ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

কন্যাকুমারী ॥ ভারতের টিপ

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

কন্যাকুমারী ॥ ভারতের টিপ

কেরালার লোকজনের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অস্ট্রালয়েড হওয়া

আমরা জানাতে পারিনি। আমাদের পর্যটন মন্ত্রণালয়ে নিয়ম মেনে মন্ত্রী বদল হয়, কিন্তু এ খাতে তারা কি অবদান রেখেছেন বা রাখছেন তা দৃশ্যমান নয়। শুধু কক্সবাজার ও কুয়াকাটা বিচ বিদেশী পর্যটকদের উপযোগী করে তুলতে পারলে হাজার হাজার কোটি টাকা এখান থেকে আয় করা সম্ভব। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সঠিক পরিকল্পনা এ দুটো সৈকতকে বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করতে পারে

কেরালার লোকজনের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অস্ট্রালয়েড হওয়ায় এদেরকে আমাদেরই আত্মীয়স্বজন মনে হয়। চেহারার দিক দিয়ে নিজেদের অনায়াসে দক্ষিণ ভারতীয় বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। এদের মিশ্রণটা মূলত নিগ্রয়েড ও ককেশয়েড। বাঙালিদের মিশ্রণ মূলত নিগ্রয়েড-ককেশয়েড-মঙ্গোলয়েড। তবে বাইরে থেকে দেখতে যতই মিল মনে হোক ভেতরটা যে একেবারে অমিলে ভরা তা টের পাওয়া যায় খেতে বসলে। অদ্ভুত সব রান্না এদের। সব কিছুতে পনির আর মাখন। কোলেস্টেরল ও ফ্যাট এড়াতে চিকিৎসকরা খাবারে সবজিকে প্রাধান্য দিতে বলেন।

এখানে সে ফর্মুলা প্রয়োগ করলে নির্ঘাত বিপত্তি। পনির ছাড়া সবজি অকল্পনীয়। মাখন তো থাকবেই, সঙ্গে এ জাতীয় মসলার আধিপত্য। নারকেলও ঘোরতর প্রভাব বিস্তার করে আছে এদের রেসিপিতে। তবে এখানে তার উপস্থিতি নেই। কারণ এটা পর্যটকপ্রধান এলাকা। সাদা চামড়ার পর্যটকরা গিজগিজ করছে। টেলিভিশনে দেখা ছবির মতো সংক্ষিপ্ত পোশাকে ঘুরছে-ফিরছে। বিচে চিৎ হয়ে শুয়ে সানবাথ করছে। গায়ের চামড়া তামাটে করতে কি কসরত। সফল যে একেবারে হচ্ছে না তা বলা যাবে না। অনেকের চামড়াতেই বাদামি রং ধরেছে।

সকাল-সন্ধ্যা-দুপুর-বিকেলে সব সময় বিচে আছে এরা। যেন উপভোগের একটা মুহূর্তও মিস হতে দেবে না। যখনই সূর্য ডুবে অন্ধকার গাঢ় হয় তখন রেস্টুরেন্টের টেবিল ঘিরে স্মোকড সি ফিশ-ড্রিংকস-স্মোকিং ইত্যাদির এক ভিন্ন আবহ তৈরি করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদের স্বাদে নারকেল পাত্তা পায় না। 
কলকাতা থেকে সরাসরি উড়ে কোভলম বিচে এসেছি। আরব সাগরের সমুদ্র সৈকত কোভলমের দক্ষিণ-পূর্বে ভারতের টিপ (ঃরঢ়) কন্যাকুমারী। মানচিত্রে এরপর শ্রীলঙ্কার অবস্থান। কন্যাকুমারী পড়েছে তামিলনাড়ু রাজ্যে। কোভলম থেকে গাড়িতে নব্বই কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যেতে হয় ওখানে। তামিলনাড়ু পৌঁছে সেই একটা কিনলে একটা ফ্রির কথা মনে পড়ল। এক রাজ্যে ঘুরতে এসে দেখা হয়ে গেল আরও এক রাজ্য। অসমে গিয়ে যেমন দেখা হয়েছিল মেঘালয়। কন্যাকুমারী নিয়ে চালু রয়েছে এক মিথÑ ভগবান বিষ্ণু এক কুমারীকে বিয়ে করবেন কথা দিয়েছিলেন। শর্ত ছিল সারারাত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তাঁকে। বিষ্ণু আসবেন ভোরে। তারপর বিয়ে।

