত বাজেটে প্রত্যেক লিস্টেড কোম্পানিকে তার রিটেইনেড আর্নিংস এবং রিজার্ভ থেকে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে আইনের মাধ্যমে বাধ্য করেছে। সরকার ঠিকই বুঝতে পেরেছিল ম্যাক্সিমাম লিস্টেড কোম্পানি বিশেষ করে ব্যাংকের স্পন্সর পরিচালকরা নিজেদের স্বার্থে এই প্রস্তাবটির চরম বিরোধিতা করেছিল। কারণ এসব পরিচালক সব সময়ই বোনাস শেয়ার দিতে পছন্দ করে তাদের নিজেদের স্বার্থের এতে করে তারা নিজেরা লাভবান হয় এবং বিনিয়োগকারী সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী ব্যাংক পরিচালকদের বলেছিলেন শুধু আপনাদের স্বার্থ দেখলে আমার হবে না, আমাকে লাখো বিনিয়োগকারীর স্বার্থ দেখতে হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের সুফল পেতে শুরু করেছে বিনিয়োগকারীরা। এই পর্যন্ত যে কয়টি ব্যাংক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে তাদের সবাই ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি লাখো বিনিয়োগকারী কৃতজ্ঞ। গত ১৪ এবং ১৫ জানুয়ারি শেয়ারবাজারে আস্থা এবং তারল্য সঙ্কটের কারণে যখন বাজারে শেয়ার প্রাইস ফ্রি-ফল হচ্ছিল, বাজার তখন ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছিল, তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৬ জানুয়ারি সকালে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে নিয়ে পুঁজিবাজারে ফ্রি-ফল ঠেকানোর জন্য তৎক্ষণাৎ করণীয় কয়েকটি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, তাও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে। যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাহলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা পুঁজিবাজারের সঙ্গে জড়িত তাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০০ কোটি টাকা প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ শর্তে মাত্র ৫% সুদে ৫ বছরের জন্য ভাল ভাল শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে এই শর্তে। ৫ বছরের মধ্যে কোন ক্ষতি হলেও ওই প্রতিষ্ঠানকে কোন মন্দ ঋণ সঞ্চিতি করতে হবে না। এটি ছিল একটি সঠিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের জন্য, যা ইতিপূর্বে আর কখনও হয়নি। অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এই সিদ্ধান্তটির সমালোচনা করেছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এই টাকা নেয়ার এবং বিনিয়োগ করার ব্যাপারে তখন কোন গুরুত্ব দেয়নি। এটা ছিল প্রধানমন্ত্রীর তারল্য সঙ্কট নিরসনে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে সুযোগ করে দিয়েছে এটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল। এরপর করোনাভাইরাস আতঙ্কে যখন ক্রমাগত শেয়ার বিক্রির চাপ, বিদেশী পোর্টফোলিওতে শেয়ার বিক্রির চাপ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মার্জিন রুল মেনে বিনিয়োগকারীর এ্যাকাউন্টে ফোর্স সেল, সব মিলে লাখো বিনিয়োগকারী যখন দিশেহারা তখন ১৮ মার্চ অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীকে উজ্জীবিত করেছে, ফ্রি-ফল বন্ধ হয়েছে। যাদের ২০০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে পর্যায়ক্রমে তারা বিনিয়োগ শুরু করেছে। ব্যাংকগুলো ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়া শুরু করেছে এবং ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবল হতে শুরু করেছে। আমরা যারা পুঁজিবাজারের সঙ্গে জড়িত আছি, লিস্টেড কোম্পানির পরিচালকরা, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিস এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকার-ডিলার, মার্চেন্ট ব্যাংক যদি সবাই সঠিক সময় সঠিক ভূমিকা পালন করে তাহলে একটি স্ট্রং এবং স্ট্যাবল পুঁজিবাজার গড়ে উঠবে। তাতে উপকৃত হবে সৎ উদ্যেক্তা যারা তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে এগিয়ে যেতে পারবে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নয়, এতে করে ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণ হ্রাস পাবে। দেশ এবং অর্থনীতি উপকৃত হবে। অর্থমন্ত্রীর সরকারপ্রধানকে পুঁজিবাজার ক্রাইসিস মুহূর্তে প্রাগম্যাটিক সুপারিশ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ব্যাংক ব্যবস্থা ভাল থাকলে পুঁজিবাজার ভাল থাকবে। ব্যাংকের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ থেকে ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। দক্ষ ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। দক্ষ ব্যাংক ব্যবস্থাপনা টিম গড়ে