ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা ফারুক

ফ্যাশনে বৈশাখ

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১২ এপ্রিল ২০১৬

ফ্যাশনে বৈশাখ

রৌদ্রোজ্জ্বল কিরণের ঝলমলে কোনো দুপুর মানেই বৈশাখের দুপুর। গুমোট গরমের উত্তাপে ডুবে থাকা দিনের গহনে বৈশাখের দিবসগুলো কখনও কখনও ভীষণ উদাস আর নৈঃসঙ্গের ছায়ায় যেন হারিয়ে যেতে চায়। মনের মর্মরে ক্রিস্টালের ঝাড়বাতির মতো বৈশাখের আলো ঝরে পড়ে। নিঝুম হাওয়ায় চঞ্চল আর উদভ্রান্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। প্রকৃতি এক নিদারুণ ভিন্নতায় ডোরবেল বাজায়। বাঙালীর জীবনে, সত্তায় বাংলা নববর্ষ, তথা পহেলা বৈশাখ এক অনন্ত উদ্দীপনায় মত্ত হয়ে উপস্থিত হয়। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালীদের উপস্থিতি রয়েছে, সেখানেই বাংলা নববর্ষের অনুপম বর্ণময়তা চোখে পড়ে। এই বাংলাদেশে সহস্র বছর ধরে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মনে পহেলা বৈশাখ এক অবিস্মরণীয় আবেগের দোলা দিয়ে যায়। প্রকৃতির ভিন্নতা, নতুনের ঔজ্বল্য, লোকজ উৎসব, জীবনযাপনেও রয়েছে বৈশাখের অমিয় প্রভাব। এক চিরকালীন আবেদন নিয়ে প্রতি বাংলা বছরের প্রথম দিনটি বাঙালীদের জীবনে আসে জলময়ূরের পালকে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা রেশমী জলের কণার মতো। মায়ারী স্পন্দন যেমন বৈশাখের অন্তপুরে বিপুল ঐশ্চর্যময়তা নিয়ে বিরাজমান। তেমনি রয়েছে বৈশাখের সর্বনাশী রুদ্ররূপও। প্রকৃতি, জীবনধারাকে এই বৈশাখ কখনও সখনও এমন তছনছ করে দিয়ে যায়; যার ক্ষত এবং দাগ আজীবন কেউ কেউ বয়ে বেড়ায়। বিক্ষিপ্ত বাতাসে পথে-প্রান্তরে ধুলোর আচ্ছন্ন ওড়াওড়ি, নিসর্গের রুক্ষতা সব কিছুই কেমন এলোমেলো করে দেয়। বৈশাখের এই যে বিরূপ আচরণ, কোমল বসন্তের পর কঠোর বৈশাখের গল্প বাঙালীর নিবিড় মগ্নতাকে হঠাৎ নাড়িয়ে দেয়াÑ যেন কেমন এক প্রাকৃতিক পরিহাস। তারপরও বৈশাখের চিরন্তন আবেদন, নববর্ষের প্রাণোচ্ছ্বল উন্মাদনা সকল বৈরিতাকে ম্লান করে প্রতিটি বাঙালীর প্রাণে রবীন্দ্র কাব্যের অজস্র স্বর্ণোজ্জ্বল পঙ্ক্তির মতোই ঝিলিক দিয়ে যায় অনশ্বর ভাল লাগায়। বৈশাখে লোকজ উৎসব বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনকে ঘিরে সুদূর অতীত থেকেই ভিন্ন এক আয়োজনের প্রস্তুতি চোখে পড়ে গ্রামেগঞ্জে। ঘরে ঘরে বাংলা নববর্ষকে বরণের এক মহাউৎসব যেন শুরু হয়ে যায়। বৈশাখকে কেন্দ্র কের গ্রামে গ্রামে জমে ওঠে বৈশাখী মেলা। মাস, সপ্তাহব্যাপী সেসব বৈশাখী মেলাকে উপজীব্য করে নানা গ্রামীণ ও লোকজ সামগ্রী পসরার পাশাপাশি সার্কাস, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, হাজারো