কিন্তু নারদের ষড়যন্ত্রে ভুল করেন কন্যা। ভোর হওয়ার আগেই পা নামিয়ে ফেলেন। শর্তভঙ্গের অপরাধে তাঁদের আর বিয়ে হয় না। কন্যা কুমারীই থেকে যান। যেখানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে তাঁর পায়ের ছাপ ঘিরে তৈরি হয়েছে এক মন্দির। সমুদ্র থেকে কিছু দূরে ছোট দ্বীপে এই মন্দির আর স্বামী বিবেকানন্দ স্মৃতিশালা। দ্বীপ নয়, দেখে মনে হয় এখানে পাথুরে পাহাড় ছিল এক সময়। তারই কিছু অংশ কেটে এ চত্বর বানানো হয়েছে। এখানে লেখা রয়েছে, স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে ঘুরতে ঘুরতে এই পাহাড়ে এসে পাথরে কুমারী কন্যার পায়ের ছাপ দেখতে পান এবং এখানেই তিন বছর ধ্যান করেন।

স্বামী বিবেকানন্দ এখানে এসেছিলেন উনিশ শতকের শেষ দিকে। এখান থেকে দেখা যায় সেই দুর্লভ দৃশ্যÑ কুমারিকা অন্তরীপ। আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর এক জায়গায় মিশেছে। পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পানির রং আলাদা।
পৃথিবী বিখ্যাত উত্তমাসা অন্তরীপ আবিষ্কার ইউরোপীয়দের ভারত যাত্রা অনেক সহজ করেছিল। ওই পথ ধরে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা পনেরো শতকের শেষ দিকে ভারতের কালিকটে জাহাজ নোঙ্গর করেছিলেন। ভারতের প্রাচীনতম বন্দর শহর কালিকট এখন কেরালা রাজ্যের অংশ।

ভাস্কো ডা গামার আগমন চৌদ্দশ’ আটানব্বই সালে হলেও পনেরোশ’ পনেরোর আগে তারা এ দেশে কলকারখানা বানানোর বা ব্যবসা করার অধিকার পায়নি। ঐতিহাসিক সূত্র বলে, এখানে তখন রাজত্ব করছিল জামোরিন রাজা। পর্তুগিজরা উৎপাত শুরু করলে রাজা তাদের দমন করেন এবং রাজার সঙ্গে চুক্তির সুবাদে তারা এ দেশে ব্যবসা করার অনুমতি পায়। ইতিহাসের কি অদ্ভুত খেয়াল- এর ঠিক একশ’ বছর পর ব্রিটিশদের বাণিজ্যতরী ভেড়ে এ কালিকটে। তারপরের ইতিহাস সবার জানা।

বাণিজ্যের ছুতোয় এসে উপনিবেশ বানিয়ে শাসন করা। ভারতের মতো একটি প্রাচীন উন্নত সংস্কৃতির জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে কৃত্রিম এক সমাজ সৃষ্টি করেছিল ব্রিটিশরা। ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর অন্যতম হলো স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে দুর্বল করে দেওয়া। তাদের নিজ সত্তাকে পঙ্গু করে দেওয়া। আমেরিকায় সমৃদ্ধ ইঙ্কা ও মায়া সভ্যতা ধ্বংস করেছে ঔপনিবেশিক শক্তি। আফ্রিকার অনেক দেশ এখনো উপনিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ধুঁকছে। নিজস্ব ভাষা হারিয়ে কথা বলছে ভিনদেশী ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষায়। ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাসহ যাবতীয় রাজনৈতিক নেতিবাচকতার জন্ম দিয়ে গেছে ব্রিটিশরা।
 কেরালার কালিকট বন্দরে শুধু পর্তুগিজ আর ব্রিটিশরাই নোঙ্গর ফেলেনি। গ্রিস, রোম, ওলন্দাজসহ অনেক দেশের বাণিজ্যতরীই ভিড়েছে এখানে। ফিনিসীয় জাহাজ আসত মসলা ও হাতির দাঁত সংগ্রহ করতে। সেন্ট টমাস ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন। বৌদ্ধ, জৈন এবং মুসলমানরাও একই উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলেন। জনসংখ্যার শতকরা বিশ ভাগ খ্রিস্টান আর বিশ ভাগ মুসলিম, বাকি ষাট ভাগ হিন্দু। সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