তুলতে হবে। ঋণ দেয়ার ব্যাপারে পরিচালকদের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। লিস্টেড কোম্পানি বিশেষ করে ব্যাংকের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। কোন লিস্টেড কোম্পানি এবং এর পরিচালকদের ইচ্ছায় যেন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া না হয়। বর্তমানে আমরা যেটা দেখতে পাই তাহলো বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র পরিচালক এই প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর পরিচালকদের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। তাতে করে এই স্বতন্ত্র পরিচালকরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা করতে পারে না। এতে করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোন সুশাসন থাকে না। সবাইকে বুঝতে হবে ব্যাংকের পরিচালকদের টাকায় ব্যাংক পরিচালিত হয় না, ব্যাংক পরিচালিত হয় ডিপোজিটরদের টাকায়। অতএব, ডিপোজিটরদের টাকা রক্ষা করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে যদি সুশাসনে আনা যায়, খেলাপী আদায় করা যায় এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনা থেকে যদি দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বন্ধ করে উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা যায় তাহলে ব্যাংকও টিকে যাবে, পুঁজিবাজার ও ভাল হবে। এই মুহূর্তে অর্থমন্ত্রী যে কাজটি পুঁজিবাজারের স্বার্থে জরুরীভাবে করতে পারেন সেটি হলো কোম্পানি বাই ব্যাক আইন। অর্থাৎ, যে সকল কোম্পানি অত্যন্ত স্ট্রং, যাদের রিজার্ভ ভাল, গ্রোথ ভাল, ইপিএস ভাল সে সকল কোম্পানি যে কারণেই হোক বাজার যখন খারাপ থাকে তখন কোম্পানি যদি মনে করে তার শেয়ারটি এই দামে ক্রয়-বিক্রয় ঠিক না, তখন কোম্পানি তার রিজার্ভ এবং রিটেইনেড আর্নিংস থেকে বাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়ে তার শেয়ারটি বাজারে স্ট্যাবল করতে পারে এবং দরপতন ঠেকাতে পারে। এতে করে বিনিয়োগকারী উপকৃত হবে। সেই কোম্পানির ওপর বিনিয়োগকারীর আস্থা অনেক বেড়ে যাবে। সকল উন্নত দেশের পুঁজিবাজারে এই আইন প্রযোজ্য আছে। অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করব এই আইনটি অবিলম্বে একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে কার্যকর করে পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে পাস করে নেয়ার জন্য। এটা পুঁজিবাজারকে স্ট্যাবল করতে সাহায্য করবে। অর্থমন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স অব বাংলাদেশ, স্টক ডিলার, ব্রোকার আমরা যে যেখানেই আছি, বিশেষ করে আমরা যারা পুঁজিবাজার এবং অর্থনীতি নিয়ে কথা বলি তারা যার যার অবস্থান থেকে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করতে পারি। আমরা যেন রিউমার না ছড়িয়ে পুঁজিবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত না করি। আমরা যদি যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করি তবে পুঁজিবাজার অবশ্যই স্ট্যাবল হবে, লাখো বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা শিল্পের উদ্যোক্তা, এবং অর্থনীতি লাভবান হবে । আমি একটি স্মৃতিচারণ করতে চাই, যা না বললেই নয়। আপনারা সবাই জানেন ২০০৯-২০১০-এ আমি যখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট ছিলাম তখন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যার একটি সিদ্ধান্ত আমাকে এবং দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তা হলো, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন আমাদের এখানকার কোন কোন ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতুতে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল তখন আমাদের দৃঢ়চেতা প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বার্থে, সাধারণ জনগণের স্বার্থে আল্লাহর ওপর ভরসা করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন অনেক বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনীতিবিদ এটাকে প্রধানমন্ত্রীর একটি অপরিপক্ব এবং আবেগী সিদ্ধান্ত বলেছিলেন। কিন্তু আমি সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে এই সিদ্ধান্তের জন্য স্বাগত জানিয়ে একটি প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীর পক্ষ থেকে বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে অর্থায়ন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বাস্তবতা হলো পদ্মা সেতু দৃশ্যমান এবং শেষ পর্যায়ে । লেখক : সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড
×