ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বন কুসুম

রাজকুমার শেখ

প্রকাশিত: ২১:৫১, ৭ এপ্রিল ২০২৪

বন কুসুম

.

ভোরের ঝাঁজ লেগেছে পুব আকাশেগত কালকের নিকোনো উঠানে এখনো ঝাঁট পড়েনিআলমতারা উঠবো উঠবো করছেগোয়ালে বাঁধা গরুটা বিয়াবো বিয়াবো করে আছেগরুটা নিয়ে ওর খুব চিন্তাদরু খুব যত্ন করে গরুটারও এলেই গরুটার কাছে গিয়ে দেখেদরু আলমতারার কেউ হয় নানাশু বেঁচে থাকতে দরু আসতোএক সঙ্গে জন খাটতো জমিতেনাশুর যেদিন কাজ থাকতো না সেদিন দরু এসে হাজির হতো ওদের বাড়িতেনাশুর হঠা চলে যাওয়াটা আলমতারা মেনে নিতে পারেনিআলমতারার পেটে সন্তান আসেনিনাশু সত চেষ্টা করেও তার সন্তান হয়নিকত কবিরাজ, বৈদ্য, গাছ গাছরা করেও আলমতার পেটে সন্তান এলো নানাশুর পাশে রাতে শুয়ে আলমতারা কাঁদতো

ওগা তাহলি আমার পেটে কি কেউ আসবি না?

অত উতাল হয়োনি আলমখোদার ঘরে গিয়ে বলেছি হাত তুলে, খোদাগো, আলমের পেটে সন্তান দাও দেনিখোদা এই গরিব মানুষের কথা রাখবিনে? মনটা খারাপ করিসনে আলমআয় কাছে আয়

নাশু কথা শেষ করে আলমকে পাশে টেনে নেয়ওর খসখসে হাত দিয়ে ওকে আদর করতে থাকেজিয়ালা মাঠে শিয়াল ডাকছেআলমতারা নাশুকে চেপে ধরেনাশুর বুকে লেপ্টে যায়আলমতারা ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নেয়রাত গভীর হতে থাকে

আলমতারা ভাবে কথাগুলোমনে হয় এইতো গত রাতের কথানাশু বিছানা ছেড়ে উঠবেতারপর বাড়ির পিছনের খেজুর গাছ থেকে রস নামাবেতারপর সেই রস ও নিজে হাতে জ্বাল দেবেগুড় হবেসেই গুড় আলমতারা দেয় পাড়া প্রতিবেশীকেওর বাপের বাড়িতও দেয়এখন আর নগর তার যাওয়া হয় নাবাপটার মুখ তার খুব মনে পড়েওর মা নেইসেই কবে মরে গেছেআলমতারা তখন খুব ছোটমায়ের মরা মুখটা দেখিয়ে ছিল কে যেন কোলে করেমায়ের মুখটা তার আবছা মনে আছেওর চার ভাই বোনআলমতারা সবার ছোটওর বাপ ফরিদ মিয়া কখনো কোল ছাড়া করতো নানিজ হাতে খাইয়ে দিতফরিদ মিয়া পরের জমিতে চাষ করতোএক জোড়া গরু ছিলওদের চায়ের ওপর নির্ভর করে সংসার চলতোএমনি করেই তার ভাই বোনদের বিয়ে হয়ফরিদ মিয়া কখনো বিপদে পড়লে বলতেন, ও আলম মা, সব ঠি করি দেবেরে ওপরওয়ালাখোদা আছে সঙ্গে

অথচ চোখের জল তিনি লুকিয়ে রাখলেও ছোট মেয়ের চোখে পড়ে যেতেন ধরাছোট আলমতারা বাপের চোখের জল মুছিয়ে দিতফরিদ মিয়া আলমতারাকে বুকে নিয়ে কেঁদে ফেলতেনবাপটার কথা মনে পড়তেই আলমতারা কেঁদে ফেলেসকালটা কেমন যেন বিষণœ হয়ে যায়বাপের মুখটা মনে পড়েকতদিন দেখে না তার জন্ম ভিটেতার বাপও আসতে পারেন নাবয়স হয়েছেএখন কোথাও আর যান না

