ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কলাপাড়ায় পল্লী বিদ্যুতের কাছে জিম্মি সাধারণ মানুষ

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ১৯ অক্টোবর ২০১৭

কলাপাড়ায় পল্লী বিদ্যুতের কাছে জিম্মি সাধারণ মানুষ

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া ॥ মধ্যস্বত্তভোগী দালাল চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে নতুন বিদ্যুত সংযোগ প্রত্যাশী গ্রাহকরা। এ চক্রের গ্যড়াকলে আটকে সাধারণ মানুষকে গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কলাপাড়া পল্লী বিদ্যুত সমিতির উদ্যোগে এসংক্রান্ত সচেতনতার জন্য মাইকিং করলেও বন্ধ হয়নি দালাল চক্রের প্রতারণা বাণিজ্য। ফলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ঘরে ঘরে বিদ্যুত প্রদানের মহতি উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। গ্রামের এক শ্রেণির টাউট-বাটপারচক্র সরকার দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ক্যাডার, জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব চলছে। ২০১৮ সালের মধ্যে কলাপাড়ার প্রায় ২৫০টি গ্রামের সর্বত্র বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ফি মাসে প্রায় নতুন আড়াই হাজার গ্রাহককে বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে কলাপাড়ায় দেড় শ’ গ্রামকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে। বাকি গ্রামগুলোয় বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার জন্য এ মাসের মধ্যে জরীপের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। আর এ সুযোগকে পুঁজি করে টাউট-বাটপার চক্র চাঁদাবাজিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কলাপাড়া পল্লী বিদ্যুত সমিতির জোনাল অফিস সূত্রে জানা গেছে, পল্লী বিদ্যুতের নিজস্ব অর্থায়নে এলাকায় লাইন জরিপ, বৈদ্যুতিক লাইনের খুটিসহ সংযোগ দেয়ার লাইন স্থাপনের কাজ করবে। এজন্য প্রত্যেক সংযোগ প্রত্যাশীকে ১০০ টাকা ফি প্রদানের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করতে হবে। জিডি (নিরাপত্তা জামানত) বাবদ ৬০০ এবং সদস্য ফি বাবদ ৫০টাকা জমা দিতে হয়। খাস জমির ডিসিআর প্রাপ্ত জমির সংযোগ প্রত্যাশীকে দিতে হবে জিডি বাবদ ১৬০০ এবং সদস্য ফি বাবদ ৫০টাকা। আর এসব কাজ করছে আরইবি নিজের উদ্যোগে। এখানে মধ্যস্বত্তভোগী কিংবা দালাল চক্রের হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু গ্রামীণ অনগ্রসর এই জনপদের মানুষ এতো আগেই বিদ্যুত পাবেন এমন আকাশ-কুসুম কল্পনা বাস্তবে পরিণত হওয়ার দেরি যেন সয়না। যদি বঞ্চিত হন এমন শঙ্কাও তাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এরপরই নানা কায়দায় গ্রামগুলোর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। লাইনের স্থাপন জরিপ এবং মাপজোক দলকে ম্যানেজ বাবদ গ্রাহক প্রতি ১০০-১৫০ টাকা, খুটি স্থাপনের সময় ঠিকাদারের পরিবহন খরচের কথা বলে গ্রাহক প্রতি এক হাজার টাকা এবং সংযোগ স্থাপন বাবদ সাড়ে তিন হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। আবার কাগজপত্রের ত্রুটি কিংবা বৈদ্যুতিক খুটি থেকে সংযোগস্থল বেশি দুরে হলে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত দুই থেকে তিন হাজার টাকা। এমন অভিযোগ উপজেলার নীলগজ্ঞ, ধুলাসর, মহিপুর, বালিয়াতলী এবং ধানখালীর ইউনিয়নের সংযোগ প্রত্যাশী শত শত মানুষের। অনেকে এসব টাকা দালালকে দিয়ে ওয়্যারিংসহ সকল কাজ সম্পন্ন করেও সংযোগ পায়নি বলে এখন বেরিয়ে আসছে প্রতারণার