মানুষের ভিড়, অগড়ু, খৈ, জিলিপি, বাতাসা, নিমকপোড়ার বিচিত্র ভুবন যেন এক চাঁদোয়ার নিচে মৈত্রী রক্ষায় উদগ্রীব ভঙ্গিতে গ্রীবা বাঁকিয়ে বসে থাকে। ঢোল, বাঁশি, ভেঁপু, মাটির বেহালা, দোতরা, বয়াতির গানে মশগুল আগত মেলার মানুষ। কী নেই এই চিরায়ত আট পৌঢ়ে বাঙালীর আনন্দঘন বৈশাখে। রমনায় বৈশাখ ষাটের দশকের গোড়াতে ছায়ানট সূচনা করে রমনায় বর্ষবরণ উৎসবের। পহেলা বৈশাখের প্রাতে রমনার বটমূলে যে বর্ষবরণের অভিযাত্রা সূচিত হয়েছিল আজ তা এক অমোঘ ঐতিহ্য নিয়ে কেবল ঢাকাবাসীই নয়, সারাদেশের বাঙালীর কাছেই অনন্য প্রেরণা হয়ে জেগে আছে। কর্মব্যস্ত মধ্যবিত্ত বাঙালীই শুধু নয়, সকল শ্রেণীর বাঙালীর হৃদয় ফুঁড়েই যেন ফোয়ারার মতো ছড়িয়ে পড়ছে ছায়ানটের সুদীর্ঘকালীন রমনার বটমূলে আয়োজিত এই বর্ষবরণ উৎসব। বাঙালীর জাতিসত্তায় প্রগতির চেতনাকে উজ্জ্বলতর করার ক্ষেত্রেও রমনার বর্ষবরণ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের যে বিজয়ী গৌরবগাঁথা প্রতিটি স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের অন্তরে অনাদি অনুপ্ররেণা জোগায়। সেই সব মানুষের মাঝে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ যেন খরস্রোতা নদীর মতোই বহমান। জ্বলজ্বলে রূপালী ইলিশের টুকরো আর জুঁই ফুলের মতো স্ফীত সাদা পান্তা ভাতের সুস্বাদুময়তা বর্ষবরণের ভোরে সৃষ্টি করে এক বিস্ময়কর মুগ্ধতার। সেই মুগ্ধতার স্ফুরণ কেবল এই ছায়ানট আয়োজিত রমনার বটমূলের বর্ষবরণেই খুঁজে পাওয়া যায়। লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরিহিত তরুণী যুবতীর খোঁপায় গোঁজা তাজা ফুলের গুচ্ছ। আর বর্ণিল পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত তরুণ-যুবকেরা গলায় উত্তরীয় জড়িয়ে গাইছে নববর্ষের গান, ঘুরছে ফিরছে দল বেঁধে, একা, যুগল, সপরিবারে। এ দৃশ্য মুগ্ধ নয়নে বৈশাক এলেই প্রত্যক্ষ করা যায় বিপুলভাবে। ফ্যাশনে বৈশাখ পহেলা বৈশাখের আবেদনটা বিভিন্নভাবেই বাঙালীর জীবনধারাকে আলোকিত করেছে। সেই জীবন ধারাতে বাংলা নববর্ষ এক ছদ্মময়, রঙ বাহারি আমেজের আবেশও জাগিয়েছেÑ যাক বৈশাখের ফ্যাশন বলেও অভিহিত করা চলে। বিশেষ করে পোশাকের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে বৈশাখের প্রাকৃতিক আবহকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশের প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন হাউসগুলো ব্যাপক আয়োজন করে থাকে। শাড়ি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শার্ট, টিশার্টে বৈশাখের রংটাকে নিপুণ আর শৈল্পিক রূপে অঙ্কিত করে বৈশাখের চিরন্তন অনুপম রূপৈশ্বর্য ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটে বৈশাখের ফ্যাশনকে ধারণের জন্য বাঙালী তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের মধ্যেও আলাদা এক অনুভূতি সঞ্চারিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। প্রবাসে বৈশাখ প্রবাসে বসবাসরত বাঙালীরাও বাংলা নববর্ষকে বরণের লক্ষ্যে পহেলা বৈশাখের আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে। বাঙালী কমিউনিটিতে পহেলা বৈশাখের আয়োজন নিয়ে সে এক এলাহী আয়োজন চলতে থাকে। ইলিশ-পান্তা, বাঙালী পোশাক সব কিছুই অভিবাসী বাঙালীর উদ্যোগ, উদ্্যাপনে পূর্ণতা নিয়ে আন্তরিকতার ছোঁয়ায় সিক্ত হয়ে ওঠে। আর সেই বিদেশ-বিভূঁইয়েও এক চিলতে বাংলাদেশ, মুখর বাঙালীকে খুঁজে পাওয়া যায় বাংলা নববর্ষে। উৎসবমুখী এই বাংলা নববর্ষ বরণের ক্ষেত্রে সবার মাঝেই থাকে মনের গহন থেকে উঠে আসা বিভোর-তাড়না, থাকে হাজার বছরের বাঙালীর ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণের নিবিড় গোলাপোজ্জ্বল আকাক্সক্ষা। গ্রামে গ্রামে নববর্ষ নগর জীবনে উদযাপিত বাংলা নববর্ষ একটা আলাদা মানসে, একটা হৃদয়জ আদলে উদযাপিত হলেও পহেলা বৈশাখের প্রাণ প্রাচুর্যের খোঁজটা কিন্তু মেলে সেই গ্রামেই। যেখানে সবকিছুই অকৃত্রিম রূপে, মৌলিক অভিব্যক্তি নিয়ে ধরা দেয়। প্রকৃতির অনাবিল প্রবাহের ভিতর দিয়ে এক নৈসর্গিক ছবি গাঁয়ের সবুজ প্রান্তরেই উদ্ভাসিত হয়। পহেলা বৈশাখের হুল্লোড়টা গ্রামে তেমন চোখে না পড়লেও এর সংবেদনটা বাজে গাঁয়ের প্রতিটি ধূলি, ঘাস, গুল্ম, বৃক্ষ শাখায় আর পাতায় পাতায়। নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ মানুষের জীবনের গতিপথে যেমন ছন্দকে সংযোজিত করে। তেমনি এক ভয়ার্ত চিত্রও ফুটে ওঠে মানুষের মুখাবয়বে এই বৈশাখেরই রুদ্ররূপ প্রত্যক্ষ করে। আনন্দের অনশ্বর পথ পরিক্রমায় বাংলা নববর্ষ জীবনের সবকিছুতেই জাগিয়ে তোলে স্পন্দন। যে স্পন্দনের মর্মে মানুষ খুঁজে ফেরে শান্তির নিবিড় স্পর্শ। বছর ঘুরে ঘুরে প্রতিবারই এই বাংলায় পহেলা বৈশাখ ফিরে ফিরে আসে। আসবে অনন্তকাল। অনন্তকালীন এই বাংলা নববর্ষের প্রতিটা দিন, ক্ষণ, মুহূর্ত, পল-অনুপল মানুষের জীবনকে স্বপ্নায়িত করবে। করবে আশাবাদী। পহেলা বৈশাখ তো এক স্বপ্নোজ্জ্বল প্রহরেরই প্রতিবিম্ব। আর প্রতিবিম্বের আলোকণা ছড়িয়ে পড়ে বাঙালীর জীবনাচার, ঘরদোর, ঘরে আসবাব, তৈজসপত্র, গেরস্থালিতেও। এই হলো বৈশাখের অমোঘ উৎসারণ। দৈনন্দিন জীবন ধারায় বাংলা নববর্ষের যে তুমুল উপস্থিতি তাতে করে বাঙালিয়ানাটুকু পূর্ণতা নিয়ে বছর ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে একাকী জীবনে, কখনও পরিবারের প্রতিটি ছত্রে। বাঙালীর জীবনে বৈশাখের আকষ্ঠ আবেশ এভাবেই ফুটে ওঠে।
×