রোদ এসে পড়েছে ওদের উঠোনময়বাঁশবনে একটা ছাতার ডাকছেআলমতারার এই সব সঙ্গী এখনওদের সঙ্গে ও কথা বলেদরু আসে মাঝেমধ্যেকথা হয়দরু মাটির দাওয়ায় বসে বিড়ি টানেফিক ফিক করে হাসে আর আলমতারার সঙ্গে গল্প করেপাড়া প্রতিবেশী ফিসফাস করেকিন্তু আলমতারা পাত্তা দেয় নানাশুর গল্প বলে দরুআলমতারা কান করে শোনে সে কথামানুষটা নেই তো মনে হয় কিছুই নেইসব ফাঁকাবিছানাটা কাঁটা মনে হয়রাতে অনেক দেরি করে ঘুম আসেসংসারটা চালাতে বেশ কষ্ট হয়রেশনের চালটা পায় বলে দুমুঠো ভাত জোটে তারনাশুর জমি জিরাত বলতে এই বসত বাড়িটুকুও যখন চলে যায় তখন ঘরে মাত্র এক হাজার জমানো টাকামুঠির কেজি দশেক চাল ছাড়া আর কিছু ছিল নাওর বড় বোনাই নাদের সেই সময় ওকে কিছু নগদ দিয়ে ছিলদরু যত টুকু পেরেছিল আলমতারার হাতে গুঁজে দেয়আলমতারা কেমন অবাক হয়ে দরুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেমানুষটিকে সে ভাবে ও কোনো দিন গুরুত্ব দেয়নিদরু নাশুর জন্য খুব কেঁদেছিলদরুরও তেমন কেউ নেইমানুষটির জন্য ওর মায়া হয়দরু একদিন না এলে কেমন যেন লাগে তারদুটো মনের কথা আদান-প্রদান করে ওরাকত গল্প হয়রাত নামার আগেই দরু চলে যায়তার লম্বা লম্বা পা ফেলে বাঁশবনের আড়ালে চলে যায়দরু বেশ লম্বা চওড়াবুকের ছাতিটা যেন বোশেকের ছাদের মতো পিটানোসে যতœ নেয় নানিজ হাতে দুটো ভাত ফুটিয়ে নেয়কোনো রকমে দুটো মুখে দিয়ে চলে আসে আলমতারার কাছেমাঠে গেলে সেদিন ওর দেরি হয়আলমতারা বার দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেকখন দরুর পায়ের শব্দ পাবে সে

কেন যে এমন হয় ও জানে নানাশুর জন্য প্রথম প্রথম এমন হতোদুপুরের রান্না শেষ করে আলমতারা বসে থাকতোকখন নাশু আসবেএক সঙ্গে বসে দুজনে খাবেনাশু ওকে বলতো, আলম, বসি থেকি কি হবে? খেয়ি নিতে হয়আমি কাজের মানুষকখন ফিরি না ফিরি তার কি ঠিক আছে? শরীলটা ভেঙে যাবেনি আলম?

তুমি না এলি খেতে মন করেনি গো! একা কি আর ভালো লাগে?

ওঃ! সেই এক কথা

নাশু বেশ বিরক্ত হয় এ কথা শুনেআলমতারা মুখ টিপে টিপে হাসে

হাগো- গো আমার জন্যি তুমার চিন্তা হয় না? মানুষটি শুকিয়ে বসি থাকে

ওরে পাগলী, আমি কি ভাবি না? আলম, দাও দেনি খেতেবড্ড খিদে পেয়েছেমন জান জুড়িয়ে যায় তুমার মুখ খানি দেখলে

