.
ভোরের ঝাঁজ লেগেছে পুব আকাশে। গত কালকের নিকোনো উঠানে এখনো ঝাঁট পড়েনি। আলমতারা উঠবো উঠবো করছে। গোয়ালে বাঁধা গরুটা বিয়াবো বিয়াবো করে আছে। গরুটা নিয়ে ওর খুব চিন্তা। দরু খুব যত্ন করে গরুটার। ও এলেই গরুটার কাছে গিয়ে দেখে। দরু আলমতারার কেউ হয় না। নাশু বেঁচে থাকতে দরু আসতো। এক সঙ্গে জন খাটতো জমিতে। নাশুর যেদিন কাজ থাকতো না সেদিন দরু এসে হাজির হতো ওদের বাড়িতে। নাশুর হঠাৎ চলে যাওয়াটা আলমতারা মেনে নিতে পারেনি। আলমতারার পেটে সন্তান আসেনি। নাশু সত চেষ্টা করেও তার সন্তান হয়নি। কত কবিরাজ, বৈদ্য, গাছ গাছরা করেও আলমতার পেটে সন্তান এলো না। নাশুর পাশে রাতে শুয়ে আলমতারা কাঁদতো।
ওগা তাহলি আমার পেটে কি কেউ আসবি না?
অত উতাল হয়োনি আলম। খোদার ঘরে গিয়ে বলেছি হাত তুলে, খোদাগো, আলমের পেটে সন্তান দাও দেনি। খোদা এই গরিব মানুষের কথা রাখবিনে? মনটা খারাপ করিসনে আলম। আয় কাছে আয়।
নাশু কথা শেষ করে আলমকে পাশে টেনে নেয়। ওর খসখসে হাত দিয়ে ওকে আদর করতে থাকে। জিয়ালা মাঠে শিয়াল ডাকছে। আলমতারা নাশুকে চেপে ধরে। নাশুর বুকে লেপ্টে যায়। আলমতারা ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নেয়। রাত গভীর হতে থাকে।
আলমতারা ভাবে কথাগুলো। মনে হয় এইতো গত রাতের কথা। নাশু বিছানা ছেড়ে উঠবে। তারপর বাড়ির পিছনের খেজুর গাছ থেকে রস নামাবে। তারপর সেই রস ও নিজে হাতে জ্বাল দেবে। গুড় হবে। সেই গুড় আলমতারা দেয় পাড়া প্রতিবেশীকে। ওর বাপের বাড়িতও দেয়। এখন আর নগর তার যাওয়া হয় না। বাপটার মুখ তার খুব মনে পড়ে। ওর মা নেই। সেই কবে মরে গেছে। আলমতারা তখন খুব ছোট। মায়ের মরা মুখটা দেখিয়ে ছিল কে যেন কোলে করে। মায়ের মুখটা তার আবছা মনে আছে। ওর চার ভাই বোন। আলমতারা সবার ছোট। ওর বাপ ফরিদ মিয়া কখনো কোল ছাড়া করতো না। নিজ হাতে খাইয়ে দিত। ফরিদ মিয়া পরের জমিতে চাষ করতো। এক জোড়া গরু ছিল। ওদের চায়ের ওপর নির্ভর করে সংসার চলতো। এমনি করেই তার ভাই বোনদের বিয়ে হয়। ফরিদ মিয়া কখনো বিপদে পড়লে বলতেন, ও আলম মা, সব ঠি করি দেবেরে ওপরওয়ালা। খোদা আছে সঙ্গে।