কাহিনী। নীলগঞ্জ ইনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের মানুষ জানান, সেখানকার এসব অপকর্মের মূল হোতা আব্দুল লতিফ। তিনি তালতলী এলাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন। বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার নামে এই এলাকা ও আশেপাশের আরও কয়েকটি গ্রামে তার কয়েকজন সহযোগী রয়েছেন এ চাঁদাবাজিতে। এসবের তদন্ত করলে সব বেরিয়ে আসবে। অনেকে টাকা দিয়েও নতুন সংযোগ না পাওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। ধুলাসার ইউনিয়নের নতুনপাড়া, চরগঙ্গামতি, অনন্তপাড়া, পশ্চিম চাপলী, দক্ষিণ চাপলী ও তারিকাটা গ্রামে বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়ার আগেই কেবল বিদ্যুতের খুটি বাসানোর আশ্বাসেই ঘরপ্রতি সাত শ’ থেকে এক হাজার টাকা করে আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। কোন রাখ-ঢাক ছাড়াই টাকা আদায় করা হয় নতুন বিদ্যুত সংযোগ প্রত্যাশীর কাছ থেকে। রাজ্জাক সিকদার জানান, টাকা না দিলে কারেন্ট না পাওয়ার কথা বলে এক নেতার ভাড়াটে হোন্ডাচালক আফজাল এ টাকা আদায় করছে। ওই গ্রামের সাত শতাধিক লোককে টাকা দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখানে প্রত্যেকের কাছ থেকে সর্বনিম্ন সাত শ’ থেকে ১৪ শ’ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এভাবে সিন্ডিকেট করে একেক এলাকায় একেকজনে টাকা আদায় করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সব চলছে ফ্রি-স্টাইলে। টাকা আদায়কারীদের কয়েকজন জানালেন, তারা টাকা তোলেন না। তবে এলাকায় আরইবির ইঞ্জিনিয়ার এসে মাপজোক করার সময় তারা সঙ্গে ছিলেন। অভিযুক্ত চরগঙ্গামতি গ্রামের আবজাল হোসেন ও হেলাল শরীফ, পশ্চিম চাপলীর সুমন বেপারী ও অনন্তপাড়া গ্রামের আব্দুর রহিমসহ অন্যান্যরাও টাকা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ওই এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল আকন জানান, এলাকার লোকজনকে সমিতির সদস্যভুক্ত করার জন্য অসচেতন লোকজনকে সহায়তার জন্য বলা হয়েছে। টাকা আদায়ের কথা ঠিক নয়। পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কলাপাড়া উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক প্রভাষক মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুতায়ন সরকারের একটি চলমান প্রক্রিয়ার অংশ, এখানে টাকা পয়সা দেয়া-নেয়ার কোন সুযোগ নেই। কেউ যদি টাকা পয়সা আদায় করে প্রতারণা করে তাইলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ কলাপাড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জোনাল অফিসের ডিজিএম সুদেব কুমার সরকার জানান, ঘরে ঘরে এ বিদ্যুৎ পেতে সংযোগ গ্রহীতাকে অফিসিয়াল জমানত ছাড়া বাড়তি টাকা গুনতে হবেনা। এজন্য আমাদের তরফ থেকে ব্যাপক মাইকিং করা হয়েছে। পোস্টার লাগানো হয়েছে। তারপরও যদি কেউ কারো দ্বারা প্রতারিত হয়ে থাকেন আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। প্রমাণসহ অভিযোগ করলে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহনের পদক্ষেপ নিব। পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডিজিএম প্রকৌশলী মনোহর কুমার বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, বিদ্যুত লাইন টানার আগে সদস্য ফি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বড়জোর আবেদন করতে পারে। এখানে এর বেশি টাকা দেয়া নেয়ার সুযোগ নেই। এব্যাপারে শীঘ্রই মাইকিং এবং পোস্টারিং করে সচেতন করা হবে।
×