নাশু একটু আধটু আদরের কথা বলেতাতেই আলমতারা আহ্ললাদে আটখানাপা পড়ে না মাটিতেআলমতারার বুকটা কেমন যেন করতে থাকে এ কথা শুনেনাশু দুপুরে খাবার খেয়ে ঘরে চলে যায়একটু গা গড়িয়ে নেবার জন্যআলমতারা ওর পাশে এসে বসেনাশুর কাজ করা খসখসে হাতে আলমতারাকে বুকে টেনে নেয়তারপর নাশু পুরুষালি ঠোঁট দিয়ে আলমকে চুম্বনে চুম্বনে ওর সারা শরীরে আলপনা আঁকতে থাকেসেই সময় আলমতারা এক ভালো লাগা আদরে যেন মরে যেতে ইচ্ছে করেবাঁশবনে ছাতারটা যেন চেঁচিয়ে সব মাথায় করবেওদের দুপুরটা এমনি করেই কেটে যায়এক সময় নাশু পাস ফিরে শুয়ে পড়েআলমতারার শরীরের মেটে মেটে গন্ধটা সারা ঘরে ভাসতে থাকেএই সুখ শুধু তার একারকিন্তু সে সুখ যে অচিন পাখির মতো এক লহমায় উবে যাবে তা কে জানতো? ওর বুকটা আনচান করতে থাকেমাটির ঘরে তার গায়ের গন্ধ হারিয়ে গেছেএখন আর ঘন ঘন ছাতার ডাকে নাওর মনের ভালো বাসার ডালপালা শুকিয়ে গেছেতার বসার আর জায়গা নেইকে আর তেমন করে ডাকবে? নাশুর পুরুষালি ঠোঁট দুটো খোঁজে আলমতারাউষ্ণ ঠোঁট কেমন করে সুখ খুঁজে চলতো তার সারা শরীরেসে গলে যেত তার উষ্ণতায় জ্যৈষ্ঠ দিনের ন্যাংড়া আমের মতোবিছানায় এখনো মানুষটির গায়ের গন্ধ লেগে আছেআজ আলমতারার বিছানা ছিড়ে উঠতে মন করছে নাছাতারটা ডাকছেনা- এবার উঠতে হবে

গরুটাকে চুনি দিয়ে খড় মাখিয়ে খেতে দেয়গরুটার বাচ্চা হলেও গাঁয়ে ঘরে দুধ বেচে দুটো পয়সার মুখ দেখবেনাশু ওকে এনেছিলতখন ও কত ছোট ছিলখুব যতœ করতোমাঠে থেকে আসার সময় ঘাস পাতা নিয়ে আসতোগরুটা নাক ডুবিয়ে খেতনাশু গায়ে হাত বুলিয়ে বলতো, আলম, গরুটার দুধ বেচি সংসারটা চলি যাবেকি বলিস?

ও আগে বড়ো হোকগাবিন হলি তো হয়

আলমতারা বলে কথাটা

হবি হবিআর কটা মাসতখন চোঙা ভরতি দুধআঃ!

তুমার জিবে পানি আসছি?

নাশু এ কথা শুনে হা হা করে হাসতে থাকে

তুমার পেটেও যদি একটি নতুন শিশু আসতো

আলমতারা এ কথার কোনো উত্তর দেয় নাওর চোখে জল চলে আসেগরুটাকে তার সন্তান মনে করেনাশু বড়ো আদর করেসে যেন ওর বাপগরুটাকে মনে মনে কত কথা বলেগরুটার কদিনে গা থেকে যেন তেল চুঁইয়ে পড়েগরুটা খুব খাবুটেযা দেয় তার সবটা খেয়ে নেয়লেজ নাড়তে থাকে আনন্দেআলমতারা ওর দেখভালের কোনো ত্রুটি করে নাবড়ো আদর দিয়ে ওকে একটু একটু করে বড়ো করে তোলে

এমন সময় গরুটা হাম্বা হাম্বা করে ডাক ছাড়েওকে খেতে দেয়আজ সকালে ওর উঠতে মন করছিল নাগত রাতে মাটির দাওয়ায় চুপ করে ও বসে আকাশের সোনার থালার মতো চাঁদ দেখছিলএমন রাতে নাশু ওকে আদর করে বলতো, আলম, তুমার মুখটা ওই আকাশের চাঁদটির মতক

দূর সে মুখ করি আর জন্ম হলি নামুখ না বাসি চুলার ছাই

আঃ! কি যে বলিস আলম!