অথচ চোখের জল তিনি লুকিয়ে রাখলেও ছোট মেয়ের চোখে পড়ে যেতেন ধরা। ছোট আলমতারা বাপের চোখের জল মুছিয়ে দিত। ফরিদ মিয়া আলমতারাকে বুকে নিয়ে কেঁদে ফেলতেন। বাপটার কথা মনে পড়তেই আলমতারা কেঁদে ফেলে। সকালটা কেমন যেন বিষণœ হয়ে যায়। বাপের মুখটা মনে পড়ে। কতদিন দেখে না তার জন্ম ভিটে। তার বাপও আসতে পারেন না। বয়স হয়েছে। এখন কোথাও আর যান না।
রোদ এসে পড়েছে ওদের উঠোনময়। বাঁশবনে একটা ছাতার ডাকছে। আলমতারার এই সব সঙ্গী এখন। ওদের সঙ্গে ও কথা বলে। দরু আসে মাঝেমধ্যে। কথা হয়। দরু মাটির দাওয়ায় বসে বিড়ি টানে। ফিক ফিক করে হাসে আর আলমতারার সঙ্গে গল্প করে। পাড়া প্রতিবেশী ফিসফাস করে। কিন্তু আলমতারা পাত্তা দেয় না। নাশুর গল্প বলে দরু। আলমতারা কান করে শোনে সে কথা। মানুষটা নেই তো মনে হয় কিছুই নেই। সব ফাঁকা। বিছানাটা কাঁটা মনে হয়। রাতে অনেক দেরি করে ঘুম আসে। সংসারটা চালাতে বেশ কষ্ট হয়। রেশনের চালটা পায় বলে দুমুঠো ভাত জোটে তার। নাশুর জমি জিরাত বলতে এই বসত বাড়িটুকু। ও যখন চলে যায় তখন ঘরে মাত্র এক হাজার জমানো টাকা। মুঠির কেজি দশেক চাল ছাড়া আর কিছু ছিল না। ওর বড় বোনাই নাদের সেই সময় ওকে কিছু নগদ দিয়ে ছিল। দরু যত টুকু পেরেছিল আলমতারার হাতে গুঁজে দেয়। আলমতারা কেমন অবাক হয়ে দরুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটিকে সে ভাবে ও কোনো দিন গুরুত্ব দেয়নি। দরু নাশুর জন্য খুব কেঁদেছিল। দরুরও তেমন কেউ নেই। মানুষটির জন্য ওর মায়া হয়। দরু একদিন না এলে কেমন যেন লাগে তার। দুটো মনের কথা আদান-প্রদান করে ওরা। কত গল্প হয়। রাত নামার আগেই দরু চলে যায়। তার লম্বা লম্বা পা ফেলে বাঁশবনের আড়ালে চলে যায়। দরু বেশ লম্বা চওড়া। বুকের ছাতিটা যেন বোশেকের ছাদের মতো পিটানো। সে যতœ নেয় না। নিজ হাতে দুটো ভাত ফুটিয়ে নেয়। কোনো রকমে দুটো মুখে দিয়ে চলে আসে আলমতারার কাছে। মাঠে গেলে সেদিন ওর দেরি হয়। আলমতারা বার দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। কখন দরুর পায়ের শব্দ পাবে সে।
কেন যে এমন হয় ও জানে না। নাশুর জন্য প্রথম প্রথম এমন হতো। দুপুরের রান্না শেষ করে আলমতারা বসে থাকতো। কখন নাশু আসবে। এক সঙ্গে বসে দুজনে খাবে। নাশু ওকে বলতো, আলম, বসি থেকি কি হবে? খেয়ি নিতে হয়। আমি কাজের মানুষ। কখন ফিরি না ফিরি তার কি ঠিক আছে? শরীলটা ভেঙে যাবেনি আলম?
তুমি না এলি খেতে মন করেনি গো! একা কি আর ভালো লাগে?
