ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৩ মে ২০১৭

বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ

ডি. এই তালেবুন নবী, চাঁপাবইনবাবগঞ্জ ॥ একদিকে লাল মাটির শিল্প বরেন্দ্রর মাটির দোতলা ভবন অপরদিকে রবি ঠাকুরের অন্যতম কাব্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ এখন অনেকটাই অদৃশ্য। পাশাপাশি রয়েছে মোবাইল টাওয়ার। যা এখন প্রকৃতির অভিশাপ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নতুন হাট এলাকা। যা বটতলামুখী হয়ে বেরিয়ে মিশে গেছে দারিয়াপুরের শেষ মাথায় চাঁপাই- রাজশাহী মহাসড়কে। নতুন হাট এলাকায় কোয়ার্টার মাইলের মধ্যে পাকা দ্বিতলা ভবনের ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে একাধিক মোবাইল টাওয়ার। টাওয়ার থেকে নিঃসৃত রেডিয়েশনের মাত্রা এখন রূপান্তরিত হয়েছে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। মরে যাচ্ছে বড় বড় উঁচু ডাব গাছ ও সুপারি গাছ। মরে যাচ্ছে বাবু ও চড়ুই পাখিসহ সব ধরনের ছোট পাখি। এরা পঙ্গু হয়ে পড়েছে প্রজনন ক্ষেত্রেও। এই ধরনের পরিবেশ ঝুঁকিতে পড়েছে পুরো এলাকা। আবার আকাশে মেঘ ডাকলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। আগে বড় বড় বটগাছ, তালগাছ ও সুপারি গাছ মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত বলে বজ্রপাত হতো এসব গাছের ওপর। এখন বরেন্দ্র তাল গাছ শূন্য হয়ে পড়ায় বজ্রপাতের লক্ষবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মোবাইল টাওয়ার। যার কারণে হাইকোর্ট সাম্প্রতিক তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে মূল্যায়ন প্রতিবেদন নিতে স্বাস্থ্য বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই মোতাবেক তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ হয়েছে। যার আলোকে তিনটি প্রতিবেদন হলফনামা আকারে তৈরি করা হয়েছে। এই তথ্য স্বাস্থ্য সচিবের আদালতের নির্দেশ মোতাবেক মোবাইল টাওয়ার স্থাপন ও ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি করেছে বিটিআরসি। এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার হয়তবা কমে আসবে। পাশাপাশি রক্ষা হবে পরিবেশগত ভারসাম্য। বজ্রপাতের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ পুরো উত্তরাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। চলতি বছরে বজ্রপাতের তীব্রতা অনেক বেশি। এদিকে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের দিকে নজর দিলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ আর আগের মতে চোখে পড়ে না। এক সময়ে বরেন্দ্র মানে সারি সারি বহু উঁচু উঁচু তালগাছ। গত দুই যুগে পুরো বরেন্দ্রর ২৫ উপজেলায় ৩০ লাখ তালগাছ কাটা হয়েছে। আর্থিক কারণ, অনাটন ও পরিবেশ সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকার কারণে আকাশের দিকে উকি মারা শতবর্শী তালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তালগাছ শূন্য হয়েছে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে। উজাড় বলতে যা বোঝায় তাই হয়েছে। তবে নির্জন বরেন্দ্র অঞ্চলে মালিকের চেয়েও কয়েক হাজার গুণ বেশি তালগাছ কেটেছে চুরি করে একশ্রেণীর সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। জনশূন্য বরেন্দ্রতে দিনের বেলা কিংবা রাতের বেলা মেশিনের করাত লাগিয়ে শথ শত তালগাছ কেটে, ট্রাক লাগিয়ে তুলে নিয়ে গেছে। এই গাছ কাটার দৃশ্য ছিল কয়েক বছর ধরে। যার কারণে পুরো বরেন্দ্রতে তালগাছ দেখা যাচ্ছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যতম শিল্প ছিল মাটির দোতলা ভবন। মাটির দোতলা গৃহ নির্মাণে পাকা তাল গাছের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়াও দৈনন্দিন কাজে ও গৃহস্থ জীবনে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল তালগাছ। তাল সংস্কৃতি বরেন্দ্রর ঐতিহ্যবাহী বাঙালা সংস্কৃতিতে ভরা। নওগাঁর নিয়ামতপুর, রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা, নাচোল, গোমস্তাপুর ও পারবর্তীপুর আড্ডায় তালের বাগান ছিল। এসব বাগানে ভাদ্র মাসে তাল পাকার সময় আদিবাসীদের তরুণ দামাল ছেলেদের লেগে থাকত আনন্দের উৎসব। পরিবেশবিদদের ভাষ্যে একদিকে বরেন্দ্রসহ পুরো জেলায় উঁচু তালগাছ না খাকায় বজ্রপাতে অধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলকে বাঁচাতে নতুন করে তালগাছ লাগাতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চল রক্ষায় এটাই একমাত্র অনস্ব^ীকার্য কাজ। ফলজ গাছের পাশাপাশি সরকারী সড়ক ও ব্যক্তিগত জমির আইলে তালগাছের চারা রোপণ করা খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সাড়াও মিলেছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। পরিবেশ মন্ত্রণালয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহগযোগিতা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে কয়েক লাখ তালগাছ রোপণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তালগাছের চারা পাওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র বর্ষা মৌসুমে ভাদ্র মাসে তালের আঁটি সংগ্রহের চেষ্টা করলে তালের চারা তৈরি করতে পারবে। এই কাজে আগাম রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের উদ্যান বেশ বা আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাগারকে তালের চারা তৈরির টার্গেট বেঁধে দিলে এই কর্মসূচী সফল করা সম্ভব হবে। এই অঞ্চলে রয়েছে একাধিক হর্টিকালচার বেস ও আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাগার। তারাই সরবরাহ করতে পারে তালগাছের চারা।
×