ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর কুমার দে;###;গাফফার খান চৌধুরী

জঙ্গী নির্মূলের বছর

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১ জানুয়ারি ২০১৮

জঙ্গী নির্মূলের বছর

বিদায়ী বছরে জঙ্গী নিমর্ূূলসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল সন্তোষজনক। জাতিসংঘের তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশ জঙ্গীবাদ নির্মূলের ক্ষেত্রে রোল মডেল। দেশটির কাছ থেকে বিশ্বের উন্নত পাঁচটি দেশ জঙ্গীবাদ নির্মূলে নানা পরামর্শ নিচ্ছে। জঙ্গীবাদ নির্মূলের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একের পর এক জঙ্গী আস্তানায় চালানো অভিযান ছিল বছরজুড়ে আলোচনায়। ধারাবাহিক অভিযানের মুখে জঙ্গীদের মেরুদ- ভেঙ্গে গেছে। যে কারণে হলি আর্টিজানের পর জঙ্গীরা আর বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটাতে পারেনি। যদিও আত্মঘাতী হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে। তাও পুলিশ আর র‌্যাবের তৎপরতার মুখে ব্যর্থ হয়ে গেছে। অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে হাজারখানেকেও বেশি জঙ্গী। যাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন দেশে মোস্টওয়ান্টেড। সবমিলিয়ে প্রায় আড়াইহাজার জঙ্গীর পৃথক ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। যা দেশে ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে জঙ্গীবাদ নির্মূলে সহায়ক হবে। এছাড়া চাঞ্চল্যকর বেশকিছু হত্যাকা-সহ কোন কোন ব্যক্তির দীর্ঘ সময় নিখোঁজ থাকার পর হদিস মেলার ঘটনা ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নতুন বছরে অপরাধ দমনে বিশেষভাবে তৎপরতা চালানোর আগাম নির্দেশ দিয়েছে সরকার। হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা এবং দেশের উপর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ : গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় ১৭ জন বিদেশী ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জনের মৃত্যুর পর সারা দুনিয়ায় রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায়। বাংলাদেশে আইএস রীতিমতো ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে বলে বিভিন্ন তরফ থেকে দাবি করা হয়। এরপর বিভিন্ন জঙ্গী হামলার পর আইএসের নামে দায় স্বীকার করে সেই দাবিকে আরও পাঁকাপোক্ত করার চেষ্টাও করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ, বিদেশীদের বসবাস, তাঁদের যাতায়াতসহ সব কাজকর্ম রীতিমতো হুমকির মুখে পড়ে। অনেক বিদেশী হলি আর্টিজানের ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ থেকে চলে গেছেন। অনেক প্রকল্পের কাজে ধীরগতি চলে আসে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার দেশে-বিদেশে চরমভাবে চাপের মুখে পড়ে। নানাভাবে বাংলাদেশ জঙ্গীবাদের উর্বর ভূমি বলে প্রপাগা-া চালানো হয়। সরকার বরাবরই এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করে বলছে, কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে দেশের উন্নয়ন ও সুনাম নষ্ট করতে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। এসব ঘটনার নেপথ্যে সরকারবিরোধী দেশী-বিদেশী গোষ্ঠী জড়িত। জঙ্গীবাদবিরোধী অভিযান : হলি আর্টিজানের পর সারাদেশে জঙ্গীবাদবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সিলেটে সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো দলের নেতৃত্বে ‘অপারেশন টুয়াইলাইট’ পরিচালিত হওয়ার ঘটনা। অভিযানে ছয় জঙ্গীর তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। আর অভিযানের আগে বাড়িটির ৩০টি ফ্ল্যাটে থাকা শতাধিক বাসিন্দাকে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা মুখোমুখো হওয়া ছাড়াই উদ্ধার করতে সক্ষম হন প্যারাকমান্ডোরা। অভিযানকালে জঙ্গী আস্তানার কাছে মোটরসাইকেলযোগে দুই জঙ্গী বিস্ফোরণ ঘটালে একজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত ২০ জন। অভিযানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে পুলিশ ও র‌্যাবের প্রতিটি বিশেষায়িত টিম অংশ নেয়। জঙ্গীদের ছোড়া গ্রেনেডে নিহত হন র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশের একজন পরিদর্শক। অভিযানের মুখে জঙ্গীরাও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার চেষ্টা