ওঃ! সেই এক কথা।
নাশু বেশ বিরক্ত হয় এ কথা শুনে। আলমতারা মুখ টিপে টিপে হাসে।
হাগো- গো আমার জন্যি তুমার চিন্তা হয় না? মানুষটি শুকিয়ে বসি থাকে।
ওরে পাগলী, আমি কি ভাবি না? আলম, দাও দেনি খেতে। বড্ড খিদে পেয়েছে। মন জান জুড়িয়ে যায় তুমার মুখ খানি দেখলে।
নাশু একটু আধটু আদরের কথা বলে। তাতেই আলমতারা আহ্ললাদে আটখানা। পা পড়ে না মাটিতে। আলমতারার বুকটা কেমন যেন করতে থাকে এ কথা শুনে। নাশু দুপুরে খাবার খেয়ে ঘরে চলে যায়। একটু গা গড়িয়ে নেবার জন্য। আলমতারা ওর পাশে এসে বসে। নাশুর কাজ করা খসখসে হাতে আলমতারাকে বুকে টেনে নেয়। তারপর নাশু পুরুষালি ঠোঁট দিয়ে আলমকে চুম্বনে চুম্বনে ওর সারা শরীরে আলপনা আঁকতে থাকে। সেই সময় আলমতারা এক ভালো লাগা আদরে যেন মরে যেতে ইচ্ছে করে। বাঁশবনে ছাতারটা যেন চেঁচিয়ে সব মাথায় করবে। ওদের দুপুরটা এমনি করেই কেটে যায়। এক সময় নাশু পাস ফিরে শুয়ে পড়ে। আলমতারার শরীরের মেটে মেটে গন্ধটা সারা ঘরে ভাসতে থাকে। এই সুখ শুধু তার একার। কিন্তু সে সুখ যে অচিন পাখির মতো এক লহমায় উবে যাবে তা কে জানতো? ওর বুকটা আনচান করতে থাকে। মাটির ঘরে তার গায়ের গন্ধ হারিয়ে গেছে। এখন আর ঘন ঘন ছাতার ডাকে না। ওর মনের ভালো বাসার ডালপালা শুকিয়ে গেছে। তার বসার আর জায়গা নেই। কে আর তেমন করে ডাকবে? নাশুর পুরুষালি ঠোঁট দুটো খোঁজে আলমতারা। উষ্ণ ঠোঁট কেমন করে সুখ খুঁজে চলতো তার সারা শরীরে। সে গলে যেত তার উষ্ণতায় জ্যৈষ্ঠ দিনের ন্যাংড়া আমের মতো। বিছানায় এখনো মানুষটির গায়ের গন্ধ লেগে আছে। আজ আলমতারার বিছানা ছিড়ে উঠতে মন করছে না। ছাতারটা ডাকছে। না- এবার উঠতে হবে।
গরুটাকে চুনি দিয়ে খড় মাখিয়ে খেতে দেয়। গরুটার বাচ্চা হলেও গাঁয়ে ঘরে দুধ বেচে দুটো পয়সার মুখ দেখবে। নাশু ওকে এনেছিল। তখন ও কত ছোট ছিল। খুব যতœ করতো। মাঠে থেকে আসার সময় ঘাস পাতা নিয়ে আসতো। গরুটা নাক ডুবিয়ে খেত। নাশু গায়ে হাত বুলিয়ে বলতো, আলম, গরুটার দুধ বেচি সংসারটা চলি যাবে। কি বলিস?
ও আগে বড়ো হোক। গাবিন হলি তো হয়।
আলমতারা বলে কথাটা।
হবি হবি। আর কটা মাস। তখন চোঙা ভরতি দুধ। আঃ!
তুমার জিবে পানি আসছি?
নাশু এ কথা শুনে হা হা করে হাসতে থাকে।
তুমার পেটেও যদি একটি নতুন শিশু আসতো।
আলমতারা এ কথার কোনো উত্তর দেয় না। ওর চোখে জল চলে আসে। গরুটাকে তার সন্তান মনে করে। নাশু বড়ো আদর করে। সে যেন ওর বাপ। গরুটাকে মনে মনে কত কথা বলে। গরুটার কদিনে গা থেকে যেন তেল চুঁইয়ে পড়ে। গরুটা খুব খাবুটে। যা দেয় তার সবটা খেয়ে নেয়। লেজ নাড়তে থাকে আনন্দে। আলমতারা ওর দেখভালের কোনো ত্রুটি করে না। বড়ো আদর দিয়ে ওকে একটু একটু করে বড়ো করে তোলে।
এমন সময় গরুটা হাম্বা হাম্বা করে ডাক ছাড়ে। ওকে খেতে দেয়। আজ সকালে ওর উঠতে মন করছিল না। গত রাতে মাটির দাওয়ায় চুপ করে ও বসে আকাশের সোনার থালার মতো চাঁদ দেখছিল। এমন রাতে নাশু ওকে আদর করে বলতো, আলম, তুমার মুখটা ওই আকাশের চাঁদটির মতক।
দূর সে মুখ করি আর জন্ম হলি না। মুখ না বাসি চুলার ছাই।
আঃ! কি যে বলিস আলম!
