ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কে কাকে বর্জন করে

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২৭ মার্চ ২০২৪

কে কাকে বর্জন করে

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতিকে গুরু মেনে বিএনপির যে সাম্প্রতিক ভারত বর্জন আন্দোলন, স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি বিষয়টি ভালোই ভাবিয়ে তুলেছে। বিএনপির প্রচার দেখে ভাবার চেষ্টা করলাম, চেষ্টা করে দেখি না  কেন ভারত বর্জন করে। ভারতীয় পেঁয়াজ, চাল, চিনি ইত্যাদি বর্জনের ডাক একদমই অর্থহীন। আমার দেশ আমার কষ্টার্জিত ট্যাক্সের অর্থ ব্যয়ে ভারতের কাছ থেকে কম দামে এসব পণ্য কিনে আনে। কারও দানে আনে না

শেখার জন্য যেমন স্থান-কাল-পাত্রের প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি শেখাও যেতে পারে যে কোনো শিক্ষকের কাছ থেকেই। তবে শিক্ষকের ঘটে বিতরণের জন্য জ্ঞানটুকু থাকা জরুরি। নচেৎ হিতে হবে বিপরীত আর সবই ঘোট পাকিয়ে এমন জট লাগাবে যে ছোটানোই দায় হয়ে দাঁড়াবে। বিএনপি সম্প্রতি তাদের রাজনীতিতে নতুন একাধিক উপাদান যোগ করার চেষ্টা করছে।

আগে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি মানেই ছিল উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে কোনো একটি বিষয় নিয়ে লোক দেখানো কিছু সমাবেশ-টমাবেশ করার চেষ্টা করা। এরপর যুক্ত হলো পদযাত্রা। আর নির্বাচনের আগে-পরে অবশ্যই কিছু জ¦ালাও-পোড়াও এবং অতঃপর মাসখানেক কিংবা বছরের বিরতি শেষে আবারও ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। অর্থাৎ, উপজেলা থেকে নতুন কোনো ইস্যুতে আবারও একই ধরনের কর্মসূচি কপচানো।

সর্বশেষ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পরে তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে একটি নতুন বিষয় যোগ করেছে। এখন তারা তাদের কর্মসূচিগুলো শুরু করে লিফলেট আর ফুল বিতরণের মাধ্যমে। এসব কর্মসূচি আরও অনেকের মতই আমাদের কাছেও কৌতূহল এবং কৌতূকেরও। কৌতূহলের কারণ ক্যান্টনমেন্টের গোলা-বারুদের মধ্যে যে বিএনপির জন্ম, তারা আগুন ছেড়ে গোলাপ বেছে নেবে, তা কি করে হয়?

আর এরশাদ-খালেদা জমানায় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার সুবাদে এদেশের রাজনীতি আমার যেভাবে চেনা, সেখানে তাদের রাজনীতি মানেই গুম-খুন, অপারেশন ক্লিনহার্ট, ক্যুদেতা। সেখানে গোলাপের স্থান কোথায়?
তবে ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতিকে গুরু মেনে বিএনপির যে সাম্প্রতিক ভারত বর্জন আন্দোলন, স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি বিষয়টি ভালোই ভাবিয়ে তুলেছে। বিএনপির প্রচার দেখে ভাবার চেষ্টা করলাম, চেষ্টা করে দেখি না  কেন ভারত বর্জন করে। ভারতীয় পেঁয়াজ, চাল, চিনি ইত্যাদি বর্জনের ডাক একদমই অর্থহীন। আমার দেশ আমার কষ্টার্জিত ট্যাক্সের অর্থ ব্যয়ে ভারতের কাছ থেকে কম দামে এসব পণ্য কিনে আনে। কারও দানে আনে না।

পেঁয়াজ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চেয়ে কম দামে সরবরাহ করে কিংবা আরও কমে চাল যদি আমরা পাই চীন কিংবা মিয়ানমার থেকে, তবে আমরা তাই খাব। তাতে কোনোই সমস্যা নেই। তবে বিএনপির এই সাম্প্রতিক আন্দোলনটি যতই ভাবতে থাকি আর ক্রমশ বিষয়টি গভীরে ঢুকতে থাকি, তাতে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়।

কদিন আগে টিভিতে দেখলাম বিএনপির এক সমর্থক অনেক কসরৎ করে আগুন লাগিয়ে নিজের একটি গায়ে দেওয়ার শাল পুড়িয়ে ফেললো আর কোনো কোনো টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান ততোধিক কসরৎ করে সেই ছবি তুলে তা দেশজুড়ে প্রচারের ব্যবস্থা করলেন, তাতে ভারতের বা অন্য কারও কি-ই বা এসে গেল? সত্যি বলতে কি, বৈশাখী তাপপ্রবাহ যখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তখন এই শালটি যাওয়ায় ওই বিএনপি নেতারও তেমন কিছুই এসে যাবে না।

তিনি হয়তো টেরটা পাবেন বছর শেষে আবারও যখন শীতটা জাঁকিয়ে বসবে। কাজেই এসব শাল জ¦ালাও-পোড়াও কোনো মূল্যই রাখে না। বরং অবাক হতাম বিএনপির কোনো আন্দোলন কর্মসূচি যদি পুরোপুরি আগুন সন্ত্রাস মুক্ত হতো।
আমার চিন্তাটা অন্য জায়গায়। আমার নানি কলকাতা থেকে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে থিতু হয়েছিলেন। এখনো নানির দিকের আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গে কিংবা ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে পৃথিবীর কোনো অন্যপ্রান্তে। আমার নানার বাবাওতো অবিভক্ত বেঙ্গল এ্যাসেম্বলির সংসদ সদস্য ছিলেন।

আর অত দূরেই বা যাই কেন? আমার দাদা যে পেনশন নিতেন ব্রিটিশ ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বন আধিকারিক হিসেবে কিংবা আমার বাবা যে জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতে, এখন কি তাদেরও এসব বর্জন করতে হবে নাকি! কিছু মানুষ, যারা আদ্যপান্ত জনবিচ্ছিন্ন আর যাদের দলটির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে, তারা যদি প্রায় দেড় যুগ রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে থেকে শুধু জ্বালাও-পোড়াওকে রাজনীতির ভাষা বলে মনে করে আর তাদের নেতা যদি সাত সমুদ্রের ওপারে বসে মনে করে যে, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু বস্তাপচা ইনফ্লুয়েন্সারের চোখে ঠিকঠাক মতো দেখছেন বাংলাদেশকে আর শুনছেন বাঙালির মনের কথা, তবে সেই দলের কাছ থেকে এর চেয়ে পরিপক্ব কোনো সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিত হতে পারে না। কারণ আছে আরও। এবারে ২৫-২৬ মার্চে বিএনপি নেতাদের বারবার বলতে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা নাকি পূরণ হয়নি। 
পাকিস্তান ভেঙে যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশ থাকবে তলাবিহীন ঝুড়ি হয়ে, বিএনপির প্রত্যাশার বাংলাদেশ সেটাই। এখন সেই বাংলাদেশে যদি রাজধানীর দিগন্ত জুড়ে ছোটাছুটি করে মেট্রোরেল আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির বহর, তবে সেই বাংলাদেশ তো তাদের গাত্রদাহের কারণ হবেই। কাজেই তারা আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের সহযাত্রী ভারতের বর্জন চাইবে না তো কি আমি-আপনি চাইব?

লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও 
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

×