যদিও শহরে ঢুকতেই বড় বড় পোস্টারে উদ্ভাসিত হয়ে আছেন মার্কস এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে তুঙ, ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও চে গুয়েভারাও বাদ যাননি। হয়ত এজন্যই ধর্ম এখানে নিরাপদ আছে। ধর্মহীন বলে পৃথিবীজুড়ে যাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয় ধর্মের সঠিক নিরাপত্তা আসলে তাঁরাই দিতে পারেন। কারণ তাঁরা ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করার বিপক্ষে। কোভলম বিচে প্রথম যেদিন রাতের খাবার খেতে যাই, ম্যানেজার জিজ্ঞেস করল কোত্থেকে এসেছি। বাংলাদেশ শুনে বলল, ও বাংলাদেশ শেখ হাসিনা! কলকাতা হয়ে এসেছি শুনে বলল, ইয়েস ক্যালকাটা-রবীন্দ্রনাথ টেগোর, মমতা ব্যানার্জি...। 
ভোরে সূর্য ওঠা দেখবে বলে বিচের পশ্চিম পাশে ছোট টিলার মতো উঁচু জায়গায় আয়েশ করে বসেছে সাদা চামড়ার পর্যটকরা। উপভোগ করার অপূর্ব ভঙ্গি মুগ্ধ করে। কিন্তু গাছপালার মাথা ভেদ করে সূর্য যখন উঠল তখন সে অনেক পরিণত। সমুদ্র একদিকে, সূর্য অন্যদিকে। আমাদের কক্সবাজার, কুয়াকাটায় কি অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য লুফিয়ে আছে এ পর্যটকরা হয়ত সে খবর জানেই না।
আমরা জানাতে পারিনি। আমাদের পর্যটন মন্ত্রণালয়ে নিয়ম মেনে মন্ত্রী বদল হয়, কিন্তু এ খাতে তারা কি অবদান রেখেছেন বা রাখছেন তা দৃশ্যমান নয়। শুধু কক্সবাজার ও কুয়াকাটা বিচ বিদেশী পর্যটকদের উপযোগী করে তুলতে পারলে হাজার হাজার কোটি টাকা এখান থেকে আয় করা সম্ভব। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সঠিক পরিকল্পনা এ দুটো সৈকতকে বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করতে পারে। 
সাধারণ মানুষের মানসিকতাও বড় ব্যাপার। এখানে এরা সংক্ষিপ্ত পোশাকে যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ ফিরেও তাকায় না। আমাদের দেশে হলে কৌতূহলী চোখের বিড়ম্বনায়ই ওরা বিচ ছাড়তে বাধ্য হতো। নিরাপত্তাও প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে যতক্ষণ বিচে মানুষ থাকে ততক্ষণ পুলিশের নজরদারি থাকে। জিনিসপত্র বিক্রি করতে দোকানিরা গলা কাটে না বা হোটেল রুম নিয়ে মিসম্যানেজমেন্টের ঝামেলা পোহাতে হয় না।
আরব সাগরের দীর্ঘ লেগুনে বেড়ালাম স্পিড বোটে করে। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য আর অনাবিল নির্জনতা। চারদিকে পাখির ডাক, পানির শব্দ, পানকৌড়ির ডুব দেওয়ার শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। কিছুদূর পর পর নোঙ্গর করা আছে ভাসমান রিসোর্ট। যাদের হাতে প্রচুর সময় তারা রিসোর্ট ভাড়া করে লেগুনে ভেসে বেড়ায়। এমনি নির্জন প্রকৃতিতেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ পদ্মায় বোট ভাসিয়ে একের পর এক অসাধারণ কবিতা লিখে গেছেন। 
প্রতিভাবানদের যদি অন্ন-বস্ত্রের চিন্তা করতে না হয় আর থাকে পর্যাপ্ত অবসর তাহলে হয়ত তাদের সৃজনশীল বিকাশ সহজতর হয়। রবীন্দ্রনাথকে যদি একবেলা খেয়ে পরের বেলার খাবার জোগাড়ের চিন্তা করতে হতো তাহলে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে...’ বা ‘বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল...’র মতো অসংখ্য গানের জন্ম নিয়েই হয়ত সংশয় দেখা দিত। প্রাক পুঁজিবাদ সমাজে অভিজাতদের হাতে সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা বিকশিত হওয়ার অন্যতম কারণ তাদের অন্ন-বস্ত্র চিন্তাহীন অখণ্ড অবসর।

×