ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

এক ফোঁটা বৃষ্টি হতো যদি

ড. শামীম আহমদে

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২৮ মার্চ ২০২৪

এক ফোঁটা বৃষ্টি হতো যদি

ড. শামীম আহমদে

দুই সপ্তাহ প্রায় সহনশীল তাপমাত্রার পর গতকাল টরন্টোর ওপর দিয়ে বয়ে গেল দারুণ শৈত্যপ্রবাহ। পরশু থেকেই এই বৈরী আবহাওয়া নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং নিউজ মিডিয়াগুলো মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছিল। পরশু পুলিশ এবং আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে নাগরিকদের অনুরোধ করা হয় শুক্রবার যাতে তারা যত শীঘ্র সম্ভব ঘরে ফেরেন। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় শঙ্কার কারণ ছিল।

অনেক মানুষ তাদের গাড়ি থেকে ‘উইন্টার টায়ার’ খুলে ফেলেছিল। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, কানাডার মতো শীতের দেশগুলোতে যারা নিয়মিত গাড়ি চালান, তাদের বছরে দুবার চাকা পাল্টাতে হয়। গ্রীষ্মকালের ৬-৭ মাস ‘সামার টায়ার’ আর শীতকালের ৫-৬ মাস ‘উইন্টার টায়ার’ ব্যবহার করতে হয়। তার মানে প্রতিটি গাড়ির মালিকের অন্তত দুই সেট করে গাড়ির চাকা থাকে। উইন্টার টায়ার কানাডার আবহাওয়ার জন্য খুবই জরুরি।

শীতকালে তুষার পড়ে কিংবা বরফ জমে রাস্তাঘাট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে, সেখানে সাধারণ চাকা কাজ করে না। সামার টায়ারগুলো থাকে অনেক বেশি সূক্ষ্ম খাঁজকাটা। ফলে, সেগুলো রাস্তা আঁকড়ে ধরে থাকতে গাড়িকে সাহায্য করে। এবার টরন্টোতে শীতের প্রকোপ ছিল তুলনামূলক কম, তুষারপাতও হয়েছে অন্য বছরগুলোর চেয়ে হালকা। বিশেষ করে গত দুই সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছিল।

সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছিল, কদিন পরপরই তাপমাত্রা উঠে যাচ্ছিল ৮-৯ ডিগ্রিতে; এমনকি একদিন ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসও হয়েছিল। এসব দেখে অনেক টরন্টোনিয়ান ভেবেছিলেন শীত বোধহয় শেষ হয়ে গিয়েছে এবং এই বিবেচনায় তারা তাদের গাড়ির উইন্টার টায়ার খুলে সামার টায়ার লাগিয়ে নিয়েছিলেন। পুলিশ মূলত আশঙ্কা করছিল সামার টায়ার নিয়ে এই বৈরী আবহাওয়ায় রাস্তায় নামলে দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। আবার একেকবার টায়ার চেঞ্জ করতেও একশ’ থেকে দুশ’ ডলার খরচ হয়ে যায়।

তাছাড়া ভালো জায়গা থেকে চাকা পাল্টাতে গেলে এ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতেই সময় লেগে যায় প্রায় দুই-তিন মাস। সুতরাং একদিনের তুষারপাতের জন্য যে সবাই আবার গাড়ির চাকা পাল্টাবে না, এটি তো নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ঘরে থাকা কিংবা কাজে গেলেও দ্রুত ঘরে ফেরা। যেহেতু তুষারপাত শুরু হবে দুপুরবেলা আর তার তীব্রতা হবে বিকেল থেকে। তাই পুলিশ সবাইকে বিকেলের মধ্যে ঘরে ফেরার অনুরোধ জানায়। মজার বিষয় হচ্ছে, ২২ মার্চ কানাডায় বসন্তের শুরু হয়েছে।

সেই বসন্তে তাপমাত্রা ছিল শূন্যের নিচে ১৩ ডিগ্রি, তুষারপাতে ঢেকে গেছিল সব রাস্তাঘাট। সেদিন আমার একটা কোর্সের শেষ ক্লাস ছিল। সেই ক্লাসে আবার শিক্ষার্থীরা তাদের ফাইনাল প্রেজেন্টেশন দেবে, তাই সেটি বাতিল করার কোনো সুযোগ ছিল না। ফেরার সময় হাইওয়ে ৪০১, যেখানে অন্য সময়ে গাড়ি চলে একশ’ কিলোমিটার ঘণ্টায়, সেখানে গাড়ি বেশিরভাগ সময় চালাতে হচ্ছিল পঁয়ষট্টি কিংবা সত্তর কিলোমিটার ঘণ্টা গতিবেগে। বাসায় এসে পৌঁছি ইফতারের ১৫ মিনিট আগে।

এদিকে গতকাল এখানকার আইনজীবী বন্ধু সাকিব-রনির কজমো ল’ অফিসে আমাদের সীমিতসংখ্যক বন্ধুদের ইফতারের আড্ডা ছিল। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার জন্য তা বাতিল করতে হলো। সাকিব, পলাশসহ অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, এই আবহাওয়ায় কেউই হয়তো ঠিকঠাক সময়ে পৌঁছুতে পারবে না। ওদের আশঙ্কা ঠিক ছিল। তাই ইফতারের আয়োজন পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে।

