ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

খাদ্য নিরাপত্তায় জিন প্রযুক্তি

​​​​​​​ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৩১, ২৬ মে ২০২৪

খাদ্য নিরাপত্তায় জিন প্রযুক্তি

.

সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভিডিও এডিটিংয়ের কথা আমরা সকলেই জানি। ঘোড়ার মাথা কেটে সেখানে মানুষের মাথা লাগানো, একজনের গান কিংবা নৃত্যকে আরেকজনের সঙ্গে ম্যাচিং করে চালিয়ে দেওয়া, দলিলে কিংবা সনদে আরেকজনের নাম নিখুঁতভাবে বসানো ইত্যাদি নানা কর্ম-অপকর্ম হরহামেশাই হচ্ছে। এগুলো সবই সম্ভব হচ্ছে কম্পিউটার কোড বা এক ধরনের প্রতীকের সহায়তায়। আপনার আমার ছবি (ইমেজ) বা কোনো গল্প, নাটক, পাহাড়-পর্বতের দৃশ্যসহ পার্থিব জীবনের সকল কর্মকান্ডকে (বা তথ্যকে) এবং এই দুটি প্রতীকের সারি (স্ট্রিমিং) দ্বারা উপস্থাপন এবং কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হয়। এই এবং এর যে কোনো পরিবর্তন পরিমার্জন দ্বারা একজনের ছবি অন্যের মতো, নদীকে পাহাড়ের মতো, ছবি থেকে টেক্সট, টেক্সট থেকে সংখ্যা, সংখ্যা থেকে গ্রাফ, টুডি-থ্রিডি এনিমেশন, সিমুলেশন ইত্যাদি করা হয়। এক কথায় এগুলোকে বলা হয় এডিটিং।

জিনোম এডিটিং সেরকমই একটি কাজ, যা জীবের কোষের মধ্যে হয়ে থাকে। আণবিক জীববিজ্ঞান এবং জেনেটিক্সের ক্ষেত্রে জিনোম হলো একটি জীবের সমস্ত জেনেটিক তথ্য, যা গঠিত হয় জীবের কোষের ডিএনএ এবং আরএনএ নিউক্লিওটাইড (নিউক্লিক এসিড) এর ক্রম নিয়ে। ডিএনএ অণুতে সজ্জিত/লিপিবদ্ধ থাকে জীবের সমস্ত বৈশিষ্ট্য কোড আকারে। জীবের জেনেটিক কোডগুলোকে জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং বিশাল সিকোয়েন্স ডাটা কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ এবং গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে পরিমার্জন (এডিট) করা সম্ভব। সফটওয়্যারের এই ব্যাপারটা অনেকটা ওয়ার্ড প্রসেসরের কাট-পেস্ট এ্যান্ড রিপ্লেসের মতো। কাক্সিক্ষত পরিবর্তন করতে পারলে ওই জীবের বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ তার আচার-আচরণ, আকার-আকৃতি, চেহারা ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আর এটাই হচ্ছে জিনোম এডিটিং।

এক কথায় জিনোম এডিটিং হচ্ছে ডিএনএ সিকোয়েন্সে ইচ্ছামতো এবং নিখুঁতভাবে পরিবর্তন আনয়নের একটি বৈজ্ঞানিক কৌশল। এক্ষেত্রে কোনো খারাপ বৈশিষ্ট্যের জিন বা জিনোম অনুক্রমকে ফটোশপের ন্যায় পরিবর্তন করে উন্নত জাত বা বৈশিষ্ট্যের জীব তৈরি করা যায়। এছাড়া জীবের ডিএনএ অণুতে কাক্সিক্ষত জেনেটিক কোডগুলো বা জিন প্রবেশ করিয়ে জীবে উন্নত বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করা যায়। জিনোম এডিটিং- সফলতা আসে ১৯৭০ সালে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এর ফলে শুরুতে একক কিংবা একগুচ্ছ জিন নিয়ে কাজ করে কিছু অভিনব ওষুধ এবং জৈবপ্রযুক্তি তৈরি হয়। তখন প্রযুক্তিতে কাক্সিক্ষত ডিএনএ সিকোয়েন্সকে জিনোম থেকে আলাদা করে নিয়ে কাজ করতে হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কোষের ভেতরে জিনোমের মধ্যেই জিনের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হচ্ছে। পরিবর্তন বলতে নতুন জিন যুক্ত করা, কোন জিনকে বাদ দেওয়া কিংবা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। ধরুন, কোন জীবের ডিএনএ ক্রমের খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলো (সংবেদনশীল রোগের লক্ষণগুলো) অত্যন্ত নিখুঁতভাবে এডিট করে সরিয়ে দেওয়া হলো। তাহলে ওই জীব বা প্রাণীটি সংবেদনশীল বা মারাত্মক রোগ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।