না গোঅমন কথা বললি আমার শরম লাগি

একটু কাছে আয়

এই তো তুমার পাশে

তু খুব কথা বাড়াসচাঁদের আলোতে ফিং ফুটছেআয় মুখটা একটু দেখিমনটু আমার কেমন কেমন করছিরে আলম

আলম নাশুর শক্ত পোক্ত বাহুর মধ্যে ও নিজেকে সঁপে দেয়রাতের পেঁচা ডেকে উঠলো রাতকে চিরেহিম হিম ভাবটা উবে যায় নাশুর স্পর্শেনাশুর বুকের ওম নিতে থাকে ওরাতটা ধীর লয়ে কেটে যেতে থাকেআলমতারা কেমন এক আনন্দে গেয়ে ওঠে, আমার মন পাখি সুখ বোঝে না

কতদিন সে গান করে নাগানটা যেন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছেযে গান দিয়ে নাশুর মনকে বেঁধে ছিলনাশু আলমের গানে মজে ছিলরাত নামলেই নাশু আবদার করতো, ওরে আলম, হবি নাকি একটু গান টান?

আ - মরণ! তুমি না -

আরে - খেপি, মনটা যে কেমন কেমন করি

আলমকে নাশুর আবদার শুনতেই হয়আকাশে দেমাক নিয়ে চাঁদটা ঝুলে থাকেমিটমিট করে চেয়ে দেখে ওদের দুজনকেরাত সরে যায় এক সময় দামস বিলের দিকেওরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে এক পরম উষ্ণতায়যে উষ্ণতা তার সারা শরীরে এখনো লেগেএক সময় ও বিছানা ছেড়ে ওঠেরোদ উঠেছেচিকন লালি রোদেরবাতাসে একটা কি ফুলের গন্ধ বাতাসে মিশে গেছেবেশ নেশা লাগেআলমতারা সব ফুলের নাম জানে নাতবু এই গন্ধটা তার খুব ভালো লাগছেগোটা বাড়িতে মিশে গেছে সে গন্ধওর মন ভালো হয়ে যায়ও এক সময় কাজে ডুবে যায়ওর মন পাখিটা গাছের ডালে বসে ডাকতে থাকে

দুই

হাঁপাতে হাঁপাতে এলো দরুচোখে মুখে কেমন এক ভীতির ছাপও এসেই ধপাস করে বসে পড়ে মাটির দাওয়ায়আলমতারা তখন গাইটাকে বিচুলি খেতে দিচ্ছলোদরুর এমন হন্ত দন্ত হয়ে আসা দেখে ও বেশ অবাক হয়ে যায়বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেআলমতারা ওর কাছে এসে দাঁড়ায়

কি হল তুমার? অমন করছো যে

একটু সময় নিয়ে দরু বলে, ভাগ্যি জোর বেঁচি গেলাম

 কেনে? কি হলো?

আরে মিয়া বাড়ির গরুটা চড়তে চড়তে ঢুকি পড়ে বর্ডারেআমি গেছিলাম আনতিআর অমনি দুম দুম করে গুলিআমি জানটু লিয়ে পালিয়ে এলামআজ আর দেখতি হত না

আলমতারার বাড়ি বর্ডারের কাছেএখানে অনেক কিছুই ঘটেও কখনো চরের দিকে যায় না

তা তুমার আক্কেল টো কি? মিয়া বাড়ির গরু আর তুমি গেছিলা আনতিখোদার জান যদি এমন অপহেলায় চলি যেতক!

আলমতারার চোখটা কেমন চিকচিক করে ওঠেকি জানি মানুষার জন্য হঠা এমন মায়া হলো কেন? ওর জানে গিয়ে লাগেফ্যালফ্যাল করে দরু তাকিয়ে থাকে আলমের মুখের দিকেমানুষটিকে আজ তার বড়ো আপন মনে হয়দরুর খুব ইচ্ছে করছিল ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেএক সময় ও আলমের মুখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারে নাদরুর বুকটা গুলি খাওয়ার চেয়েও বেশি ধরপড় করতে থাকে আলমের জন্য।  হঠা এমন কেন হচ্ছে? দরু বেশ অবাক হয়আলমের মুখের দিকে ও তাকাতে পারে নাআষাঢ় এর নদীর মতো বুকটা কেমন ছলা ছলা শব্দ করতে থাকেযেন এখনই ভিজিয়ে দেবে আলমকেএমন সময় আলম বলে, তুমার যদি কিছু হতিক? ও কিছু নাএমন তো এখানটি চলেসেবার দেখলি না বাসার কিভাবে গুলি খেয়ে মারা পড়লোজেবনের কোন দামটি নেই!