আবহাওয়া আর তার ফলশ্রুতিতে গাড়ি নিয়ে যেহেতু দুচার কথা লিখেই ফেলেছি, এ বিষয়ে আরও কয়েকটি কথা লেখা প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে টরন্টোতে গাড়ি চুরি বেড়ে গেছে বহুগুণ। এই তালিকার শীর্ষে আছে হোনডা সিআর-ভি। গত বছর কেবলমাত্র টরন্টো থেকেই হোনডা সিআর-ভি চুরি হয়েছে আটশ’রও বেশি। এদিকে যাদের গাড়ি তাদের বাড়ির সামনে পার্ক করেন, কিছু ক্ষেত্রে গাড়ি চোররা সরাসরি তাদের বাড়িতে ঢুকে লোকজনকে আহত করেছে গাড়ির চাবির জন্য।

এমতাবস্থায় কয়েক মাস আগে টরন্টো পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে টরন্টোনিয়ানদের অনুরোধ করেছে, তারা যেন গাড়ির চাবি বাড়ির দরজার পাপোষের নিচে রেখে দেয়; এতে করে চোর সেখান থেকেই চাবি নিয়ে গাড়ি চুরি করতে পারবে; তাদের আর বাড়িতে ঢুকে কাউকে চাবির জন্য আহত কিংবা নিহত করতে হবে না। পুলিশের এহেন বিবৃতিতে নাগরিকরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।

যদিও এটি সত্য টরন্টোতে গাড়ি চুরি হলে উচ্চমূল্যের ইন্স্যুরেন্সের কারণে প্রায় সবাই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে নতুন গাড়ি পেয়ে যান, তবুও পুলিশ গাড়ি চুরি সংক্রান্ত সহিংসতা ঠেকাতে নাগরিকদের চাবি দরজার সামনে রেখে দিতে বলবে এটি কারও মাথায় আসেনি। মানুষ পুলিশের এহেন বিবৃতিতে বিরক্ত হয়েছে। পুলিশকে নিয়ে শত শত নতুন নতুন ট্রল প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে।

টরন্টো পুলিশের জন্য সরকারের বাৎসরিক বরাদ্দ ১ বিলিয়ন ডলার কিংবা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার মতো। এত বিশাল বরাদ্দের পরেও তারা গাড়ি চোর ধরতে পারছে না, উল্টো সবাইকে হাল ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করছে, এটি টরন্টোনিয়ানরা মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটলে পুলিশ চোর ধরার কোনো চেষ্টাই করে না।

কেবল ইন্স্যুরেন্স দাবি করার জন্য যেসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, সেটি করেই ছেড়ে দেয়। এখন তাদের মূল লক্ষ্য গাড়ি চুরির সময় চোররা যাতে কাউকে আহত বা নিহত না করে সেটি নিশ্চিত করা। এই চুরির গাড়ি সরাসরি চলে যায় মন্ট্রিয়াল। সেখান থেকে জাহাজে করে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের নানা দেশে। 
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশী বন্ধুদের অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন যে, ঢাকায় তুমুল শিলা বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার বৃষ্টির সঙ্গে দুনিয়ার আর কোনো বৃষ্টির কোনো তুলনা হয় না। আমাদের নিকেতনের বাসায় গভীর রাতে বৃষ্টি নামলে, আমি সামনের বারান্দায় গিয়ে খানিকের জন্য হলেও দাঁড়াতাম।

এমনিতেও সরু বারান্দা, তারপর মেঝে ও গ্রিলজুড়ে আম্মার লাগানো গাছের জন্য খুব একটা জুতসইভাবে দাঁড়ানো যেত এমনটা নয়। তবুও একটু দাঁড়ালে বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দ শোনা যেত; সেই সঙ্গে কিছুক্ষণ পরপর শোনা যেত আকাশচেরা বজ্রপাত, পাওয়া যেত বুনোফুল আর কচি ঘাসের ডগা মুচড়ানো গন্ধ। 
ঢাকার বৃষ্টির একটা গন্ধ আছে। দুনিয়ার অন্য কোনো দেশের বৃষ্টির কোনো গন্ধ হয় না। বৃষ্টির সময়ে লম্বা করে শ্বাস নিলে বুকটা ভরে যেত, ঠান্ডা হয়ে যেত পুরোটা সত্তা। মাঝে মাঝে কোনোদিন রাত করে প্রচণ্ড ঠান্ডায় হাঁটতে বের হলে, ঠিক একইভাবে ঠান্ডা বাতাসে বুকটা ভরে যায়, ঢাকার কথা মনে পড়ে। কিন্তু ওই যে বৃষ্টির আলাদা যে গন্ধ, যে গন্ধে মুড়ে আছে মায়া-মমতা আর ভালোবাসা; সেটি কানাডায় কস্মিনকালেও পাওয়া যায় না।

[email protected]

×