না গো। অমন কথা বললি আমার শরম লাগি।
একটু কাছে আয়।
এই তো তুমার পাশে।
তু খুব কথা বাড়াস। চাঁদের আলোতে ফিং ফুটছে। আয় মুখটা একটু দেখি। মনটু আমার কেমন কেমন করছিরে আলম।
আলম নাশুর শক্ত পোক্ত বাহুর মধ্যে ও নিজেকে সঁপে দেয়। রাতের পেঁচা ডেকে উঠলো রাতকে চিরে। হিম হিম ভাবটা উবে যায় নাশুর স্পর্শে। নাশুর বুকের ওম নিতে থাকে ও। রাতটা ধীর লয়ে কেটে যেতে থাকে। আলমতারা কেমন এক আনন্দে গেয়ে ওঠে, আমার মন পাখি সুখ বোঝে না।
কতদিন সে গান করে না। গানটা যেন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। যে গান দিয়ে নাশুর মনকে বেঁধে ছিল। নাশু আলমের গানে মজে ছিল। রাত নামলেই নাশু আবদার করতো, ওরে আলম, হবি নাকি একটু গান টান?
আ - মরণ! তুমি না -।
আরে - খেপি, মনটা যে কেমন কেমন করি।
আলমকে নাশুর আবদার শুনতেই হয়। আকাশে দেমাক নিয়ে চাঁদটা ঝুলে থাকে। মিটমিট করে চেয়ে দেখে ওদের দুজনকে। রাত সরে যায় এক সময় দামস বিলের দিকে। ওরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে এক পরম উষ্ণতায়। যে উষ্ণতা তার সারা শরীরে এখনো লেগে। এক সময় ও বিছানা ছেড়ে ওঠে। রোদ উঠেছে। চিকন লালি রোদের। বাতাসে একটা কি ফুলের গন্ধ বাতাসে মিশে গেছে। বেশ নেশা লাগে। আলমতারা সব ফুলের নাম জানে না। তবু এই গন্ধটা তার খুব ভালো লাগছে। গোটা বাড়িতে মিশে গেছে সে গন্ধ। ওর মন ভালো হয়ে যায়। ও এক সময় কাজে ডুবে যায়। ওর মন পাখিটা গাছের ডালে বসে ডাকতে থাকে।
॥ দুই ॥
হাঁপাতে হাঁপাতে এলো দরু। চোখে মুখে কেমন এক ভীতির ছাপ। ও এসেই ধপাস করে বসে পড়ে মাটির দাওয়ায়। আলমতারা তখন গাইটাকে বিচুলি খেতে দিচ্ছলো। দরুর এমন হন্ত দন্ত হয়ে আসা দেখে ও বেশ অবাক হয়ে যায়। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। আলমতারা ওর কাছে এসে দাঁড়ায়।
কি হল তুমার? অমন করছো যে।
একটু সময় নিয়ে দরু বলে, ভাগ্যি জোর বেঁচি গেলাম।
কেনে? কি হলো?
আরে মিয়া বাড়ির গরুটা চড়তে চড়তে ঢুকি পড়ে বর্ডারে। আমি গেছিলাম আনতি। আর অমনি দুম দুম করে গুলি। আমি জানটু লিয়ে পালিয়ে এলাম। আজ আর দেখতি হত না।
আলমতারার বাড়ি বর্ডারের কাছে। এখানে অনেক কিছুই ঘটে। ও কখনো চরের দিকে যায় না।
তা তুমার আক্কেল টো কি? মিয়া বাড়ির গরু আর তুমি গেছিলা আনতি। খোদার জান যদি এমন অপহেলায় চলি যেতক!
আলমতারার চোখটা কেমন চিকচিক করে ওঠে। কি জানি মানুষার জন্য হঠাৎ এমন মায়া হলো কেন? ওর জানে গিয়ে লাগে। ফ্যালফ্যাল করে দরু তাকিয়ে থাকে আলমের মুখের দিকে। মানুষটিকে আজ তার বড়ো আপন মনে হয়। দরুর খুব ইচ্ছে করছিল ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। এক সময় ও আলমের মুখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারে না। দরুর বুকটা গুলি খাওয়ার চেয়েও বেশি ধরপড় করতে থাকে আলমের জন্য। হঠাৎ এমন কেন হচ্ছে? দরু বেশ অবাক হয়। আলমের মুখের দিকে ও তাকাতে পারে না। আষাঢ় এর নদীর মতো বুকটা কেমন ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করতে থাকে। যেন এখনই ভিজিয়ে দেবে আলমকে। এমন সময় আলম বলে, তুমার যদি কিছু হতিক? ও কিছু না। এমন তো এখানটি চলে। সেবার দেখলি না বাসার কিভাবে গুলি খেয়ে মারা পড়লো। জেবনের কোন দামটি নেই!
