ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

তাহিরা খাতুন সান্তনা

তবু সফল সফর টাইগারদের

প্রকাশিত: ০৭:১১, ৮ আগস্ট ২০১৮

তবু সফল সফর টাইগারদের

নিজেদের মাঠে সেই ২০১১ সালে একবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি২০ সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এরপর আর ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সিরিজ জেতা হয়নি কোন ভেন্যুতেই। কিন্তু এবার সেই ক্যারিবীয়দের মার্কিন মুলুকে পরাস্ত করল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। অবিশ্বাস্যভাবেই এমন কীর্তি দেখিয়েছে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে টাইগাররা একেবারে অচেনা পরিবেশে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে। টেস্ট খেলুড়ে কোন দেশের বিপক্ষে বিদেশের মাটিতে এই প্রথম টি২০ সিরিজ জেতার গৌরব দেখিয়েছে টাইগাররা। অথচ ঘরের মাঠে কিংবা দেশের বাইরে- গত তিন বছরে টি২০ ফরমেটে কোন সিরিজ জিততে পারেনি বাংলাদেশ। মাঝে নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত সফর করেছে- টি২০ সিরিজ হারতে হয়েছে। এমনকি সর্বশেষ ভারতের মাটিতে উঠতি ক্রিকেট শক্তি আফগানিস্তানের কাছেও ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ হেরে টি২০ ফরমেটে নিজেদের খর্বশক্তির পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। কিন্তু নিরপেক্ষ ভেন্যু মার্কিন মুলুকের ফ্লোরিডায় এবার বর্তমান টি২০ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-১ ব্যবধানে সিরিজে হারিয়ে দিয়েছে টাইগাররা। অধিনায়ক হিসেবে সাকিব আল হাসানের প্রথম এবং বিদেশের মাটিতে ৬ বছর পর মাত্র দ্বিতীয়বার টি২০ সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। লডারহিলের সেন্ট্রাল ব্রোওয়ার্ড রিজিওনাল পার্ক স্টেডিয়াম টার্ফ গ্রাউন্ডে তৃতীয় ও শেষ টি২০ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বৃষ্টি আইনে ১৯ রানে হারিয়ে এই অবিস্মরণীয় বিজয় ছিনিয়ে আনে টাইগাররা। এ কারণে ব্যাটে-বলে এবং নেতৃত্বে দুরন্ত সাকিব সিরিজসেরা হয়ে সতীর্থদের পারফর্মেন্স এবং দলের সবার আত্মবিশ্বাসকেই এ জয়ের পেছনে মূল কারণ হিসেবে দাবি করেছেন। কারণ সিরিজের শুরুটাই হয়েছিল হার দিয়ে এবং চিরাচরিত নিয়মে সবাই ধরে নিয়েছিলেন আগের মতোই সিরিজ হারবে বাংলাদেশ দল। এ কারণে সবাই চেয়েছিলেন টাইগাররা অন্তত লড়াই করুক। সেখানে এমন একটি বিজয় এনে দেশকে গর্বিত করেছে টাইগাররা। টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ একেবারেই নস্যি! আর অধিনায়ক যখন সাকিব তখন তো দলের পারফর্মেন্স যাচ্ছেতাই। যদিও তিনি ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে সবসময়ই দেশের অন্যদের ছাড়িয়ে। তবে দলের পারফর্মেন্সটা কখনও তার অধীনে ভাল হয়নি। ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে যাত্রা শুরু করেছিলেন সাকিব। ফ্লোরিডায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ টি২০ ম্যাচ ছিল তার ক্যারিয়ারের যুগপূর্তির দিন। সেই সঙ্গে অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবার টি২০ সিরিজ জেতার মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগানোর ম্যাচ। সে ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাটিং নেন সাকিব। শুরুটা তরুণ ওপেনার লিটন দাস করেন দুর্ধর্ষ ব্যাটিংয়ে। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে তিনি তামিম ইকবালকে নিয়ে এ্যাসলে নার্সের বোলিংয়ে ১৭ এবং চতুর্থ ওভারে আন্দ্রে রাসেলের ওভারে ১৯ রান তুলে নেন। উদ্বোধনী জুটিতে ওঠে মাত্র ২৮ বলে ৬১ রান। পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে ২ উইকেটে ৭১ রান তুলে দারুণ অবস্থানে চলে যায় বাংলাদেশ। আর সেই ভিতেই দাঁড়িয়ে বড় সংগ্রহের পথ পেয়ে যায় বাংলাদেশ দল। লিটন ২৪ বলে অর্ধশতক হাঁকিয়ে শেষ পর্যন্ত ৩২ বলে ৬ চার, ৩ ছক্কায় ক্যারিয়ারসেরা ৬১ রান করে সাজঘরে ফিরে যান। অথচ ক্যারিয়ার ৩ বছর আগে শুরু করলেও আহামরি কোন ইনিংস উপহার দিয়ে আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন লিটন। বাংলাদেশ দলের সাফল্য এতদিন শুধুই নির্ভরশীল ছিল পঞ্চপা-ব- মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহীম, তামিম, সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ওপর। এবার যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন লিটন, হলেন ম্যাচের সেরা পারফর্মার। তিনি সাজঘরে ফিরলেও ততক্ষণে শক্ত অবস্থানেই পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ৫ উইকেটে ১৮৪ রানে থামে বাংলাদেশের ইনিংস। এটি ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ টি২০ সংগ্রহ। এর আগে ২০১২ সালে ঢাকায় ১ উইকেটে ১৭৯ রান ছিল সর্বোচ্চ। জবাব দিতে নেমে মাত্র ৩২ রানেই ওপেনার আন্দ্রে ফ্লেচার (৬), চ্যাডউইক ওয়ালটন (১৯) ও মারলন স্যামুয়েলসের (২) উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সম্মিলিত বোলিং নৈপুণ্যে ক্যারিবীয়দের চেপে ধরে বাংলাদেশ আর তাতেই পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে মাত্র ৩২ রান তুলে চাপে পড়ে যায় ক্যারিবীয়রা। সেখান থেকে আর সহজে বের হতে পারেনি তারা। শেষদিকে রাসেল যেভাবে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিলেন তাতে অবশ্য ম্যাচ বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে শুরু করেছিল। কিন্তু ১৮তম ওভারের প্রথম বলেই তাকে আরিফুলের দুর্দান্ত ক্যাচে শিকার করে টাইগার শিবিরে স্বস্তি আনেন কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। রাসেল ২১ বলে ১ চার, ৬ ছক্কায় ৪৭ রানের টর্নেডো ইনিংস খেলেছিলেন। ওই সময় ক্যারিবীয়দের সংগ্রহ ছিল ৭ উইকেটে ১৩৫। ১৭.১ ওভার খেলা হয়েছে; ১৭ বলে তখনও ৫০ রান প্রয়োজন তাদের ম্যাচ ও সিরিজ জেতার জন্য। কিন্তু বৃষ্টি আর তাদের লড়তে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথডে ১৯ রানে বাংলাদেশকে বিজয়ী ঘোষণার পরই ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে মাঠে ঢুকে উল্লাস করেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। মুস্তাফিজ ৩১ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ক্যারিবীয় ইনিংসে মূল ধ্বংস চালিয়েছেন। এই তিন উইকেট শিকারের মাধ্যমে তিনি টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক উইকেট শিকারে উঠে এসেছেন তিন নম্বরে, ৪২ উইকেট পেয়ে অবসরে যাওয়া মাশরাফি পড়ে গেছেন পেছনে। ৪৪ উইকেট নিয়ে দুইয়ে বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক এবং ৮০ উইকেট নিয়ে এক নম্বরে সাকিব। ২০১৫ সালে সর্বশেষ টি২০ সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। সেটি অবশ্য ১ ম্যাচের সিরিজ ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। এরপর গত ৮ সিরিজের ৫টিতেই হার এবং তিনটি ড্র করতে পেরেছিল। আর ২০১২ সালে আয়ারল্যান্ড সফরে ৩-০ ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করে দেশে ফিরেছিল টাইগাররা। বিদেশের মাটিতে টি২০ সিরিজ জয় সেই একটাই। ৬ বছর পর আবারও বিদেশের মাটিতে টি২০ সিরিজ জয়টি আসলো অধিনায়ক সাকিবের হাত ধরে এবং সেটি বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে। সবমিলিয়ে এটি বাংলাদেশের পঞ্চম টি২০ সিরিজ জয়। ২০০৬ সালে নিজেদের প্রথম টি২০ সিরিজে ঘরের মাঠে জিম্বাবুইয়েকে ১-০, ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২০১১ সালে ১-০, আয়ারল্যান্ডে ২০১২ সালে ৩-০, ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে পাকিস্তানকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়েছিল বাংলাদেশ দল। তবে টেস্ট খেলুড়ে কোন দেশকে টি২০ সিরিজে দেশের বাইরে সিরিজ হারানোর গৌরব এই প্রথম দেখালো বাংলাদেশ দল। ভারমুক্ত হলো পঞ্চপা-ব- সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফি ও মাহমুদুল্লাহ। এই কয়েকজনের হাতেই এতদিন বিজয় রচিত হয়েছিল। তরুণরা টাইগারদের বিজয়ে অবদান রাখতে পারছিলেন না। এ ম্যাচে সেই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে বাংলাদেশ। ২৩ বছর বয়সী তরুণ ওপেনার লিটন ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলে হয়েছেন ম্যাচসেরা। আর সাকিবও হয়তো অনেকখানি ভারমুক্ত হলেন। কারণ দ্বিতীয় দফায় গত অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টি২০ অধিনায়ক হওয়ার পর থেকেই চাপে ছিলেন তিনি। টানা ৭ ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে মাত্র একটি জয় এনে দিতে পেয়েছিলেন। সবমিলিয়ে ১১ টি২০ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে ১ জয়, ১০ পরাজয়ে বিপর্যস্ত ছিলেন অধিনায়ক সাকিব। কিন্তু এবার সিরিজ জেতালেন, নিজে হলেন ব্যাটে-বলে অসামান্য অবদান রেখে সিরিজসেরা খেলোয়াড়। এ কারণেই তিনি ম্যাচশেষে বলেন, ‘অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্স পেলাম আমার দলের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে। প্রথম ম্যাচ হারের পর সিরিজে ফিরে আসার জন্য আমাদের দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রয়োজন ছিল। দলের ক্রিকেটাররা সবাই সেই পারফর্মেন্সটা দেখিয়েছে। নিজেদের অনেক বেশি প্রদর্শন করেছে তারা। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল এই অবস্থা থেকেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের মোকাবেলা করেছি এবং সেই মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ করেছি। এই মাঠে খেলতে গিয়ে আমাদের কখনই মনে হয়নি যে ঘরের বাইরে খেলতে নেমেছি।’ তার কথার প্রমাণ অবশ্য দর্শক উপস্থিতিতেই পাওয়া গেছে। অধিকাংশ সমর্থনই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। প্রায় ৫ হাজার দর্শক ছিলেন শেষ ম্যাচে। আর সে কারণেই ক্যারিবীয়দের দর্পচূর্ণ করা গেছে। অথচ এই ভেন্যুতে আগে চার ম্যাচ খেলেও হারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৩ জয়ের বিপরীতে একটি পরিত্যক্ত রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে টানা দুই ম্যাচ হারল তারা। এর পেছনে সাকিবের অসামান্য নৈপুণ্যই হয়তো বড় ভূমিকা রেখেছে। অধিনায়ক হিসেবে সমালোচিত সাকিব শেষ দুই ম্যাচে ক্যাপ্টেন্সিতেও নজর কেড়েছেন আবার স্বীয় নৈপুণ্যেও ছিলেন ব্যাটে-বলে উদ্ভাসিত। এ কারণেই তিনি নিজের বিষয়ে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, পুরো সিরিজেই আমি ভাল ব্যাটিং করেছি। বলে ভালভাবে হিট করতে পারছিলাম। যেটা আমাকে ভাল বোলিং করতেও সহযোগিতা করেছে। একই সঙ্গে অধিনায়কত্ব করতেও সহযোগিতা করেছে।’ বেশ স্বচ্ছন্দ্যেই ছিলেন সাকিব- কারণ ফ্লোরিডায় তার সহধর্মিণীর আবাসস্থল হওয়াতে অনেকবার এসেছেন এবং ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (সিপিএল) টি২০ আসরে ৫ ম্যাচ খেলে বেশ পরিচিত ভেন্যু এটি তার। তার এই মাঠের সঙ্গে পরিচিতিই হয়তো কাল হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য। সিরিজসেরা হয়ে সাকিব তার ক্যারিয়ারের যুগপূর্তিতে পেলেন অনেক বড় কিছু, বাংলাদেশও আরেকবার হলো গর্বিত।
×