করে। তারা বংশালে পুলিশ চেকপোস্টে এসিড নিক্ষেপ করে। এসিডে এক পুলিশ সদস্য মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে গুলি চালিয়ে একজনকে এবং পরে আরও চার জঙ্গী র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এমন ঘটনার মধ্যেই উত্তরায় নির্মাণাধীন র‌্যাব দফতরে হামলা করার চেষ্টা করে এক আত্মঘাতী জঙ্গী। র‌্যাবের তৎপরতার কারণে ব্যর্থ হয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায় ওই জঙ্গী। এতে ওই জঙ্গী মারা গেলেও কোন র‌্যাব সদস্য আহত হননি। এছাড়া খিলগাঁওয়ে র‌্যাবের চেকপোস্টে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা চালানোর চেষ্টা করে এক জঙ্গী। হামলা চালানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার মুহূর্তে র‌্যাবের গুলিতে ওই জঙ্গীর মৃত্যু হয়। বড় ধরনের হামলার হাত থেকে বেঁচে যান অনেক র‌্যাব সদস্য। জঙ্গীদের এমন অপতৎপরতার মধ্যে সারাদেশে মানুষের মধ্যে একপ্রকার ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে শুরু হয় সারাদেশে ব্লকরেইড পদ্ধতিতে অভিযান। অভিযানে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে পরপর দুইটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলে। সেখান থেকে গ্রেফতার হয় নারী ও পুরুষজঙ্গী। বেশ কয়েকজন জঙ্গী নিহত হয়। জঙ্গীদের সন্তানদের আস্তানা থেকে মানবিক কারণে দীর্ঘ সময় চেষ্টার পর উদ্ধার করতে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সীতাকু-ের ঘটনার সূত্রধরে মিরপুরে পুলিশের অভিযানে একই পরিবারের চার জঙ্গী সদস্য গ্রেফতার হয়। উদ্ধার হয় ৪৪টি বোমা ও জিহাদী বই। গ্রেফতার হয় জামায়াতে ইসলামীর রোকন তৌফিক। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সীতাকু-ে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গী রাশিত আলম তার ছেলে ছিল। গ্রেফতারকৃত অপর তিনজন নিহত জঙ্গী রাশিত আলমের খালাতো ভাই। জামায়াতের রোকনের মাধ্যমেই রাকিব, আরেফেনি ও শামসুল এবং সীতাকু-ে নিহত জঙ্গী রাশিত জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। ধারাবাহিক অভিযানে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যাচেষ্টাকারী সাইফুল রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে নিহত হয়। সাইফুল ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তার পিতা জামায়াত নেতা ও একটি মসজিদের ইমাম। অন্যদিকে মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট এলাকার জঙ্গী আস্তানাটিতে সোয়াট ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ চালায়। অভিযানে নিহত হয়েছে তিন জঙ্গী। যার মধ্যে একজন নারী। কুমিল্লায় ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’ চালানো হয়। মৌলভীবাজারে চালানো হয় অপারেশন ‘হিট ব্যাক‘। এছাড়া ঝিনাইদহ, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। শেখ হাসিনাকে নিশ্চিতভাবে হত্যার জন্য বিমান হামলার পরিকল্পনা : চলমান অভিযানে রাজধানী ঢাকার মিরপুর মাজার রোডের বর্ধনবাড়িতে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পায় র‌্যাব। তিন দিন ধরে সেই আস্তানায় অভিযান চলে। জঙ্গীরা আত্মসমর্পণের কথা বলে। শেষ পর্যন্ত আর আত্মসমর্পণ করেনি। নিজেরাই আত্মঘাতী হয়ে মারা যায়। আস্তানা থেকে সাতটি মাথার খুলি উদ্ধার হয়। নিহতদের মধ্যে রয়েছে দুর্ধর্ষ জঙ্গী আব্দুল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যরা। ওই আস্তানায় যাতায়াত ছিল জেএমবির শীর্ষ নেতা সরোয়ার জাহান ও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তামিম চৌধুরীর। ওই বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় জঙ্গীদের আশ্রয়দাতা বিমানের পাইলট সাব্বিরকে। বাড়ি থেকে একটি বহুতল ভবনের নক্সা উদ্ধার হয়। পরবর্তীতে সাব্বির আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। র‌্যাবের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতে পরিকল্পনা করেছিল সাব্বির। তার বিস্ফোরক ভর্তি বিমান নিয়ে গণভবনে শেখ হাসিনার বাসভবনে হামলা চালিয়ে পুরো ভবনই উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। যাতে শেখ হাসিনা নিশ্চিতভাবে মারা যায়। অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জঙ্গীদের হতাহত এবং জঙ্গী গ্রেফতার : পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ছোট