ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নিষিদ্ধের পর হিযবুত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নাম নিয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৩ মার্চ ২০১৫

নিষিদ্ধের পর হিযবুত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নাম নিয়েছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের প্রত্যক্ষ মদদ আর সহযোগিতায় ধাপে ধাপে জন্ম নেয় উগ্র-মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। বাংলাদেশে আধুনিক জঙ্গীবাদ চালু করতে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম শুরু হয় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে হিযবুত তাহরীরকে ছাত্রশিবির তাদের নিজস্ব ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কাঁটাবনের খায়রুন্নেছা ভবনে অফিস করে দিয়েছিল। হিযবুত তাহরীরের ৮৫ ভাগ সদস্যই ছাত্রশিবিরের। জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত থাকার দায়ে নিষিদ্ধ হয় দলটি। নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলটির সদস্যদের সমন্বয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম গড়ে উঠে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে হিযবুত তাহরীরের জন্ম ॥ ১৯৫৩ সালে পূর্ব জেরুজালেমের সাবেক বিচারক তাকিউদ্দিন আল নাবানীর হাত ধরে জন্ম হয় হিযবুত তাহরীরের। প্রথমদিকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বিশ্বে ইসলামী শাসন কায়েম করার লক্ষ্য নিয়েই দলটি কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে জেরুজালেমের প্রধান মুফতি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসিদের সহযোগী শেখ হাজী আমিন আল হোসাইনীর উগ্র-মতবাদে সংগঠনটি প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সংগঠনটি বিশ্বে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। ২০০২ সালে ডেনমার্কে ইহুদী দেখামাত্র হত্যার ঘোষণা দিয়ে লিফলেট বিতরণ করে। ২০০৩ সালে তেলআবিবে এক মদের দোকানে বোমা হামলা করে ৩ জনকে হত্যা, ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তানের মার্কিন ও ইসরায়েলী দূতাবাসে আত্মঘাতী বোমা হামলা, ২০০৪ সালে তাজিকিস্তানের তাসখন্দ এলাকায় বোমা হামলা করে ৪৭ জনকে হত্যার অভিযোগ উঠে সংগঠনটির বিরুদ্ধে। এছাড়া সংগঠনটির বিরুদ্ধে আল কায়েদা ও বৈশ্বিক জিহাদের জন্য কর্মী সংগ্রহে জড়িত থাকার আন্তর্জাতিক অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে পাকিস্তানে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হয়। বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের জন্ম ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করেন। নব্বই দশকের শেষদিকে অধ্যাপক গোলাম মাওলা কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান। লন্ডনে পড়াকালীন হিযবুত তাহরীরের লন্ডন শাখার নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। জড়িয়ে পড়েন সংগঠনটির কার্যক্রমের সঙ্গে। দীর্ঘ সময় অবস্থানের কারণে তিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্বও লাভ করেন। নাগরিকত্ব লাভের পর তিনি পুরোপুরি হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটেনের বিতর্কিত লোকজন তার কাছে যাতায়াত করতে থাকেন। শুরু হয় তার ওপর ব্রিটেনের গোয়েন্দাদের নজরদারি। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ গোয়েন্দারা গোলাম মাওলা জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত বলে নিশ্চিত হয়। তাকে লন্ডন পুলিশ গ্রেফতার করে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। তাঁর ওপর নজরদারি বাড়িয়ে দেয় ব্রিটেনের গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের নজরদারির কারণে গোলাম মাওলার ব্রিটেনে অবস্থান কঠিন হয়ে পড়ে। হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম ॥ অধ্যাপক গোলাম মাওলা দেশে ফিরে পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ২০০২ সালে ডিসেম্বরের শেষদিকে হিযবুত তাহরীরের বাংলাদেশ শাখা গঠনের চেষ্টা করতে থাকেন। যোগাযোগ করেন জামায়াতপন্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও এনজিওর সঙ্গে। গোলাম মাওলার সঙ্গে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ। যোগাযোগের একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন বাংলাদেশের যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে পরিচালিত এ্যাকশন এইড নামের এনজিওর পলিসি এনালিস্ট শেখ তৌফিক। পরবর্তীতে এনজিওর চাকরি ছেড়ে শেখ তৌফিক বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিএনপি-জামায়াত শিবিরের সহায়তা ॥ বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০২ সালে শেখ তৌফিকের এনজিওর উত্তরা অফিসেই হিযবুত তাহরীরের ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদকে প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র, কাজী মোরশেদুল হককে যুগ্ম-সমন্বয়কারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলাকে সিনিয়র উপদেষ্টা, শেখ তৌফিককে রাজনৈতিক উপদেষ্টা, প্রিন্সিপাল মাওলানা মামুনুর রশীদকে গণসংযোগ সচিব, অধ্যাপক মুস্তফা মিনহাজকে মিডিয়া ও প্রচার সচিব এবং সাখাওয়াত হোসেন, মামুনুর রশীদ আনসারী, আহাম্মদ জামান, ডা. সাঈদ, মনির হোসেন, ডা. গোলাম মোস্তফা ও শাহজালাল মিয়াকে কার্যকরী কমিটির সদস্য করা হয়। কমিটি গঠনের পর পরই সংগঠনটি বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ সুবিধাজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ শুরু করে। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ আর সহায়তায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশে দলটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দেয়। মার্চ থেকেই সংগঠনটি আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩ শীর্ষ নেতার সংখ্যা অনুযায়ী ১৩টি গোপন আস্তানা গড়ে তুলে সংগঠনটি। জামায়াত-শিবিরের প্রত্যক্ষ মদদ ॥ হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম চালানোর জন্য দলীয় কার্যালয় স্থাপন জরুরী হয়ে পড়লে এগিয়ে আসে জামায়াত-শিবির। জামায়াতের নির্দেশে ছাত্রশিবির তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ২৩৪ নম্বর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের খায়রুন্নেসা ভবনের নিজস্ব ঘাঁটিতেই হিযবুত তাহরীরকে দলীয় কার্যক্রম চালানোর জন্য অফিস খুলে দেয়। পরবর্তীতে জামায়াত-শিবির তাদের আধিপত্য থাকা রাজধানীর পুরানা পল্টনের ৫৫/এ নম্বর এএইচএম সিদ্দিক ম্যানসনের পঞ্চম তলায় হিযবুত তাহরীরকে প্রধান কার্যালয় খুলে দেয়। হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ সব সরকারী বেসরকারী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিযবুত তাহরীর কার্যক্রম চালাতে থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো আস্তানা গড়ে তুলে সংগঠনটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও বনানী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয় হিযবুত তাহরীর। এ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠচক্রের আড়ালে সংগঠনটি গোপন কার্যক্রম চালাতে থাকে। দলের সদস্যদের শতকরা ৮৫ ভাগই ছাত্রশিবিরের সদস্য। অপেক্ষাকৃত ধনাঢ্য পরিবারের মেধাবী সন্তান ছাড়াও কাউকে সংগঠনের সদস্য করা হয় না। যে ধনাঢ্য মেধাবী ছাত্র গ্রেফতার হওয়ার পর নিজ খরচায় বা পরিবারের ক্ষমতাবলে জামিনে মুক্ত হতে না পারবে, তাদের হিযবুত তাহরীরের সদস্য করা হয় না। বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ ॥ ২০০৯ সালে জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার দায়ে এবং আন্তর্জাতিক একাধিক জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পাকিস্তানের পর সর্বশেষ বাংলাদেশে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৫৩টি দেশে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। নিষিদ্ধের পর সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ॥ নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সারাদেশে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যালয়ে তল্লাশি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুরানা পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই, উগ্র-ভাষায় লেখা লিফলেট, কমান্ডো ট্রেনিং বেল্ট, বিভিন্ন দেশের জঙ্গী প্রশিক্ষণের ভিডিওফুটেজসহ নানা আলামত উদ্ধার হয়। আর সিলেট বিভাগের ৪টি জেলায় হিযবুত তাহরীরের অফিসে তল্লাশিতে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই, লিফলেট, কম্পিউটার সিডিসহ বহু আপত্তিকর আলামত। এরপর থেকে চলমান ধারাবাহিক অভিযানে দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ অন্তত তিন শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ২ শতাধিক জামিনে মুক্ত। নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য হওয়ার কারণে জামিনে অসুবিধা হওয়ায়, তাদের ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে জামিনে বের করে নেয়া হয়েছে। হিযবুত থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ॥ হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলের সদস্যরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে সংগঠিত হতে থাকে। পুরনো আস্তানা পরিবর্তন করে নতুন আস্তানা গড়ে তুলে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের জঙ্গী সংগঠনটির অস্তিত্ব প্রকাশ পায় ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর পল্লবী থানাধীন পলাশনগরের ৫৬/৩ নম্বর নিজবাড়ির সামনেই শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে (৩৭) ছুরিকাঘাতে ও জবাই করে হত্যার পর। রাজীবের জানাজা নামাজ আদায়কারী ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসে সোমবার সকালে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত শাফিউর রহমান ফারাবী। ইমামকে হত্যার পর ২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় ফারাবী। ফারাবী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দলের নির্দেশে তিনি হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত হন। ফারাবীর তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ১ মার্চ রাজীব হত্যায় জড়িত রাজধানীর বনানীর বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ছাত্রÑ ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), এহসান রেজা ওরফে রুম্মন (২৩), নাইম শিকদার ওরফে ইরাদ (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজকে (২২) গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা রাজীবকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীতে তারা হিযবুত তাহরীরের সদস্য বলে জানায়। দলটি নিষিদ্ধ হলে তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে সংগঠিত হয়। এক বড়ভাইয়ের নির্দেশে ঈমানী দায়িত্ব পালন করতেই তারা রাজীবকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করে। এছাড়া বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দ্বীপকে কুপিয়ে হত্যাকারী বুয়েটছাত্র মেজবাহ উদ্দিনই গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। তিনিও ঈমানী দায়িত্ব পালন করতেই দ্বীপকে হত্যা করেছেন বলে দাবি করেন। মেজবাহ উদ্দিন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীর অনুসারী।
×