বিষাদ গলাতে বলে দরু কথাটা।
দাও দেনি একটু পানি। গলাটা বড্ড শুকি গেছে। জেবনটা যেন আর ধড়ে থাকতি চায়ছে না।
আলম তাড়াতাড়ি জাম বাটিতে করে পানি এনে ওর সামনে ধরে। দরু ঢকঢক করে পান করে। যেন বৈশাখ মাসে মাটি ফাটার মধ্যে জল গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে। দরুকে দেখে ওর খুব মায়া হয়। বেচারা সকালে কিছু খেয়েছে কি না? শুধু শুধু একটু পানিতে আর কি হবে?
তুমি একটু বসো।
দরু বসে থাকে। একটু পরে আলম ওর জন্য রুটি আর সঙ্গে গুড় নিয়ে আসে। দরু বড় বড় চোখ করে দেখে জল খাবার। সত্যি তার সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। গোগ্রাসে ও খেতে থাকে। আলমতারা আরও জাম বাটিতে করে জল এনে দেয়। খাওয়া শেষ করে ও বলে, তুমি বড়ো আপন।
আলমতারা কেমন লজ্জা পেয়ে যায়। যেন নতুন বউ। গালে কি লাল আভা ফুটে ওঠে তার? ছাতারটা হঠাৎ করে ডেকে ওঠে। ওর বুকেই কি? দরু ওকে দেখছে বিড়ি টানতে টানতে। ওর চোখ দুটিতে আজ ফাগুনের মিষ্টি রোদের ঝিলিক। আলমের বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে নাশুর কথা। রাতের আদর। কিন্তু দরু কেন তার মনে একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে? ও জানে না। দরুর মুখের দিকে ও তাকিয়ে থাকে। গাইটা হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। দরু গিয়ে হাত রাখে গাইটার গায়ে। দরুর আদর পেয়ে আনন্দে লেজ নাড়ছে। গোটা গায়ে ও হাত বোলাতে থাকে। আলমতারার গাটা কেমন শিরশির করে ওঠে। যেন মনে হচ্ছে দরু ওর গায়ে হাত দিয়ে আদর করছে। ও এ কথা ভাবতেই কেমন শরমে মরে যায়। যতই হোক দরু পর পুরুষ। নাশুকে যা দিয়েছে তা কি দরুকে দেওয়া যায়? কিন্তু দরু মনের কঠিন পলি কেটে ও ঢুকে পড়ছে অন্দরে। মনের গ-ি কেটে ওর ভাবের হাতটা একটু একটু করে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আলম কি কোনো ভুল করছে? তার টগবগে যৌবন বাঁধন ভেঙে এগোতে চায়। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? দরু শুধুই নাশুর কাজের সঙ্গী। না- ও আর ভাবতে চায়ছে না। ও দরুর কাছে থেকে সরে আসে। গাইটা খড় খাচ্ছে। আলমতারা এসে ওকে জল খেতে দেয় বালতি করে। দুর ফস করে একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দেয়। আলমতারা বিড়ি খাওয়া পছন্দ করে না। তবে কোনো দিনই মানা করেনি। দরু আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে। আলমতারা কাজ করছে। দরু যাবো যাবো করেও যেতে মন করছে না। কেমন একটা টান বোধ কাজ করছে আজ। বড়োই আরামে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ঝির ঝির বাতাসে ওর ঘুম চলে আসে। এক সময় ও আলমতারার মাটির দাওয়ায় ও ঘুমিয়ে পড়ে। আলমতারা এসে দেখে যে দরু হাত পা ছেড়ে ঘুমোচ্ছে। ও ডাকে না। একটা মানুষ ওর মনের অধিকার চায়ছে। তাকে মনের আসনে বসাতে সময় লাগবে। আলমতারা ভাবতে থাকে। ছাতারটা ডেকে ডেকে কি যেন বলতে চায়ছে? আলমতারা তার ভাষা বেঝে না। বুকের কাছে শুধু শিস দিচ্ছে আর একটি ছাতার।
॥ তিন ॥
সময়টা এখন ফাগুন মাস। দুধ সাদা সকাল। বাতাসে মৌরি ফুলের গন্ধ। ওর বুকের ভেতর ঢুকে পড়ছে সে গন্ধ। আলমতারা গোটা ঘর বাড়ি পরিষ্কার করে। সকাল থেকেই ও ব্যস্ত। মনে মনে ও ঠিক করে সে দরুর শক্ত হাতটা ধরবে। দরু কদিন ধরে ওর মুখের কথাটা একবারটির জন্য হাপিত্যেস হয়ে বসে ছিল। আলমতারা ওকে ঠেলতে পারেনি। ও কথা বলতে পারছিল না। কেমন দরুর সামনে কাঠ মেরে বসে ছিল। রাতের চাঁদটা ড্যাব ড্যাব করে ওদের দেখছিল। বাতাসে বাতাবি ফুলের গন্ধে ভরে গেছে। দরু আগের দিন বড় পীরের মাজার এ গেছিল। মেলা থেকে ওর জন্য লাল ফিতে, চুড়ি, মাথা ঝারা কাঁকুই, জবা কুসুম তেল এনেছে। আলমের হাতে দিয়ে বলে, এ গুলো তুমার জন্যি নিয়ে এলুম।
কি ও গুলো?
