ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তির সক্ষমতা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২৭ মার্চ ২০২৪

প্রযুক্তির সক্ষমতা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

বাংলাদেশে স্যাটেলাইটের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে

বাংলাদেশে স্যাটেলাইটের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিটিআরসির হিসাবে প্রতিটি টিভি চ্যানেল স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ডলার দিয়ে থাকে। যেসব বেসরকারি টিভি চ্যানেল এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চ্যানেল ব্যবহার করছে, তারা এখন এই বিপুল সংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারছে।  তবে এর সেবা  বাংলাদেশের নিকটবর্তী অব্যবহৃত অংশ নেপাল ও ভুটানের মতো দেশে ভাড়া দিতে পারলে প্রতিবছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা যাবে। কারণ, ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে মাত্র ২০টি ব্যবহার  করছে বাংলাদেশ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিভিন্ন সময়ে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হয়ে বিপুল সংখ্যক  জনসম্পদ ও জানমালের ক্ষতির বিষয়টি ছিল উদ্বেগজনক। উন্নত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পেতে দেরি হতো এই অঞ্চলটিতে। এই সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকল্প এবং প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছে।

কিন্তু আন্তঃদেশীয় ও মহাকাশীয় সংযোগের উন্নত ব্যবস্থা না থাকায় এসব দুর্যোগে ভালো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বিশ্বে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের যুগ চলছিল। বঙ্গবন্ধু দেখলেন তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। পাশাপাশি ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার এ বিপ্লবের গতি, প্রভাব ও ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করে দেয়।

জাপান, চীন, কোরিয়াসহ এশিয়ার কিছু কিছু দেশ তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের আবির্ভাব থেকে সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগাতে শুরু করে। দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ)’ এর সদস্য লাভ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট আর্থ-স্টেশন স্থাপন করেন। ফলে, বাংলাদেশ সহজেই বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম এবং আবহাওয়াসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়ার পথ সুগম হয়।
মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণে ৫৭তম দেশ হিসেবে  বাংলাদেশের নাম এখন বিশ্ববাসীর জানা। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বাংলাদেশের প্রথম ভূস্থির যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ, যা ২০১৮ সালের ১১ মে (বাংলাদেশ সময় ১২ মে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ফ্যালকন ৯ ব্লক ৫ রকেটের প্রথম পণ্য উৎক্ষেপণ যান। বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের ভূ-কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

এই জন্য গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় ভূকেন্দ্র তৈরি করা হয়। জয়দেবপুরের ভূকেন্দ্রটি হলো মূল স্টেশন। বেতবুনিয়ায় স্টেশনটি দ্বিতীয় মাধ্যম ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হয়। এছাড়া আরও বিস্তারিত পর্যবেক্ষণের জন্য ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সে দুটি ভূ-উপগ্রহ উপকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশের বিভিন্ন মিডিয়া সংস্থা বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহ থেকে ভাড়া নেওয়া ট্রান্সপন্ডার ব্যবহার করছে।

যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হন্ডুরাসের ২টি, তুরস্কের ১টি, ফিলিপিন্সের ১টি,  ঘানার  ২টি, ক্যামেরনের ১টি, দক্ষিণ আফ্রিকার ২টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে টিভি চ্যানেল আছে প্রায় ৫০টি। ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা আইএসপি আছে কয়েকশ’। রেডিও স্টেশন আছে ১৫টির বেশি। আরও আসছে। ভি-স্যাট সার্ভিস তো আছেই। এর ব্যান্ডউইথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ইন্টারনেট বঞ্চিত অঞ্চল যেমন- পার্বত্য ও হাওড় এলাকায় উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়ে। তখন এর মাধ্যমে দুর্গত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা হয়। এমনি আরও অনেক কারণেই বাংলাদেশে স্যাটেলাইটের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিটিআরসির হিসাবে প্রতিটি টিভি চ্যানেল স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ডলার দিয়ে থাকে। যেসব বেসরকারি টিভি চ্যানেল এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চ্যানেল ব্যবহার করছে, তারা এখন এই বিপুল সংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারছে।

তবে এর সেবা  বাংলাদেশের নিকটবর্তী অব্যবহৃত অংশ নেপাল ও ভুটানের মতো দেশে ভাড়া দিতে পারলে প্রতিবছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা যাবে। কারণ, ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে মাত্র ২০টি ব্যবহার  করছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল কার্যক্রমের পর বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কার্যক্রমও  এগিয়েছে অনেকদূর। অভিযানের সময়কাল ধরা হয়েছে ১৮ বছরের মতো। বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইটটি হবে একটি পৃথিবী অবজারভেটরি স্যাটেলাইট।

এটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরে ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করবে। ফলে, দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের জন্য অরবিটাল স্লট প্রয়োজন হবে না। এটি হাইব্রিড হতে পারে স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইটটি আবহাওয়া, নজরদারি বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হবে। তবে এখনো যেহেতু ধরনটি ঠিক হয়নি, তাই এই স্যাটেলাইটে কত খরচ হবে, এটি এখনো অজানা। 
উল্লেখ্য, বাংলাদেশসহ ২৪টি দেশ নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠানোর চেষ্টা করছে। উল্লেখ্য, ভারত ‘আর্যভট্ট’ নামের প্রথম উৎক্ষেপণ পাঠায় ১৯৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল  এবং পাকিস্তান ‘বদর’ নামের প্রথম উৎক্ষেপণ পাঠায়  ১৯৯০ সালের ১৬ জুলাই। এমনকি ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, নাইজিরিয়া, ফিলিপিস, কলম্বিয়া, মউরিতানিয়া, কাজাগাস্তান-এরও নিজস্ব উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট আছে।

১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) স্পুটনিক-১ নামে বিশ্বের প্রথম স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠায়। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে কয়েক হাজার স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে। ১৯৫৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১১ হাজার স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করছে (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম)। এই সংখ্যা সম্প্রতি জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।

বিশেষ করে স্পেসেক্সর মতো প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাবে মহাকাশ নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের স্টারলিংক প্রজেক্টের মাধ্যমে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মহাকাশে ৪২ হাজার স্যাটেলাইট পাঠানো হবে বলে জানা যায়। (বিজনেস ইনসাইডার)।
ছয় দশকের বেশি সময় ধরে মানব জীবনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রেখে চলেছে স্যাটেলাইট। তবে এর প্রত্যক্ষ সুবিধা ভোগ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। সমস্ত পৃথিবীকে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত করেছে স্যাটেলাইট। গত শতকের টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট ব্যবস্থা আবিষ্কার ও জনপ্রিয়তার পেছনে এর ভূমিকা অনেক। সম্পূর্ণ স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল জিপিএস এখন মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। সামরিক ক্ষেত্রেও এর রয়েছে ব্যাপক ব্যবহার।

উন্নত দেশগুলো তাদের সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি, শত্রু রাষ্ট্র, সন্ত্রাসী বাহিনী, উগ্রপন্থি, পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণকেন্দ্রসহ সামরিক নানা কাজে স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। ওজন স্তরসহ বায়ুম-লের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের গবেষণার মূল উৎস হচ্ছে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য। পৃথিবীর যাবতীয় উপাদানসহ সৌরজগৎ ও মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণার জন্য মুখ্য ভূমিকা রাখছে এই প্রযুক্তি। এনবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ।

এই প্রযুক্তির ফলে আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা সম্ভব হচ্ছে। ফলে, গত ৬ দশকে অন্তত হাজার হাজার মানুষের জীবন বেঁচে গেছে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। এক সময় মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় ঝড়ের কবলে পড়ত। ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হতো। আজ আর তেমনটি নেই। স্যাটেলাইটের ফলে এখন আগে থেকেই দুর্যোগের বিষয় জানতে পেরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে মানুষ।

ব্রিটিশদের দ্বারা দুইশত বছর শাসনের পরও ২৪ বছর পরাধীন ছিল বাংলাদেশ। সকল অর্জন ও সফলতা লুট করে নিয়ে যেত পাকিস্তানিরা। এ অবস্থা উত্তরণের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের  মাধ্যমে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। বাঙালি ফিরে পায় তার প্রাণ, পতাকা ও দেশ। শুরু হয় বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। বঙ্গবন্ধুর দর্শন, মুক্তিযুদ্ধ  ও স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করে বাঙালি এগিয়ে যায় সামনের দিকে।

অর্জিত হয় অনেক সাফল্য, কিন্তু আবার হোঁচট খায়। তবু এগিয়ে যায় বীর বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কাছে পরাধীন হয় ষড়যন্ত্রকারীরা। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা এবং সাহসিকতায় দেশ আজ অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশ্বের মডেল। এ পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতেও দেশ পিছিয়ে থাকতে পারে না। পারে না মহাকাশ বিজয়েও।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস, পৃথিবী ও মহাকাশের মধ্যে যোগাযোগ এবং মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্য উদ্ঘাটনে স্যাটেলাইটের ভূমিকা যে অপরিসীম, তা তিনি অনুধাবন করতে পারেন। এই ভাবনা থেকেই বাংলাদেশে একটি নিজস্ব স্যাটেলাইট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। উৎক্ষেপণ করেছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। অপেক্ষায় আছে বঙ্গবন্ধু-২ উৎক্ষেপণের। নিঃসন্দেহে প্রযুক্তি ও উন্নয়নে বাঙালি জাতির এই সাহস ও সক্ষমতার পেছনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা। যার পেছনে শক্তি জুগিয়েছিলেন বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×