বড় অন্তত অর্ধশত জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। এসব অভিযানে নিহত হয়েছে অন্তত ৩৫ জন জঙ্গী। এসব আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয়েছে অন্তত অর্ধশত জঙ্গী। এছাড়া সারাদেশে চালানো অভিযানে অন্তত হাজারখানেক জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জেএমবির শীর্ষ দুর্ধর্ষ জঙ্গী ভারতের মোস্টওয়ান্টেড হাতকাটা মাহফুজ। তাকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছিল ভারত। মাহফুজ ভারতের বর্ধমানে জেএমবির আস্তানা গড়ে তুলেছিল। সেই আস্তানায় তৈরিকৃত গ্রেনেড দিয়ে ভারতে ও বাংলাদেশে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। বেশকিছু গ্রেনেড বাংলাদেশে থাকা জঙ্গীদের কাছে বর্ধমান থেকে পৌঁছে দিয়েছিল। হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড ও অস্ত্র মাহফুজ সরবরাহের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্য উপাত্ত এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অন্তত আড়াইহাজার জঙ্গীর পৃথক ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এই ডাটাবেজ বাংলাদেশ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে জঙ্গীবাদ নির্মূলে সহায়ক হবে। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন সময় জঙ্গীদের হাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয় সদস্য নিহত হয়েছেন। আর একজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন সেনা কর্মকর্তা। বাকি আটজন পুলিশ সদস্য। এরমধ্যে গুলশানের হলি আর্টিজানে দুই পুলিশ কর্মকর্তা, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দুই পুলিশ সদস্য, ঢাকার গাবতলীতে এক পুলিশ কর্মকর্তা, ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় এক পুলিশ সদস্য এবং সর্বশেষ সিলেটে দুই পুলিশ সদস্য ও একজন সেনাসদস্য জঙ্গীদের হাতে নিহত হন। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে জঙ্গীদের গ্রেনেড হামলায় নিহত হন ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্য আবদুল মতিন। জঙ্গীবাদ নির্মূলে বাংলাদেশ রোল মডেল : পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, হলি আর্টিজানের ঘটনার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কালো তালিকাভুক্ত দেশের মুখে পড়েছিল বাংলাদেশ। জঙ্গীবাদের চরম ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় নাম এসেছিল বাংলাদেশের। জাতিসংঘের তরফ থেকে জঙ্গীবাদের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর উপর বিশেষ জরিপ চালানো হয়। জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমাতে জাতিসংঘের তরফ থেকে পরামর্শ দেয়া হয় জঙ্গীবাদের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে। তাতে বলা হয়, জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমাতে না পারলে দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া, বিনিয়োগের পরিবেশ বিনষ্ট হওয়া, বিদেশী প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়া, দাঙ্গা হাঙ্গামাসহ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে। যা দেশগুলোর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন সময় মতবিনিময় সভা হয়। গত ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাপানে এমনই একটি বিশেষ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জাতিসংঘ ও জাপান সরকার। সভায় জঙ্গীবাদের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স ও সিঙ্গাপুর সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি করে প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিল। সভায় জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, হলি আর্টিজানের মতো ঘটনার পর বাংলাদেশ স্বল্প সময়ে জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় আশাতীত সাফল্য দেখিয়েছে। এমনকি জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেন না। তার উদাহরণও দেয়া হয় সভায়। কোন দেশের পক্ষে স্বল্প সময়ের মধ্যে এমন সাফল্য দেখানো প্রায় সম্ভব ব্যাপার। অবিশ্বাস্য। এজন্য বাংলাদেশ জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় কোন পদ্ধতিতে কাজ করে তা সভায় উপস্থাপন করতে বলা হয়। বর্তমানে জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পরামর্শ নিচ্ছে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপিন্স। সভায় জানা যায়, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় সাত জাপানি নিহত হওয়ার পর দেশটি জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় জিরোটলারেন্স নীতি ঘোষণা করে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় ব্যাপক সাফল্য দেখানোর কারণে জাপান সবচেয়ে বেশি খুশি বাংলাদেশের উপর। জাপান নির্ভয়ে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে বসবাস ও যাতায়াত করার পরামর্শ দিয়েছে বলে জাপানের তরফ থেকে সভায় জানানোও হয়। নিখোঁজের পর হদিস পাওয়া : বিদায়ী বছরে বিশেষ আলোচনার মধ্যে ছিল নিখোঁজের দীর্ঘ সময় পর অনেকের হদিস মেলার বিষয়টি। এরমধ্যে প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারের সাজানো অপহরণ এবং তার হদিস মেলার ঘটনাটি ছিল ব্যাপক আলোচনায়। নানা মহল থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, ফরহাদ মজহারকে পরিকল্পিতভাবে সরকার অপহরণের পর গুম করেছে। এমন অভিযোগের মধ্যেই ফরহাদ মজহার উদ্ধার হয়। পরবর্তীতে তদন্তে প্রকাশ পায়, এক নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের সূত্রধরে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন। এছাড়া আরএমএম লেদার্স নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ কুমার রায় নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও ছিল বিশেষ আলোচনায়। তিনি গুলশান ইউনিয়ন ব্যাংকের সামনে থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। সাড়ে তিন মাসেরও বেশি সময় পর হদিস মেলে তার। অন্যদিকে নিখোঁজের পর হদিস মেলে সাংবাদিক উৎপল দাশ, বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের হাসান সিজার, বেসরকারী আইএফআইসি ব্যাংকের করপোরেট কমিউনিকেশন্স ও ব্র্যান্ডিং বিভাগের এ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদ ও কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমানের। যে হারে নিখোঁজদের হদিস মিলছে, তাতে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানসহ অন্য নিখোঁজদেরও হদিস মেলা বিচিত্র নয়। এদিকে নতুন করে আর নিখোঁজের ঘটনা ঘটছে না। তবে হদিস পাওয়ার সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। খুনসহ অপরাধ সংক্রান্ত বেশকিছু ঘটনাও ছিল আলোচনায় : ঢাকার বনানীতে মুখোশধারীদের গুলিতে ব্যবসায়ী নিহত, বনানীতে জন্ম দিনের দাওয়াত দিয়ে ডেকে এনে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে ও তার বন্ধুদের সহায়তায় রেইনট্রি হোটেলে তরুণী ধর্ষণ, বাড্ডায় জুয়ায় বাধা দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র খুন, যাত্রাবাড়ীতে মায়ের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার সময় কোল থেকে পড়ে পাঁচ মাসের শিশুর মৃত্যু, বাড্ডায় চার বছরের শিশু তান হাকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা, নরসিংদীতে চাচির পরকীয়া দেখে ফেলায় স্কুল ছাত্রীকে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ এনে পুড়িয়ে হত্যা, পরকীয়া প্রেমিকের কথামত বাড্ডায় স্বামী ও মেয়ে হত্যা, মতিঝিলে হোটেলে স্বামীর হাতে খুন হওয়া স্ত্রীর পাশ থেকে শিশু উদ্ধার, কাকরাইলে মা ছেলে হত্যা ও বছরের শুরুতেই মিরপুর দিয়াবাড়িতে দুই সন্তানকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যার ঘটনাও ছিল বিশেষ আলোচনায়। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই গ্রেফতার হয়েছে। তারা ঘটনার দায়ও স্বীকার করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আসামিদের দেয়া জবানবন্দি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব অপরাধ ছিল ব্যক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক। আর বছরের শেষ দিকে দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় সচিবালয়, শাহবাগ, জাতীয় প্রেসক্লাব, হাইকোর্টসহ আশপাশের এলাকায় বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের শতাধিক গাড়ি ভাংচুর ও জনজীবন অচল করে দেয়া এবং নারায়ণগঞ্জের পূর্বাচল ও মিরপুরের দিয়াবাড়ি খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনাও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
×