এভাবে জীবের বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তন পরিমার্জন করে ভালো-মন্দ, পজেটিভ-নেগেটিভ উভয় দিকেই পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে। সহজ কথায় ডিএনএ শিকলের কোনো একটি নিউক্লিওটাইডকে সরিয়ে সেই স্থানে আরেকটি নিউক্লিওটাইড প্রতিস্থাপন করা। বিশ্বব্যাপী কৃষি   শিল্পায়নে  জিনোম এডিটিং এক বিপ্লব সৃষ্টি করে চলেছে। ক্রমবর্ধমান মানুষের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে জমিতে ফসল বেশি ফলানো, ছোট ফলকে বড় করা, টক-ঝাল ফলকে মিষ্টি করা, চার-পাঁচ মাসের স্থলে দুই-তিন মাসে ফসলের পূর্ণতা আনা ইত্যাদি সম্ভব হচ্ছে জিনোম এডিটিং-এর মাধ্যমে। এক কথায় জিনোম এডিটিং জিনোম জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং জীবপ্রযুক্তির জগতে এক বৈপ্লবিক অধ্যায়।

জিনোম এডিটিং নানাভাবে হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি পদ্ধতি হলো () জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়েজ (জেডএফএন), (). ট্রান্সক্রিপশন-অ্যাক্টিভেটর লাইক ইফেক্টর নিউক্লিয়েজ (TALEN- টালেন), () ক্লাস্টারড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট প্যালিনড্রোমিক রিপিটস (ক্রিসপার-কাস/CRISPR-Cas) এবং () মেগানিউক্লিয়েজ সিস্টেম। এদের মধ্যে ক্রিসপার-কাস হলো জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির সর্বশেষ সংযোজন এবং এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফলপ্রসূ পদ্ধতি। অন্যান্য পদ্ধতি জটিল এবং জিনোম এডিটিং-এর জন্য ব্যবহার বান্ধব নয়। কারণ, এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করার জন্য অসুবিধাজনক কষ্টসাধ্য প্রোটিন ডাইজেশন, সংশ্লেষণ এবং যথার্থতা (Validity) যাচাই আবশ্যক।

অন্যদিকে, ক্রিসপার-কাস পদ্ধতি এসব বিবেচনায় অনেক বেশি সহজ সুবিধাজনক। যেমন- () এটি কম ব্যয় সাপেক্ষ এবং সহজেই প্রয়োগ করার মতো প্রযুক্তি। () এই প্রযুক্তি অনেক বেশি সূচারুভাবে জিনোমের নির্দিষ্ট জায়গায় পরিমার্জন করার জন্য খুব সরল প্রকৃতির উপাদানের ওপর নির্ভর করে তৈরি। () পছন্দের জিনোমের ওপর ভিত্তি করে এবং একাধিক জিনকে উদ্দেশ্য করে সহজেই ক্রিসপার-কাস সিস্টেম ডিজাইন করা যায়, যার মাধ্যমে একইসঙ্গে ঐসব জিনকে এডিটিং করা যায়। () এই প্রযুক্তিতে সম্পাদিত (এডিটেড) জিনের পরিবর্তনগুলো স্থিতিশীল এবং বংশানুক্রমে স্থানান্তরিত হয়। () সম্পাদিত (এডিটেড) উদ্ভিদ/জাত উদ্ভিদ প্রচলিত প্রজননের জন্য ব্যবহার করা যায়। () প্রযুক্তিটি পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বিশ্ব স্বীকৃত। () সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, প্রক্রিয়ায় মাত্র কয়েক প্রজন্মের মধ্যে ট্রান্সজিন-মুক্ত বনায়ন উন্নয়ন সম্ভব।

