ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. অজয় রায়

আমার দেখা বাহান্নর ভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আমার দেখা বাহান্নর ভাষা আন্দোলন

আমি একজন সাধারণ ছাত্র ও ভাষা আন্দোলনের পেছনের সারির কর্মী হিসেবে ভাষা আন্দোলনকে কাছ থেকে দেখেছি এবং যথাসক্রিয় অংশ নিয়েছি। স্মৃতি ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল যখন, তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, বয়স ১১-১২ বছর মাত্র। দিনাজপুরের খ্যাতনামা মহারাজা গিরিজানাথ হাই ইংলিশ স্কুলের ছাত্র, পোষাকী নাম ছিল এমজিএনএইচই স্কুল (গ এ ঘ ঐরময ঊহমষরংয ঝপযড়ড়ষ) । এরপর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমার এবং আমার মতো অনেকের ছাত্র জীবনের অনেকটা অংশজুড়ে ছিল ভাষা আন্দোলন। বস্তুত আমরা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি, যেমনটি আমার বন্ধু যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের বাংলার অধ্যাপক গর্ব ভরে বলতেন, ‘আমরা ভাষা আন্দোলনের উৎপাদিত সামগ্রী’, কথাটি তিনি ইংরেজিতে বলতেন এভাবে ‘বি ধৎব ঃযব ঢ়ৎড়ফঁপঃং ড়ভ ঃযব ষধহমঁধমব সড়াবসবহঃ’ কথাটা অমূলক বা মিথ্যে নয়। আমার মনে আছে সেই সময় দিনাজপুর শহরে, এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে বিএ ক্লাসে পড়ুয়া দুভাই মুস্তাফা নূর উল ইসলাম ও এম. আর অখতার মুকুল।২২ মুস্তাফা নূর উল ইসলাম পরে সাহিত্যিক ও বাংলা সাহিত্যের গবেষকে পরিণত হন। তাঁর সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ’সুন্দরম’ পত্রিকা একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্য পত্রিকা রূপে খ্যাতি পায়, যা কেবল পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত আতাউর রহমানের পত্রিকা ’চতুরঙ্গ’র সঙ্গেই তুলনীয়। অধ্যাপক ইসলাম বর্তমানে নবতি বর্ষ অতিক্রম করে অবসর জীবনযাপন করছেন। অপরদিকে প্রয়াত এম. আর আখতার মুকুল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার প্রচারিত ’চরমপত্র’ কথিকার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশসেবার যে অনন্য অবদান রেখেছেন তার তুলনা কেবল তিনিই। মুকুলকে সত্যিকার অর্থেই আমরা বলতে পারি শব্দসৈনিক। আরও মনে পড়ছে সেই সময়কার ছাত্র ফেডারেশনের সেক্রেটারি ছটি ভাই, কমিউনিস্ট পার্টি কর্মী আসলে আহমেদ আর হাফিজুদ্দিন ভাই এর কথা। আর মনে পড়ছে আমার পিতৃবন্ধুু তেভাগা আন্দোলন খ্যাত কৃষক নেতা হাজি মুহম্মদ দানেশ। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে ঢাকায় এলে হাজি মুহম্মদ দানেশ আমার বাসাতেই উঠতেন। মনে পড়ে আরেক কৃষক নেতা গুরুদাস তাকুদারের কথা, তাঁকে আমরা ‘জেঠু’ ডাকতাম। তিনিও ঢাকায় এলে আমার বাসতেই উঠতেন। ’ভাষাসৈনিক’ শব্দটি তখনও চালু হয়নি। যে প্রসঙ্গ নিয়ে উপরের কথাগুলো বলা হল, সেটি আগে বলে নেই। ঘটনাটি আমার স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। সালটা মনে হয় ১৯৮২-৮৩। পূর্ব পরিচিত সাভারস্থ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রাণ পুরুষ ড. জাফর উল্লাহ চৌধুরীর সনির্বন্ধ অনুরোধে সেখানে গণবিশবিদ্যালয়ে মেডিক্যাল ফিজিক্স বিভাগে প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম এবং মনে হয় ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত ছিলাম। সেই সময় কোন একদিন নগর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সাত সকালে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের রথের অপেক্ষায়, রথ ও রথচালক জসিম তখনও দৃশ্যমান নয়। সাথে অপেক্ষমাণ গণমুদ্রণালয়ের প্রধান পুরুষ শফিক খান সাহেব ও তাঁর কন্যা, রসায়নের প্রভাষিকা। কী সূত্র ধরে জানি ১৯৮৫ সালে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ভাষা আন্দোলনে যাঁরা বাহান্নতে বড় অবদান রেখেছিলেন তাদেরসহ ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে সম্মেলনের কথা বলা হচ্ছিল। শফিক সাহেব গড় গড় করে বলে যাচ্ছিলেন কোন কোন তখনকার বীর নায়করা অংশ নিয়েছেলেন, এবং