ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

খুলনায় যুবকের চোখউপড়ে ফেলার ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৮ অক্টোবর ২০১৭

খুলনায় যুবকের চোখউপড়ে ফেলার ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস ॥ খুলনায় মোঃ শাহজালাল নামের যুবকের চোখ উপড়ে ফেলল কারা? চোখ নষ্ট হওয়া যুবক শাহজালালের অভিযোগ দাবিকৃত টাকা না পেয়ে গত ১৮ জুলাই রাতে খালিশপুর থানা পুলিশ তাকে নির্জন স্থানে নিয়ে স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুঁচিয়ে চোখ উপড়ে ফেলে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেখে আসে। পুলিশের দাবি ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে জনগণ তাকে ধরে পিটুনি দিয়ে চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা কি তা উদ্ঘাটনে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করে। শাহজালালের দুই চোখ উপড়ে ফেলার ঘটনার পর কথিত ছিনতাইয়ের শিকার কলেজ ছাত্রী সোমা আক্তারের দায়ের করা মামলার বিচার কাজ চলছে খুলনা মহানগর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। এ মামলায় জামিনে রয়েছেন শাহজালাল। অপরদিকে দুই চোখ হারানো যুবক শাহজালালের মা মোছাঃ রেনু বেগম তার ছেলের এই অবস্থার জন্য খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আদালত ওই মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন। আজ বুধবার (১৮ অক্টোবর) তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার দিন ধার্য রয়েছে। এদিকে শাহজালাল ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, মামলা তুলে নেয়ার জন্য তাদের অব্যাহতভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা স্বপদে বহাল থাকায় তদন্তে প্রভাবের আশঙ্কাও করছেন তারা। অপর দিকে অভিযোগ অস্বীকার করে খালিশপুর থানা পুলিশ বলেছে, ছিনতাই মামলার মোটিভ পরিবর্তনের উদ্দেশে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য মতে, গত ১৮ জুলাই রাতে খুলনা মহানগরীর খালিশপুর থানার গোয়ালখালী বাস স্ট্যান্ডে মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আহম্মেদের মেয়ে কলেজ ছাত্রী সোমা আক্তার আবু নাসের হাসপাতালে তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। তখন স্থানীয়রা ছিনতাইকারী শাহজামাল ওরফে শাহজালাল ওরফে শাহা ওরফে জীবন ওরফে লিটন ওরফে আকাশকে (৩১) ধরে গণপিটুনি দিয়ে দুই চোখ উপড়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ওই ছিনতাইকারীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এ ঘটনায় ছিনতাইয়ের শিকার সোমা আক্তার বাদী হয়ে দ্রুত বিচার আইনে খালিশপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শাহজালালকে অভিযুক্ত করে পুলিশ আদালতে চার্জশীট দিয়েছে। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে পিরোজপুরের কাউখালী, খুলনার সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর, ডুমুরিয়াসহ বিভিন্ন থানায় ৮টি মামলা রয়েছে। দুইটি মামলায় সাজা প্রদান করা হয়েছে। গত ২৫ জুলাই কাউখালী উপজেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় শাহজালালকে একজন চিহ্নিত অপরাধী হিসেবে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া তার গ্রামের বাড়ি পারসাতুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্রে তাকে অপরাধী হিসেবে অখ্যায়িত করা হয়েছে। মোঃ শাহজালাল ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশের বক্তব্য সঠিক নয় দাবি করে বলা হয়, তিনি গত ১৮ জুলাই তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে নিয়ে পিরোজপুরের কাউখালি উপজেলার সুবিদপুর গ্রামের বাড়ি থেকে খুলনা মহানগরীর নয়াবাটি রেললাইন বস্তি কলোনির শ্বশুর বাড়িতে আসেন। ওইদিন রাত ৮টায় শাহ জালাল তার শিশু কন্যার দুধ কেনার জন্য বাসার পাশের একটি দোকানে যান। এসময় তাকে থানায় ডেকে নেয়া হয়। গত ১৫ অক্টোবর খুলনা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শাহজালাল অভিযোগ করেন, অন্যায়ভাবে গত ১৮ জুলাই রাতে তাকে খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ নাসিম খান ও সঙ্গীয় অন্যান্য পুলিশ সদস্য থানায় ধরে নিয়ে পরিবারের কাছে টাকা দাবি করে। টাকা না পেয়ে পুলিশ রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে গাড়িতে করে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুঁচিয়ে দুই চোখ তুলে নেয়। পরে তাকে গুরুতর অবস্থায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেখে আসে। ঘটনার পরদিন সোমা আক্তার নামের একজন নারীকে দিয়ে খালিশপুর থানায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ছিনতাই মামলা দায়ের করা হয়। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কারাগার কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তার চিকিৎসা চলে। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। তার দুই চোখের কোটরে পচন ধরেছে। মোঃ শাহজালাল অভিযোগ করেন, তার চোখ তুলে নেয়ার ঘটনায় খালিশপুর থানার ওসি মোঃ নাসিম খানসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে গত ৭ সেপ্টেম্বর তার মা রেনু বেগম খুলনা মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেছেন। মামলা নং সি.আর- ৩০৯/১৭। ওই মামলা প্রত্যাহারের জন্য পুলিশ তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। তাদের বলা হচ্ছে, মামলা প্রত্যাহার করা না হলে আরও অনেক মিথ্যা মামলা দেয়া হবে। পুলিশের হুমকির মুখে তার পরিবার পরিজন এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তিনি বলেন, পুলিশ তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী, হত্যাকারী, ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারী, ডাকাত ইত্যাদি অপপ্রচার চালাচ্ছে। পিরোজপুরের কাউখালী থানায় একটি আত্মহত্যা প্ররোচিত পুরনো মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে ডা-াবেড়ি পরিয়ে তার সঙ্গে চরম অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। শাহজালাল নিজের এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার দাবি করেছেন। তার পচন ধরা দুই চোখের সুচিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। এদিকে আদালতে মোঃ শাহজালালের মায়ের দায়েরকৃত মামলার পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্ধারিত তারিখের দুই দিন আগে বাদীপক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করায় মামলার তদন্ত কাজে প্রভাবিত করা বা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে ছিনতাই মামলার বাদী ও আদালতে দায়ের করা মামলার আসামিদের পক্ষ থেকে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী মিনা মিজানুর রহমান বলেন, চোখ হারানো শাহজালাল সাধারণ মানুষ। তার পরিবারের সদস্যরাও তাই। তারা কোন প্রভাব খাটাতে পারে না। তিনি বলেন, শাহ জালাল ও তার পরিবারকে মানবিক কারণে এবং তাদের অসহায়ত্বের জন্য আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা আইনী সহায়তা দিচ্ছে। তিনি বলেন, শাহ জালালের মায়ের দায়েকৃত মামলার আসামি পুলিশ কর্মকর্তারা এখনও খালিশপুর থানায় কর্মরত রয়েছেন। এ কারণে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দুই চোখ হারানো শাহজালাল ও তার পরিবারের সদস্যরা। শাহজালালের মায়ের করা মামলাটিও তদন্তে প্রভাবিত হতে পারে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ মানবাধিকবার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনার সমন্বয়কারী এ্যাডভোকেট মোঃ মোমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা আশা করেছিলাম মামলার তদন্ত চলাকালে ওসি মোঃ নাসিম খানকে খালিশপুর থানা থেকে প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু তাকে প্রত্যাহার না করায় তিনি অন্যায় প্রভাব খাটাচ্ছেন। তিনি শাহজালালের মানবাধিকার রক্ষার দাবি জানিয়েছেন। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি)-এর পুলিশ কমিশনার মোঃ হুমায়ুন কবির পিপিএম বলেন, এ ব্যাপারে লোকাল অথরিটি তদন্ত করেছে এবং পুলিশের হেড কোয়ার্টার থেকে তদন্ত করে গেছে। আদালতের নির্দেশে পিবিআই ঘটনাটির তদন্ত করছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আদালতে মোঃ শাহজালালের মায়ের দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ইন্সপেক্টর মোঃ বাবলুর রহমান খান বলেন, মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ। তদন্তের কিছু কাজ এখনও বাকি রয়েছে। যে কারণে আদালতের কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন জানানো হবে। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কিছু বলা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত গত ৭ সেপ্টেম্বর মোঃ শাহজালালের মা মোছাঃ রেনু বেগম বাদী হয়ে মুখ্য মহানগর হাকিমের আমলী আদালত খুলনার খালিশপুর থানার ওসি মোঃ নাসিম খানসহ ১৩ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করে শুনানি শেষে ১৭ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন। ওই দিন আদালত মামলার পরবর্তী দিন ১৮ অক্টোবর ধার্য করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়।
×