দেখো না কি ও গুলি।
আলমতারা হাত বাড়িয়ে নেয়। তারপর ও অবাক হয়ে যায়। মুখে কিছু বলে না। বুকটা কেমন ধুকপুক শুরু হয়। নাশুর মৃত্যু মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যার আদর তার সারা শরীরে লেগে। তার ভালোবাসা কি অত সহজে মোছা যাবে? দরু কাছে এসে ওর হাতটা ধরে। আলমতারা কেঁপে ওঠে। ওর গায়ে যেন পৌষ মাসের ঠান্ডা জল ঢেলে দিল। হিম হয়ে গেল।
দরু এক লহমায় আলমতারাকে বুকে টেনে নেয়। আলমতারা বাধা দেয় না। ও গত রাতের কথাটা ভেবে শরমে মরে যায়। দরু সকালে গাইটাকে চড়াতে গেছে।
আজ আর কোনো কাজে যায়নি। গাজীর কাছে গিয়ে আলমতারাকে ও বিয়ে করবে। আলমতারার বুকে আজ নদীর ঢেউ। যেন উথাল-পাতাল ঢেউ এ ও তলিয়ে যাবে। মনে আজ নতুন আলোর বাঁধন।
হাতের কাজ সেরে ও রান্নায় বসে। দরুর জন্য মাস কলাই এর ডাল, আলু ভাজা, পুটি মাছ। দরুই সকালে বিলের মাছ এনে দিয়েছে। ও ভালোবাসে। আলমতারা এই ফাঁকে দরুর মেলা থেকে এনে দেওয়া আয়নায় মুখটা একবার দেখে এলো। মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করল। ওর মনে এখন গাবিন ফাগুনের ঝড়। হাতের কাজ সেরে ও গা ধুয়ে আসে পাশের ডোবা থেকে। গাটা ভালো করে ধুয়ে ফেলে। যেন সে নাশুর স্পর্শ তুলে ফেলতে চায় রোগড়ে রোগড়ে। বেলা যায়। কিন্তু দরু ফিরে না। আলমতারা ঘর বাহির করে। ও থাকতে না পেরে দরুর খোঁজ নিতে ও বের হয়। বুকটা ওর ঢিপঢিপ করতে থাকে। গাইটা ওকে ফেলে পালিয়ে গেল নাতো? ওর মনে কেমন সংশয় দেখা দেয়। ও ছুটে চলে চরের দিকে। আলমতারার কেমন পা দুটো কেঁপে ওঠে। দরুকে ও খুজে পায় না। চারপাশে কেমন এক বিষাদ বাতাস বয়ছে। তবে কি ও কোথাও চলে গেল? পদ্মা নিরবে বয়ছে। যে পদ্মাকে আষাঢ় এ অচেনা মনে হয়। দুকুল ভাসিয়ে দিয়ে যায় পদ্মা। ও কি ভেসে গেল? দরুকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। একটা বুনো ফুল তাকে সামান্য গন্ধ দিয়ে তার মনের অতলে কাঁটা ফুটিয়ে দিয়ে গেল। আলমতারার কান্নায় চরের বালি ভিজে যায়। তার মনে এখন আষাঢ়ের ঘোলা ঢেউ।