বিষাদ গলাতে বলে দরু কথাটা

দাও দেনি একটু পানিগলাটা বড্ড শুকি গেছেজেবনটা যেন আর ধড়ে থাকতি চায়ছে না

আলম তাড়াতাড়ি জাম বাটিতে করে পানি এনে ওর সামনে ধরেদরু ঢকঢক করে পান করেযেন বৈশাখ মাসে মাটি ফাটার মধ্যে জল গলগল করে ঢুকে যাচ্ছেদরুকে দেখে ওর খুব মায়া হয়বেচারা সকালে কিছু খেয়েছে কি না? শুধু শুধু একটু পানিতে আর কি হবে?

তুমি একটু বসো

দরু বসে থাকেএকটু পরে আলম ওর জন্য রুটি আর সঙ্গে গুড় নিয়ে আসেদরু বড় বড় চোখ করে দেখে জল খাবারসত্যি তার সকালে কিছু খাওয়া হয়নিগোগ্রাসে ও খেতে থাকেআলমতারা আরও জাম বাটিতে করে জল এনে দেয়খাওয়া শেষ করে ও বলে, তুমি বড়ো আপন

আলমতারা কেমন লজ্জা পেয়ে যায়যেন নতুন বউগালে কি লাল আভা ফুটে ওঠে তার? ছাতারটা হঠা করে ডেকে ওঠেওর বুকেই কি? দরু ওকে দেখছে বিড়ি টানতে টানতেওর চোখ দুটিতে আজ ফাগুনের মিষ্টি রোদের ঝিলিকআলমের বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে নাশুর কথারাতের আদরকিন্তু দরু কেন তার মনে একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে? ও জানে নাদরুর মুখের দিকে ও তাকিয়ে থাকেগাইটা হাম্বা হাম্বা করে ডাকছেদরু গিয়ে হাত রাখে গাইটার গায়েদরুর আদর পেয়ে আনন্দে লেজ নাড়ছেগোটা গায়ে ও হাত বোলাতে থাকেআলমতারার গাটা কেমন শিরশির করে ওঠেযেন মনে হচ্ছে দরু ওর গায়ে হাত দিয়ে আদর করছেও এ কথা ভাবতেই কেমন শরমে মরে যায়যতই হোক দরু পর পুরুষনাশুকে যা দিয়েছে তা কি দরুকে দেওয়া যায়? কিন্তু দরু মনের কঠিন পলি কেটে ও ঢুকে পড়ছে অন্দরেমনের গ-ি কেটে ওর ভাবের হাতটা একটু একটু করে বাড়িয়ে দিচ্ছেআলম কি কোনো ভুল করছে? তার টগবগে যৌবন বাঁধন ভেঙে এগোতে চায়কিন্তু তা কি করে সম্ভব? দরু শুধুই নাশুর কাজের সঙ্গীনা- ও আর ভাবতে চায়ছে নাও দরুর কাছে থেকে সরে আসেগাইটা খড় খাচ্ছেআলমতারা এসে ওকে জল খেতে দেয় বালতি করেদুর ফস করে একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দেয়আলমতারা বিড়ি খাওয়া পছন্দ করে নাতবে কোনো দিনই মানা করেনিদরু আরও কিছুক্ষণ বসে থাকেআলমতারা কাজ করছেদরু যাবো যাবো করেও যেতে মন করছে নাকেমন একটা টান বোধ কাজ করছে আজবড়োই আরামে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসেঝির ঝির বাতাসে ওর ঘুম চলে আসেএক সময় ও আলমতারার মাটির দাওয়ায় ও ঘুমিয়ে পড়েআলমতারা এসে দেখে যে দরু হাত পা ছেড়ে ঘুমোচ্ছেও ডাকে নাএকটা মানুষ ওর মনের অধিকার চায়ছেতাকে মনের আসনে বসাতে সময় লাগবেআলমতারা ভাবতে থাকেছাতারটা ডেকে ডেকে কি যেন বলতে চায়ছে? আলমতারা তার ভাষা বেঝে নাবুকের কাছে শুধু শিস দিচ্ছে আর একটি ছাতার