জিনোম এডিটিং নতুন উচ্চ ফলনশীল ফসল উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত দ্রুত সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি হিসেবে এখন বিশ্ব নন্দিত। ইতোমধ্যে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক উদ্ভিদের জিনোম সম্পাদনা করা হয়েছে। বহুল পরিচিত দুটি জিনোম সম্পাদিত ফসল বর্তমানে বাজারে রয়েছে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এগুলো হলো সয়াবিন তেল (শুধু যুক্তরাষ্ট্রে) কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং গামা অ্যামিনোবুটারিক এসিডসমৃদ্ধ টমেটো (শুধু জাপানে), যা রক্তচাপ কমায়। গত দশক যাবত বিশ্বের খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তায় জিনোম এডিটিং উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। এই প্রযুক্তির সর্বশেষ উন্নয়নগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, যেখানে কাক্সিক্ষত উন্নতির জন্য জীবের জিনোমে একটি নতুন বৈশিষ্ট্য বহনকারী জিন প্রবেশ করানো হয়। ফলে গত ৫০ বছরে ধান, ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা, ক্যানোলা, পেঁপে ইত্যাদি উৎপাদনে কৃষকের আস্থা অর্জন করেছে। ইতোমধ্যেই এই প্রযুক্তির সহায়তায় রোগ প্রতিরোধী লবণ সহিষ্ণু ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। উদ্ভিদ জেনেটিসিস্টরাও দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় স্থিতিস্থাপক উচ্চ-ফলনশীল উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি করতে চেষ্টা করছেন। জিনোম এডিটিং শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেনি, বরং রোগ নির্ণয় বিশ্বব্যাপী গবেষণার নতুন নতুন দিক উন্মোচন করে চলেছে, যা ক্রমবর্ধমান মানুষ জীবের জন্য কল্যাণকর পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জিনোম এডিটিং-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় চিকিৎসকরা আশা করছেন, হান্টিংটনের রোগ, পেশীবহুল ডিস্ট্রোফি এবং সিস্টিক ফাইব্রোসিসের মতো মনোজেনিক বংশগত রোগ নিরাময় করতে সক্ষম হবেন। ইমিউন সিস্টেমে হস্তক্ষেপগুলো ক্যান্সার এবং এইডসের মতো রোগের চিকিৎসা করাও সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা।

পরিবর্তনগুলো (এডিটিং) জিনের মিথস্ক্রিয়ায় কি প্রভাব ফেলে এবং জিনের অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যগুলো কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। কারণ, ডিম্বাণু শুক্রাণুর মতো জীবাণু-লাইন কোষ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এবং এই ধরনের জীবাণু-লাইন চিকিৎসায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পূর্বাভাস করা যায় না। তবে নীতিবিদরা আশাবাদী যে যদি ভ্রণের পর্যায়ে জেনেটিক ত্রুটিগুলো সংশোধন করা যায়, তাহলে অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও জিনোমে স্থানান্তরিত হতে পারে, যেমন- উচ্চ বুদ্ধিমত্তা বা শক্তিশালী পেশী ইত্যাদি। তবে ভ্র-স্তরীয় পর্যায়ে হস্তক্ষেপের ফলে মানবজাতি নতুন কোন সমস্যায় পড়ে কিনা কিংবা সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলি সফটওয়্যারের মাধ্যমে দৃশ্যমান (ভিজুওয়ালাইজ) করা উচিত। কারণ, জিনোম এডিটিং-এর ব্যবহার নিয়ে কিছু নৈতিক সামাজিক বিতর্ক রয়েছে। অবশ্য জিনোমিক ডেটাবেজ (ডাটাসেট) থেকে নিদিষ্ট জিনের কার্যকারিতা প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং এর ফল পূর্বানুমান করতে সহায়ক। তাছাড়া ডাটা-সায়েন্স জিনোম এডিটিংয়ের নৈতিক নিরাপত্তা বিষয়ক জটিলতা বিশ্লেষণেও সাহায্য করে। মোটকথা, জিনোম এডিটিং এবং ডাটা-সায়েন্সের সমন্বয়ে চিকিৎসা গবেষণায় বিপুল সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।

সেজন্যে, জিনোম এডিটিংকে সফটওয়্যার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় আরও কিভাবে যুগোপযোগী গ্রহণযোগ্য করা যায়, সর্বোপরি মানবজাতি জীববৈচিত্র্যের জন্য কিভাবে উপকারে আসে এবং এর সঠিক ব্যবহারবিধি জনকল্যাণে সরবরাহ করা উচিত।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×