তাঁদের লেখা নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। কার বেশি বড় ভূমিকা ছিল তা নিয়ে বিতর্ক। বাঙালীদের যা হয় আর কি ! প্রসঙ্গত ভাষা মতীন, গাজী ভাই, ডা. আহমদ রফিক, ডা. হায়দার প্রমুখদের কথা তুললেন শফিক সাহেব। শফিক সাহেবকে অতি বিনয়ের সাথে বললাম, “আম্মো তো ১৯৮৫ সালের ওই সম্মেলনে ছিলাম অনেক বড় বড় বীরদের সাথে পেছনের সারির ভাষাকর্মী হিসেবে।” শফিক সাহেব বোধহয় কথাটি বিশ্বাস করতে পারেননি, বললেন তাই নাকি? ওর বিশ্বাস জন্মানোর জন্য কী কী হয়েছিল তার কিছুটা বয়ান করলাম আর কে কে এসেছিল তাদের ক’জনের নাম বললাম। মনে হলো তিনি তুষ্ট হলেন, এবং সাথে সাথেই আমাকে ভাষা আন্দোলনে আমার ভূমিকা নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ জানালেন। এ যৎকিঞ্চিৎ লেখাটির শানে নজুল হলো এটিই। ফিরে দেখে এখন সত্যিই অবাক হই সেদিনের গণস্বাস্থ্যের ভাষা আন্দোলনের নায়কদের মাঝে আমি কীভাবে আমন্ত্রিত হলাম, ডায়াসেও বসেছিলাম এবং কিছু বক্তব্যও রেখেছিলাম। আমার দিব্যি মনে আছে সে সময় ‘ভাষাসৈনিক’ বলে কোন শব্দ চালু ছিল না। এ সম্মেলনেই সম্ভবত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মাথাতেই এসেছিল ভাষা আন্দোলনকারীদের ’ভাষাসৈনিক’ অভিধায় চিহ্নিহ্নত করা হোক। বলতে দ্বিধা নেই মতীন ভাই, গাজী ভাই, সুলতান ভাই, ডা. আহমেদ রফিক ভ্ষাা বীরদের যদি ‘ভাষাসৈনিক’ নামে ডাকা হয় তাহলে আমার মতো পেছনের সারির মফঃস্বলের পোস্টার ও চিকামারা কর্মীদের তো হতে হবে ভাষা-পাইক, নিতেন পক্ষে ভাষা-বরকন্দাজ। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বড় বড় ভাষা বীরদের সাথে সকলকে ভাষাসৈনিক অভিধায় চিহ্নিত করে ব্যাজ ও বাটন পরিয়ে দেয়া হল। আমিও পেলাম। সেদিন থেকে “ভাষাসৈনিক” শব্দটি চালু হয়ে গেল। এ জন্য গণস্বাস্থ্য ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আইডিয়াকে প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু আমি নিজেকে কোনদিন ভাষাসৈনিক হিসেবে দাবি করিনি, এখনও করি না, এবং ভবিষ্যতেও করব না। বস্তুত ‘ভাষাসৈনিক’ শব্দটি আমি কখনও পছন্দ করিনি, আজও করি না। পাকিস্তান আমলে এবং এখনও আমরা সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি সেই আমরাই আমাদের ভাষা আন্দোলনের কৃতিমান পুরুষদের সম্মান প্রদর্শন করতে চাই সামরিকতন্ত্রের পরিভাষা ব্যবহার করে। সেদিনের সম্মেলনেও, আমার বেশ মনে আছে আমি এ শব্দটি চয়নের বিরোধিতা করেছিলাম। আমার স্মৃতিতে ‘৪৮’ এর ভাষা অন্দোলন স্কুল জীবনের ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে শুরু করেছিলাম। সে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মাস ও দিনের কথা স্পষ্ট মনে নেই। আমি মফঃস্বল শহরের এক নামকরা স্কুলের নগণ্য ছাত্র, ভাষা আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা এসব ভারি ভারি কথা তখন বুঝতাম না। মনে আছে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের কোন একদিন বেশ ক’জন বড় ক্লাশের ছাত্র, সাথে স্থানীয় রিপন কলেজের কয়েকজন ছাত্র নেতা এসে আমাদের নির্দেশ দিলেন যে, “আগামীকাল তোমরা ক্লাস বর্জন করবে এবং প্রসেশন করে অমুক জায়গায় আসবে, সেখানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এর দাবিতে ছাত্রদের সভা হবে।” আবছা মনে পড়ে কলেজের নেতাদের মধ্যে ছিলেন মোস্তাফা নূরুল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল এবং বারী ভাই। সম্ভবতঃ ১৯৪৮ সালে বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা যে রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিলেন মার্চ মাসে (১১ মার্চ) তারা ধর্মঘট আহ্বান করেছিলেন। মনে পড়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১১ মার্চ ধর্মঘট তারা ডেকেছিলেন। এই ধর্মঘট আমাদের শহরে চমৎকারভাবে পালিত হয়। আমরা সেদিন সকালে ক্লাস বর্জন করে মিছিলসহ ছাত্রদের সভায় যোগ দিয়েছিলাম। আমার জন্য এটি ২য় বার স্কুল থেকে ক্লাস বর্জন, ১ম বার করেছিলাম ১৯৪৬ সালে, ব্রিটিশবিরোধী কোন এক আন্দোলনে । আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। পরদিন সত্যি সত্যি কলেজছাত্র নেতাদের ডাকে আমরা মাস্টার মশাইদের সামনেই দুঃসাহস নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে শোভাযাত্রসহ দিনাজপুর জেলা স্কুলের সামনে মিউনিসিপ্যালিটি প্রাঙ্গণে (যতদূর মনে পড়ে) ছাত্রদের জমায়েতে শামিল হলাম। সে জমায়েতে বেশ কজন সিনিয়র ছাত্র নেতা বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাংলাকে রাষ্টভাষা করার দাবিতে আর আমরা মুহুর্মুহু সেøাগান দিচ্ছিলাম, উর্দু নয়, উর্দু নয়, রাষ্টভাষা বাংলা চাই। বক্তাদের মধ্যে এম আর আখতার মুকুল, তার বড় ভাই সৈয়দ মুস্তাফা নূও উল ইসলাম এবং ছাত্র ফেডারেশনের নেতা ছটি ভাইয়ের (নূরুল হুদা কাদের বক্স) কথা মনে আছে। অন্য কেউ বক্তৃতা দিয়ে থাকলেও আজ আর মনে নেই। সে সময়কার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আরও দু’একজন নেতার কথা মনে পড়েÑ আসলেহ ভাই, হাফিজ ভাই। হাফিজ ভাই পরে মোজজাফর ন্যাপের একজন বড় নেতা হয়েছিলেন। বস্তুত সেই ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সালে পর্যন্ত দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব ছাত্র ও তরুণ নেতৃত্ব ও পরিচালনা করেন, নির্যাতিত ও কারারুদ্ধ হন তাদের মধ্যে কয়েকজনের কথা এখনও স্মৃতিতে সঞ্চিতÑ এস এ বারী, ছটি ভাই, আসলেহ ভাই, দবিরুল ইসলাম, হারিসুল ইসলাম, আবদুুল হাফিজ, গোলাম রহমান, তারা ভাই, তোজা ভাই, হেনা ভাই, হিরু ভাই, বাবু ও লাবু প্রমুখ।১৯৪৮ এ দিনাজপুর ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে এস এ বারী এটি সংশ্লিষ্ট থাকেলেও তিনি সম্ভবত ১৯৪৮ সালেই ঢাকা চলে আসেন আইন পড়তে, তবে দিনাজপুরের সাথে যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল। ঢাকায় গেলে বারী ভাইয়ের সাথে ছাত্র ইউনিয়নের সুবাদে আমার গভীর ¯েœহসিক্ত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আসলেহ ভাই সম্পর্কে দু’একটি কথা না বললে চলে না। তিনিই আমাকে সেই ছোট বেলায় বামপন্থী চিন্তা ও রাজনীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। মনে আছে ১৯৪৯ (?) সালে কোন এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থাানীয় নাজিমুদ্দিন হলের প্রাঙ্গণে কবিতা আবৃত্তি ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে আসলেহ ভাই আমাকে ডেকে একান্তে আমার কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন, আমার সবিস্তার পরিচয় জেনে নিলেন, ২/১ দিন পরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দেখা করতে অনুরোধ করলেন। দেখা হওয়্য়া, তিনি সামান্য বামপন্থী রাজনীতি, আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে কিছু কথা বলে মার্কসবাদের ওপর বাংলায় কিছু লেখা পড়তে দিলেন। সেই পরিচয়ের আর ছেদ পড়েনি, কালের ব্যবধানে দূরত্ব বেড়েছে। স্মৃতির দুর্বলতায় যাদের নাম উল্লেখ করতে পারিনি, তাঁদের কাছে ক্ষমা চাই। তবে আমার বলতে দ্বিধা নেই যে দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলনের প্রাণ পুরষ ছিলেন নূরুল হুদা কাদের বক্স ওরফে ছটি ভাই। আমরা, পেছনের সারির চিকামারা কর্মীরা তাঁর নেতৃত্বেই কাজ করেছি। খুব যে কাছে আসতে পেরেছি সে দাবিও করি না। বস্তুত, আমার সন্দেহ তিনি আমাকে দেখলেও চিনতে পারবেন না। আমিও কি পারব? তার পিতৃদেব, মির্জা কাদের বক্স ছিলেন দিনাজপুর বারের খ্যাতনামা আইনজীবী, ছিলেন ব্রিটিশ আমলের বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য (এমএলসি) সে সময় ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার ছাত্রফ্রন্ট ’ছাত্র ফেডারেশন’ একটি বড় ও তাৎপর্যময় ভূমিকা পালন করেছিল। দিনাজপুরের ছাত্র ফেডারেশন নেতা ছটি ভাইয়ের নেতৃত্বেই আমরা ভাষা আন্দোলনে শামিল হয়েছিলাম। আমার দেখা বাহান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি ছিমছাম দীর্ঘদেহী ছটি ভাই চমৎকার বক্তৃতা দিতে পারতেন। প্রবল প্রাণশক্তি ছিল তাঁর। সে দিন থেকেই বুঝে-না-বুঝে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে কেমন করে জানি সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম একজন কর্মী হিসেবে। আমাদের কাজ ছিল ভাষার কথা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা, মিছিলে শামিল হওয়া এবং পোস্টার লেখা ও চিকা মারা। আর একটি সংগঠন সে সময় ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল তার নাম ‘যুবলীগ’ (এখনকার আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই)। যুবলীগের প্রাণ পুরুষ ছিলেন পরবর্তীকালে নানা রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি গাজী ভাই। গাজী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিক থেকে। আমার মনে আছে ছাত্র ইউনিয়নের গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে তিনি দিনাজপুরে এসেছিলেন। তাঁকে আমরা রেলস্টেশনে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। আমি তখন দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়ন দিনাজপুর শাখা গঠিত হলে আমাকে কলেজ শাখার সহকারী সম্পাদক করা হয়েছিল। এর কিছুদিন পরে দিনাজপুরে সংস্কৃতি সংসদ গঠিত হলে আমি সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন তখন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে সারা দেশব্যাপী। সেই সুবাদে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লাম সাংগাঠনিকভাবেও। আমি তখন, আগেই বলেছি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্র। প্রখ্যাত দার্শনিক শহীদ ড. গাবিন্দ চন্দ্র দেব আমাদের অধ্যক্ষ। তিনি ও কলেজের অন্যান্য শিক্ষক ছিলেন আমাদের আন্দোলনের নেপথ্য চালিকা শক্তি ও সহানুভূতিসম্পন্ন। বিপদে মাস্টার মশায়রা আমাদের পাশে দাঁড়াতেন। এমন কি প্রয়োজনে গোপনে নিজেদের বাসায় আশ্রয় দিতেন। আমার দিব্যি মনে আছে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক তারেন্দ্র ভট্টাচার্য প্রকাশ্যেই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেনÑ এ জন্য কলেজের গভর্নিংবডির তিরস্কার ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের কুদৃষ্টিতে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি তোয়াক্কা করেননি। আমাদের আন্দোলনের আর একজন সক্রিয় সমর্থক ছিলেন কলেজের ইতিহাসের খ-কালীন শিক্ষক, তেভাগা আন্দোলনের নেতা ও দিনাজপুর বারের সদস্য বাবার অকৃত্রিম বন্ধু স্বনামধন্য হাজী মোহাম্মদ দানেশ। আমাদের পাশে ছিলেন সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে কলেজের প্রিন্সিপাল জ্ঞান তাপস ড. গোবিন্দ দেবসহ কলেজের অনেক শিক্ষক- পদার্থবিদ্যার আমার প্রিয় শিক্ষক ড. রাধেশ শ্যাম ঘোষ, দর্শনের অধ্যাপক প্রিয় সামন্ত স্যার, বাংলার অধ্যাপক রাম নাথ ও মোককাররম স্যার। পেছন থেকে অনেক রাজনীতিবিদ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় সহায়তা করেছিলেন, যেমন ডা. নাইমুদ্দিন আহমেদ, তরুণ এ্যাডভোকেট গোলাম রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, খতিবুদ্দিন চৌধুরী, দুর্গাচরণ রায়, এ্যাডভোকেট বরদা ভূষণ চক্রবর্তী প্রমুখÑ তবে এর মধ্যে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী রহিমুদ্দিন উকিল, আমার পিতৃদেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে অমাদের বিরোধী পক্ষ প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতা ও প্রাদেশিক সংসদের সদস্য জনাব আবদল্লাহহেল বাকীসহ প্রাদেশিক মন্ত্রী জনাব হাসান আলী, ডাঃ হাফিজউদ্দিন, এ্যাডভোকেট তোজাম্মল আলী, ডাঃ ওযাসিমুদ্দিন, এ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমদ প্রমুখ মুসলিম লীগের চাঁইরা কম শক্তিশালী ছিলেন না। সরকারী মদতে এরা সবসময় ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে গেছেন। আমরা আগেই খবর পেয়েছিলাম যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি দেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে। জাতীয় রাষ্টভাষা পরিচালনা কমিটি এ সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের স্থানীয় নেতৃত্বও দিবসটি মিছিল, জনসভা ইত্যাদির মাধ্যমে পালনের বড় কর্মসূচী গ্রহণ করে। আমাদের শহরে বিশেষ করে ছাত্র মহলে এ দিনটি পালনের তোরজোর চলছিল। রাতভর পোস্টার লিখছি, ২১ ফেব্রুয়ারির পোস্টারে সয়লাব হয়ে গেছে আমাদের ছোট্ট শহর। আমরা নীরব কর্মীরা হাটবাজার ও দোকানদের বোঝাচ্ছি রাষ্ট্রভাষা বাংলার তাৎপর্য ও আবেদন জানাচ্ছি ধর্মঘট পালনের। আমাদের নেতারা জানালেন যে ওইদিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা বলবৎ করা হয়েছে যাতে শহরে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমহে ধর্মঘট ও মিটিং মিছিল সমাবেশ না করা যায়। আরও শোনা গেল যে দিনাজপুর শহরেরও নাকি একই উদ্দেশে তা প্রয়োগ করা হবে, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের এলাকায় এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজ এলাকায়। বলা বাহুল্য এসব কথা আমাদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল আর ভয়ও যে পাচ্ছিলাম না, তা অস্বীকার করি কী ভাবে। ২০ ফেব্রুয়ারির রাত টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কাটল। নেতারা নির্দেশ দিয়েছিলেন যে আমরা যেন পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারির সকাল ১০টা থেকে কলেজ প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকি। সকালের দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার কালে মা বললেন, ‘তোদের তো স্ট্রাইক, কলেজে যাওয়া কেন, বাসাতেই থাক।” বাবা কিছু বললেন না, তবে সাবধান করে দিলেন, “পরিস্থিতি ভাল না, অবস্থা বুঝে চলবে।” আমি দু’জনার নির্দেশ মাথায় নিয়ে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে কলেজে উপস্থিত হলাম। নানা স্কুল থেকে ছাত্ররা জমা হয়েছে, বেশকিছু ছাত্রীও। আসলেহ ভাই জানালেন যে গতকাল নাকি জাতীয় রাষ্টভাষা কমিটি ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে (নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার স্বার্থে) সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলে এসেছে যে, এ ব্যাপারে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে ছাত্র জমায়েতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জাতীয় কমিটি অবশ্য হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল যে ছাত্ররা যদি এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হয়, তাহলে জাতীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি স্বতঃভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।৬ কলেজ প্রাঙ্গণে মাইকে মুহুর্মুহু চলছে ভাষার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সেøাগান; কর্মীরা দিয়ে চলেছেন অনলবর্ষী বক্তৃতা। আমরা সবাই শঙ্কিত-সচকিত, ঢাকার খবরের জন্য উদগ্রীব। বেলা প্রায় ৩টর দিকে ঢাকা থেকে খবর এল যে সেখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। ছাত্ররা পুলিশের নিষোধাজ্ঞা অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। প্রাদেশিক সংসদ অভিমুখে মিছিল করেছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছির যখন অগ্রসর হচ্ছিল সংসদ ভবনের দিকে, সে সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের ব্যারাকের সামনে পুলিশ ও মিলিটারি ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ছাত্রসহ কয়েকজন নিহত ও বেশ কয়েকজন মিছিলে অংশগ্রহণকারী আহত হন। আমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লাম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্ররা পুলিশের বেষ্টনী ভেঙ্গে রাজপথে নেমে এলো। সারা শহরে আমরা খ- খ- মিছিল করে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ জানালাম। মুসলিম লীগ ও নরুল আমীন সরকারের পদত্যাগ দাবি করে সেøাগানে মুখরিত হয়েছিল ছাত্র ও জনতা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘোষিত হলো যে আগামীকাল (২২ ফেব্রুয়ারি) সারা শহরে ধর্মঘট পালিত হবেÑ স্কুল কলেজ, বাজার-দোকান বন্ধ থাকবে। নেতাদের