তিন

সময়টা এখন ফাগুন মাসদুধ সাদা সকালবাতাসে মৌরি ফুলের গন্ধওর বুকের ভেতর ঢুকে পড়ছে সে গন্ধআলমতারা গোটা ঘর বাড়ি পরিষ্কার করেসকাল থেকেই ও ব্যস্তমনে মনে ও ঠিক করে সে দরুর শক্ত হাতটা ধরবেদরু কদিন ধরে ওর মুখের কথাটা একবারটির জন্য হাপিত্যেস হয়ে বসে ছিলআলমতারা ওকে ঠেলতে পারেনিও কথা বলতে পারছিল নাকেমন দরুর সামনে কাঠ মেরে বসে ছিলরাতের চাঁদটা ড্যাব ড্যাব করে ওদের দেখছিলবাতাসে বাতাবি ফুলের গন্ধে ভরে গেছেদরু আগের দিন বড় পীরের মাজার এ গেছিলমেলা থেকে ওর জন্য লাল ফিতে, চুড়ি, মাথা ঝারা কাঁকুই, জবা কুসুম তেল এনেছেআলমের হাতে দিয়ে বলে, এ গুলো তুমার জন্যি নিয়ে এলুম

কি ও গুলো?

দেখো না কি ও গুলি

আলমতারা হাত বাড়িয়ে নেয়তারপর ও অবাক হয়ে যায়মুখে কিছু বলে নাবুকটা কেমন ধুকপুক শুরু হয়নাশুর মৃত্যু মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠেযার আদর তার সারা শরীরে লেগেতার ভালোবাসা কি অত সহজে মোছা যাবে? দরু কাছে এসে ওর হাতটা ধরেআলমতারা কেঁপে ওঠেওর গায়ে যেন পৌষ মাসের ঠান্ডা জল ঢেলে দিলহিম হয়ে গেল

দরু এক লহমায় আলমতারাকে বুকে টেনে নেয়আলমতারা বাধা দেয় নাও গত রাতের কথাটা ভেবে শরমে মরে যায়দরু সকালে গাইটাকে চড়াতে গেছে

আজ আর কোনো কাজে যায়নিগাজীর কাছে গিয়ে আলমতারাকে ও বিয়ে করবেআলমতারার বুকে আজ নদীর ঢেউযেন উথাল-পাতাল ঢেউ এ ও তলিয়ে যাবেমনে আজ নতুন আলোর বাঁধন

হাতের কাজ সেরে ও রান্নায় বসেদরুর জন্য মাস কলাই এর ডাল, আলু ভাজা, পুটি মাছদরুই সকালে বিলের মাছ এনে দিয়েছেও ভালোবাসেআলমতারা এই ফাঁকে দরুর মেলা থেকে এনে দেওয়া আয়নায় মুখটা একবার দেখে এলোমাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করলওর মনে এখন গাবিন ফাগুনের ঝড়হাতের কাজ সেরে ও গা ধুয়ে আসে পাশের ডোবা থেকেগাটা ভালো করে ধুয়ে ফেলেযেন সে নাশুর স্পর্শ তুলে ফেলতে চায় রোগড়ে রোগড়েবেলা যায়কিন্তু দরু ফিরে নাআলমতারা ঘর বাহির করেও থাকতে না পেরে দরুর খোঁজ নিতে ও বের হয়বুকটা ওর ঢিপঢিপ করতে থাকেগাইটা ওকে ফেলে পালিয়ে গেল নাতো? ওর মনে কেমন সংশয় দেখা দেয়ও ছুটে চলে চরের দিকেআলমতারার কেমন পা দুটো কেঁপে ওঠেদরুকে ও খুজে পায় নাচারপাশে কেমন এক বিষাদ বাতাস বয়ছেতবে কি ও কোথাও চলে গেল? পদ্মা নিরবে বয়ছেযে পদ্মাকে আষাঢ় এ অচেনা মনে হয়দুকুল ভাসিয়ে দিয়ে যায় পদ্মাও কি ভেসে গেল? দরুকে সে কোথাও খুঁজে পায় নাএকটা বুনো ফুল তাকে সামান্য গন্ধ দিয়ে তার মনের অতলে কাঁটা ফুটিয়ে দিয়ে গেলআলমতারার কান্নায় চরের বালি ভিজে যায়তার মনে এখন আষাঢ়ের ঘোলা ঢেউ

×