ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে অপপ্রচার বাড়ছে

বালুখালী ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী একজন নিহত

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮

বালুখালী ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী একজন নিহত

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রত্যাবাসন বিরোধী তৎপরতা জোরালো হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বলে নানা উদাহরণ দিয়ে প্রত্যাবাসন বিরোধীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে এবং কোন রোহিঙ্গা যাতে প্রত্যাবাসনের পক্ষে রাজি না হয় সে জন্য ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার সকালে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী ইউছুফ জালাল নামে আরেকজনকে প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে এ ঘটনা ঘটেছে। এর আগে শুক্রবার প্রত্যাবাসনে রাজি মোঃ ইউছুফ নামে এক মাঝিকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। উল্লেখ করা যেতে পারে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে বর্তমানে নতুন ও পুরনো মিলে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পে রয়েছে। এদের অধিকাংশ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু ওপারের পরিস্থিতি এখনও নিজেদের অনুকূলে নয় বলে তারা বিশ্বাস করে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, তাদের ফেলে আসা বসতবাড়ি ও ভিটেমাটির কোন নিশানা রাখেনি মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তাদেরকে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে সেখানে নিয়ে রাখা হবে আশ্রয় ক্যাম্পে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে ইতোপূর্বে প্রত্যাবাসিত বহু রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পে রয়েছে। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন রীতিমত অসহায়। চলাফেরার ওপর রয়েছে বাধা-নিষেধ। নাগরিকত্বের বিষয়টি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রত্যাবাসনে যে চুক্তি করেছে তা নিয়ে খোদ জাতিসংঘ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও ইতোমধ্যে বলেছে, রাখাইন রাজ্য রাখাইনদের বসবাসের জন্য এখনও অনুকূলে আসেনি। ভারতের পক্ষ থেকেও এক ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার সরকার বিশ্বচাপের মুখে নত হয়ে প্রত্যাবাসনে রাজি হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য কোনরূপ ব্যবস্থা এখনও করেনি। তাদের যেসব ভিটে মাটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তার চিহ্ন পর্যন্ত রাখা হয়নি তা ফিরিয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছা ব্যক্ত এখনও করেনি। যে কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে এ মুহূর্তে ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। এছাড়া কিছু এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকেও এ মুহূর্তে ফিরে না যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করছে। ওপারের সূত্রগুলোও জানিয়েছে, বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের বিশেষ করে মংডু শহরে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে তারাও তাদের জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে। কেননা, সেদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও উগ্র মগ সন্ত্রাসীরা কায়মনোবাক্যে চায়না রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করুক। গত ২৫ আগস্ট রাতে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর সেদেশের সরকারী কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে বলেছেন, তারা তাদের অতীতের সরকারগুলো অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করছে। অর্থাৎ রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করায় তাদের মূল লক্ষ্য। কেননা, গোটা রাখাইন রাজ্য গ্যাসসহ বিভিন্ন সম্পদে ভরপুর। রাখাইন রাজ্য হয়ে চীনের কুনমিন পর্যন্ত ইতোমধ্যে গ্যাস লাইন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পৃথকভাবে তেলের পাইপ লাইন সম্পন্ন হওয়ার পথে। সিটওয়ে বন্দর দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানির তেল ও গ্যাস রাখাইন হয়ে সুদূর চীনের কুনমিন পর্যন্ত বিস্তৃতি থাকবে। সঙ্গত কারণে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাণিজ্যিক এ স্বার্থে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সে লক্ষ্যেই রোহিঙ্গা বিতাড়ন কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের বড় অংশটি পালিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশে। সবচেয়ে বড় ঢলটি নেমেছে গত ২৫ আগস্টের রাতে শুরু হওয়া সেনা অভিযানের পর। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক পর্যায়ে নানামুখী তৎপরতা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সরকারের সকল কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে মিয়ানমার শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সম্মত হয়েছে। গেল সপ্তাহে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে দু’দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের চুক্তি অনুযায়ী আজ ২৩ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে তা থমকে গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়ে বৈঠক করে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন যাতে বাংলাদেশের বার্তাটি রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পৌঁছে যায়। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, মূলত মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তরিক নয়। বিশ্বচাপের মুখে তারা রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় ক্যাম্প নির্মাণ করে চলেছে। কিন্তু তাদের বসতভিটা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কোন তৎপরতা নিচ্ছে না। এতেই বুঝা যায়, রোহিঙ্গারা নিজেদের বসতভিটায় পুনরায় বসবাস শুরু করুক তা মিয়ানমার সরকার চায় না। এটাই মূলত মিয়ানমার সরকারের প্রণীত নীলনকশার অংশ যা তাদের আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক স্বার্থের জের। এ কারণেই রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে ফিরিয়ে আসতে কোন বাধা দেয় না সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনীও রোহিঙ্গারা এপারে চলে আসলে ফিরিয়ে না দিয়ে তাদেরকে আশ্রয় ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিষয়টি সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, মিয়ানমার থেকে আসতে এবং বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে কোন বাধা না থাকায় এর পাশাপাশি এদেশে আশ্রয় ক্যাম্পে থেকে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার ত্রাণ নিয়ে জীবনযাপন করা সহজ হওয়ায় মূলত রোহিঙ্গারা আগেও যেমন এসেছে, তেমনি এখনও আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। সুযোগ পেলে তারা বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়ছে। বর্তমানে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ভারে উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল বিপর্যস্ত হয়ে আছে। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে যেভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসিত করা। সরকারও চাচ্ছে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক। কিন্তু মাঝখানে এমন একটি শক্তি কাজ করছে যাতে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে না যায়। অভিযোগ উঠেছে, রোহিঙ্গাদের ফিরে নিতে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পরবর্তী প্রত্যাবাসন কার্যক্রম যতই বিলম্বিত হচ্ছে ততই প্রত্যাবাসন দল ভারি করছে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেছে। যাতে রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে ইচ্ছে ব্যক্ত না করে। রোহিঙ্গা দলের নেতারা জেনে গেছে মিয়ানমারের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে বলা আছে কাউকে জোর করে প্রত্যাবাসন করা যাবে না। এ বক্তব্যের প্রতি সমর্থন রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ ও মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থাগুলোর। ফলে যতই তালিকা করুক না কেন কেউ যদি ইচ্ছে করে যেতে না চায় তাহলে তাদের ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় নেয়া কঠিন। গত শনি ও রবিবার জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি লি টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে বিভিন্ন রোহিঙ্গা নেতারা তাদেরকে যেন জোর করে রাখাইন রাজ্যে ফেরত না পাঠায় তার দাবি জানিয়েছে। এদিকে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী, স্বদেশ চিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোঃ আতাউল্লাহ খান জানিয়েছেন, সরকার যখন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে তখন কিছু কিছু এনজিও এ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গারা যাতে রাখাইনে ফিরে না যায় সে জন্য উৎসাহিত করছে, যা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। এদিকে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু হওয়ায় স্থানীয়রা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়েছে। মূলত উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের মানুষ রোহিঙ্গা ভারে অমানবিক জীবনযাপন করছে। তাদের ফসলি জমিসহ এমন কোন স্থান নেই যেখানে রোহিঙ্গাদের হাত পড়েনি। পাহাড় কাটা থেকে শুরু করে পরিবেশকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। শীত মওসুম পেরুলে বর্ষা শুরু হবে তখন ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এ লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের যত দ্রুত নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করা যায় ততই দেশের জন্য মঙ্গল বলে অভিজ্ঞ মহলের পক্ষে দাবি উঠেছে।
×