নির্দেশে আমরা মাঠে নেমে গেলাম। নেতারা গোপনে নির্দেশ দিলেন যে, পরিচিত ও প্রথম সারির কর্মীরা যেন কেউ তাদের স্ব স্ব বাসায় রাত না কাটায়। আমি নিকটেই আমার এক মাসির বাসায় দু’রাত কাটালাম। নেতারা স্থির করলেন যে, আগামীকাল দুপুরে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে একটি মৌন মিছিল শহরের মূল রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে দিনাজপুর মহিলা সমিতির সামনে ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে জনসভায় শেষ হবে। আমরা পরদিন কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিল করে সারা শহর ঘুরে এলাম। মাইকে অনেকটা ধারা বর্ণনার মতো একজন ছাত্রনেতা ভাবগম্ভীর কণ্ঠে চমৎকারভাবে ২১শের বর্ণনা দিয়ে চলছিলেন। তাঁর নামটি ভুলে গেছি। শুধু এটুকু মনে আছে তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্রÑ শহরের নামকরা মোক্তার আফতাব আহমেদ সাহেবের পুত্র। জনসভা হয়ে উঠলো উত্তাল জনতার সমুদ্র। শহরের নামকরা আইনজীবীরা, রাজনীতিবিদরা অনলবর্ষী ভাষায় বর্ক্তৃতা করলেন, জানালেন তীব্র ঘৃণা নুরুল আমীন সরকারের বিরুদ্ধে। ছাত্রনেতারাও বাদ রইলেন না। আমাদের কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক তারেন্দ্র ভট্টাচার্য শুধু বক্তৃতা দিলেন না, শহীদদের উদ্দেশে রচিত একটি কবিতা পাঠ করেও শোনালেন। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকার আরও বিস্তারিত খবর পেলাম, বেশ কজন শহীদের নামও পাওয়া গেল। কবি হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতার ভাষায় বলিÑ আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার কি আশ্চর্য, কি বিষণœ নাম ! একসার জ্বলন্ত নাম। ছোট্ট শহরটিতে আমাদের প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ দমনে পুলিশ ও প্রশাসন মাঠে নেমে পড়লÑ আমরা আর মিটিং মিছিল করতে পারলাম না। নেতাদের নামে হুলিয়া বের হলোÑ কেউ ধরা পড়লেন, কেউ আত্মগোপন করলেন। বাবা ছিলেন নামকরা আইনজীবীÑ প্রশাসন তাঁকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছিল ‘পুত্রকে’ সরে থাকতে। পেছনের সারির অনেক কর্মীদের জেলে ঢোকান হলো। অমার নামেও হুলিয়া বেরিয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে গোয়েন্দা পুলিশ বেশ ক’বার বাসায় গিয়ে আমার খোঁজখবর নিয়েছিল। সেদিকটা অবশ্য বাবা ভালভাবেই সামলেছিলেন। আমি মায়ের নির্দেশে দূরে গ্রামের এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিলাম। এভাবেই দিনাজপুরের বাহান্নর ভাষা আন্দোলনকে পর্যদুস্ত করা হলো। আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে দিনাজপুরের ৫২’র ভাষা আন্দোলনের উপসংহার টানব। আমরা খবর পেলাম যে প্রাদেশিক স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্র্রী হাসান আলী খ্যাতনামা মুসলিম লীগ নেতা (প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি) মওলানা আবদুল্লাহেল বাকীকে নিয়ে পরদিন জনসভা করার উদ্দেশে ২৬ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরে আসছেন। আমরা তাদের আগমনকে উপলক্ষ্য করে তাদের আসার পথে শহরের উত্তর প্রান্তে (চেহেল গাজীর কাছাকাছি) সুবিধাজনক স্থানে কালো পতাকাসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তাঁদের শহরে ঢুকতে বাধা প্রদান করব। নিঃসন্দেহে একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। আমরা প্রায় ১৫-২০ জন বা তারও বেশি ছাত্র কাল পতাকা নিয়ে বিকেল ২-২.৩০ সময় ওইস্থানে দার্জিলিং রোডের দু’পাশে অবস্থান নিলাম। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আসলেহ ভাই, সঙ্গে ছিলেন (যতদূর মনে পড়ে) তোজা ভাই, তারা ভাই, মন্টু ভাই, ছটি ভাই কি ছিলেন মনে পড়ছে না। তখনও তাঁরা ধরা পড়েননি, তবে আত্মগোপন করে আছেন। খবর পেয়ে একদল তৎকালীন ইপিআর জোয়ান প্রায় ৪-৫ ফার্লং দূরে আমাদের বিপরীতে রাইফেল তাক করে অবস্থান নিলো। আমাদের হুঁশিয়ার করে শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলো। আমরা শঙ্কিত হলাম, আর একটা না ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ঘটে যায় দিনাজপুর শহরের উত্তর প্রান্তে। ভয় পেলেও আমরা সরলাম না। আসলেহ ভাই আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে মন্ত্রী মহোদয়ের গাড়ি দেখা দিলেই আমরা যেন রাস্তার মাঝে এসে দাঁড়াই। ইতোমধ্যে খবর পেয়ে আরও কিছু ছাত্র জমায়েত হয়েছেÑ মোট প্রায় ৫০’ এর মতো। সংখ্যা বাড়ায়, আমরা সাহসী হয়ে উঠলাম। অপেক্ষা করে আছি অতিথিদের সংবর্ধনা দেয়ার জন্য। পৌনে চারটার দিকে দূরে দেখা দিলো একটি গাড়ি। আমরা মাঝপথে এসে দাঁড়ালাম সবাই, সামনে নেতারা। সেপাইরা রাইফেল তুলে হাঁটু গেড়ে পজিশন নিলো ফায়ার করার। দ্রুত গাড়ি এসে পড়ল, একদল সেপাই আমাদের সামনে ব্যারিকেড রচনা করল। মনে হলো অনতি দূরে গাড়ির গতি শ্লথ হলো, সেপাইদের নেতা গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে আরোহীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে কি যেন সিদ্ধান্ত নিলো। দেখলাম গাড়ির সামনে জিপে ৪-৫ জন সেনাবাহিনী সদস্য বন্দুক উঁচিয়ে রয়েছে। আমি ভাবলাম মন্ত্রী মহোদয় বোধহয় গাড়ি থামিয়ে আমাদের কথা শুনবেন। কিন্তু তা নয়, দেখি হঠাৎ সেপাইদের ব্যারিকেড উঠে গেল আর আমাদের দ্রƒত রাস্তা ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিলো। মুহূর্তেই অতিদ্রুত গাড়িটি আমাদের দিকে ধাবমান হলো, আমরাও দ্রুত রাস্তার দুপাশে সরে এসে কাল পতাকা নাড়াতে থাকলাম, সঙ্গে সেøাগান ’রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নরুল আমিন নিপাত যাক’ ...। মন্ত্রীর গাড়ি মনে হয় ১০০ মাইল বেগে আমাদের অতিক্রম করে গেল। আমাদেরই মন্ত্রী আমাদের মতো ছাত্রদের মুখোমুখী হতে সাহস পেল না। পায়ের নিচে যে মাটি সরে আসছে মুসলিম লীগের, সে দিনের ঘটনায় বেশ টের পেলাম। আমরা বিজয়োল্লাসে ফিরে গেলাম যার যার ডেরায়। বেশকিছু দিন পরে অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে বাসায় ফিরে যথারীতি কলেজে ক্লাস শুরু করলাম। অতঃপর কলেজের পাঠ চুকিয়ে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে ১ম বর্ষ অনার্সের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলাম। পেছনে পড়ে রইলো স্মৃতি হয়ে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলন। এরপর থেকে ঢাকায় পরবর্তী ভাষা আন্দোলনের সকল স্তরে অংশগ্রহণ করেছি একজন সাধারণ কর্মী হিসেবেÑ ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের সদস্যরূপে। দিনাজপুর শহরে ১৯৫৩ সালে আমরা আর ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করতে পারিনিÑ নেতারা পলাতক অথবা ধৃত। কর্মীরাও তথৈবচ। সঙ্গে ছিল সরকারী দৃঢ়তা। বস্তুত সারাদেশেই তখন থমথম অবস্থা। ঢাকাতেও কোন কিছু করা সম্ভব হয়নি। তবে এর প্রতিশোধ আমরা নিয়েছিলাম ১৯৫৪’এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে। আমরা নিয়েছিলাম এক সংক্ষুব্ধ প্রতিবাদী কর্মসূচী। সে দিনের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা আজও আমার বেশ মনে আছে। তবে সে কথা আজ নয়, বলতে গেলে প্রবন্ধের আকার সীমা ছাড়িয়ে যাবে। একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলন তবে দেশে ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভালভাবে পালিত না হলেও, একটি ঐতিহাসিক কাজ হয়েছিল তা হলো, কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন। প্রকাশক ছিলেন জনাব মোহাম্মদ সুলতান পুঁথিপত্র প্রকাশনীর পক্ষে। এই কাজে এই দু’জন ভাষাসৈনিক আত্মগোপনে থেকেও প্রচ- ঝুঁকি নিয়ে সংকলনটি বের করেছিলেন ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে। এ সংকলনটি নিয়ে দু’চার কথা বলে বক্ষ্যমান প্রবন্ধটির সমাপ্তি টানব। এর পেছনে আমার অবশ্য বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা ছিল না, তবে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনিসুজ্জামান, আবদুল গাফফার চৌধুরী ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর.. সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আনিসুজ্জামান ‘দৃষ্টি’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন। আমার পড়া ঐটিই আনিসের প্রথম ও শেষ গল্প। বোরহানের একটি কবিতা এবং গাফফার চৌধুরীর অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি .. .. ’ কবিতাটি স্থান পেয়েছিল। বলা যেতে পারে প্রকাশনাটি তৎকালীন পূর্ব বাংলার একুশের ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে ঘিরে প্রথম সাহিত্য দলিল। সে দিক থেকে এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। সংকলনটিতে কী আছে? সংকলনটিতে রয়েছে : প্রবন্ধঃ ১টি (আলী আশরাফ) কবিতাঃ ১১টি (শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দল্লাহ, জামালউদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান) গল্পঃ ৫টি (শওকৎ ওসমান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, আতোয়ার রহমান) এছাড়া স্থান পেয়েছে ‘একুশের নকশা’ শিরোনামের অন্তরালে দুটি রচনাÑ মুর্তাজা বশিরের ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা’ এবং সালেহ আহম্মদের ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত স্বাক্ষর’। বিভিন্ন ভাষাভাষী রাষ্ট্রে, যেমন তৎকালীন পাকিস্তানে, বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার অবস্থান কী ধরনের হওয়া উচিত তা নিয়ে আলী আশরাফের নিরাবেগ প্রবন্ধটি চমৎকার। জনাব আশরাফের মতে ২১ আত্মত্যাগ ও চেতনার নির্যাস হলো, যা আমাদের সেøাগানে স্থান পেয়েছিলঃ ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই’ প্রবন্ধকার এই বলে তাঁর প্রবন্ধ শেষ করেছেন, ‘.. .. .. বিভিন্ন জাতির ভাষার সমান অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতে.. .. সকল জনতাকে জাগিয়ে তোলা যাবে, তাদের ভেতর গড়ে উঠবে মহান সৌভ্রাতৃত্ব ও একতা এবং আমাদের দাবি হবে অমোঘ। এভাবেই আমরা ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব ও ভাষার ক্ষেত্রে যুগ যুগের অত্যাচারকে খতম করতে পারব।’ শামসুর রাহমান তার কবিতাটি শেষ করেছেন এভাবে, “তোমরা নিশ্চিহ্ন করে দাও আমার অস্তিত্ব, পৃথিবী হতে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দাও উত্তরাকোশের তারার মতো আমার ভাস্বর অস্তিত্ব, নিশ্চিহ্ন করে দাও, নিশ্চিহ্ন করে দাও ॥” ্ আলাউদ্দিন আল আজাদের কাবতাটি শুরু হয়েছেÑ “স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো চারকোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো। যে-ভিৎ কখনো কোন রাজন্য পারেনি ভাঙতে .. ..” আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সখেদে উচ্চারণ করেছেন তাঁর কবিতায়, “মাগো, ওরা বলে, সবার কথা কেড়ে নেবে তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না। বলো মা, তাই কি হয় ?” হাসান হাফিজুর রহমানের দীর্ঘ কবিতাটি যেন একুশের ইতিহাস হয়ে উঠেছে। “আজ আমরা সেই অমর শহীদদের জন্যে, তাদের প্রিয় মুখের ভাষা বাংলার জন্যে একচাপ পাথরের মতো এক হয়ে গেছি, হিমালয়ের মতো অভেদ্য বিশাল হয়ে গেছি ॥” সংকলনটি শেষ হয়েছে ১৯৫২ সালের একুশের ঘটনাপুঞ্জী দিয়ে, যার শুরু হয়েছে ২৬ জানুয়ারি আর সমাপ্তি টানা হয়েছে ২৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা প্রবাহের উল্লেখের মধ্য দিয়ে। এটি লিপিবদ্ধ করেছেন কবির উদ্দিন আহমেদ। সংকলনটি শুরু হয়েছে “একুশে ফেব্রুয়ারি” শিরোনামের সম্পাদকীয় দিয়ে। এর শুরু চমৎকার একটি বাক্য দিয়ে, “একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি এমনি এক যুগান্তকারী দিন।” এটি শেষ হয়েছে এভাবে, “একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রথম ব্যাপক পশ্চাদাপসরণের সূচনা করেছে। সূচনা করেছে জনতার ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়াভিযান এবং সুদূর প্রসারী সাংস্কৃতিক নব জাগরণের। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি গৌরবম-িত ক্রান্তিকালের দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে সালাম পূর্ব পাকিস্তানের নব জাগ্রত জনতার বিজয়াভিযানকে সালাম।
×