ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের স্থপতি

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২৬ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশের স্থপতি

মহিমান্বিত মার্চ তার সার্বিক আবেদনে সারাদেশকে মাতিয়ে দিচ্ছে

মহিমান্বিত মার্চ তার সার্বিক আবেদনে সারাদেশকে মাতিয়ে দিচ্ছে। মার্চ মানেই অভাবনীয়, কালজয়ী আর রক্তাক্ত এক মহাসমরের অনন্য অগ্রযাত্রা। যে যাত্রা শুধু আনন্দ আয়োজনের নয় বরং তিক্ততা, সম্ভ্রমহানি আর ক্ষতবিক্ষত কাঁটা বিছানো পথের লড়াকু অভিগমন। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি যতই মধুর আর ভালোবাসার আবিষ্টে জড়ানো থাক না কেন, তার অর্জন আর সুরক্ষা ততোধিক কঠিন। তেমন অনধিগম্য, পিচ্ছিল আর রক্তাক্ত আঙিনা পাড়ি দিতে শুধু সার্বিক জনগোষ্ঠীই যথেষ্ট ছিল না।

বরং এক অবিস্মরণীয় জীবন্ত কিংবদন্তির সুবিশাল ব্যক্তিত্ব, অকুতোভয় দেশপ্রেম আর সাধারণ মানুষের প্রতি নিরন্তর দায়বদ্ধতাও জরুরি ছিল। তাই লড়াকু, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আর স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করার মার্চ মাস আজও বাংলা ও বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক কালপর্ব। এই কথা স্মরণ করলে খুব বেশি বলা হবে না যে, কালজয়ী মার্চ আর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এক ও অভিন্ন সূত্রে ইতিহাসের স্বর্ণমালা। মার্চ মাসের অর্জন-বিসর্জনের পালাক্রমে যার উজ্জ্বল নামটি আজও সমস্বরে উচ্চারিত হয়।

তিনি জাতির জনকই শুধু নন স্বপ্নদ্রষ্টা, আকাক্সক্ষা পূরণ আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের নিরবচ্ছিন্ন মহানায়ক। একজন মানবিক, উদার, জনবান্ধব, দেশপ্রেমিক আর নান্দনিক অভিজ্ঞানের অনন্য যোদ্ধা। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া স্বাধীনতার স্থপতির শৈশব-কৈশোর ছিল স্বাধীনচেতা, স্পষ্টবাদী, নির্ভীক জননেতার গড়ে ওঠার অনবদ্য পালাক্রম। ১০৪তম জন্মবার্ষিকী পার করার সুবর্ণ সময়ে স্বাধীনতার ৫৪তম শুভ অভ্যুদয়ের ক্ষণ শুরু হওয়া জাতির এক অপরিমেয় যুগ সন্ধিক্ষণ, অনন্য প্রাপ্তি। 
টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশে জন্ম নেওয়া এই সুবোধ বালকের ইতিবৃত্ত সত্যিই চমকপ্রদ। প্রভাতের সূর্যোদয় যে বার্তা দেয় সারাদিনের, বঙ্গবন্ধুর বেলায় তার ব্যতিক্রমও হয়নি। অতি বাল্যকাল থেকেই দেশ, মাটি আর মানুষের প্রতি যে অকৃত্রিম দায়বদ্ধতা তা বঙ্গবন্ধুর জীবন শুরুর এক ধারাবাহিক পর্ব। শুধু কি তাই? আজীবন তাড়িত করার মহাপর্ব তো বটেই।

শ্যামল বাংলার অপার প্রাকৃতিক সম্ভারে বিমুগ্ধ বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আবেগাপ্লুত হয়ে বিধৃত করেন- প্রকৃতির সঙ্গে মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে যায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ওই রকমই নরম, ওই রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম। সৌন্দর্যকেই আমরা ভালোবাসি। বঙ্গবন্ধুও নিরেট বাস্তববাদী, গণমানুষের অধিকার আদায়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সুললিত ভাষায় মাতৃভূমির বন্দনায় নিমগ্ন হয়ে যান।

সেখানেই সুপ্ত হয়েছিল তাঁর যথার্থ দেশনায়ক হওয়ার অনমনীয় বোধ। আবহমান বাংলার সবুজ প্রান্তর, নদী বিধৌত আর সমুদ্র পরিবেষ্টিত এদেশের নরম পলিমাটি। তারই কোলে লালিত সন্তানদের এমন অভিভূত নান্দনিক ঝঙ্কার তো চিরায়ত শৌর্য। তেমন সম্ভারের নান্দনিক রূপকার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা জীবনানন্দ দাশ তার সঙ্গে বহু বাঙালির সৃজন সাধক যেন মিলে মিশে একাত্ম।

তেমন শৈল্পিক সত্তায় জনগণের অনন্য নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু সময় সময় আলোড়িত কিংবা আন্দোলিত হতে হতে উজ্জীবিত হয়ে যেতেন। শুধু কি তা-ই? এই নরম সোঁদা মাটির আবহে সিক্ত হওয়া জাতির জনক আবার গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অধিকার আদায় আর বঞ্চনার আবর্তে পীড়িত হওয়াকে কোনোভাবেই মানতে পারতেন না। বজ্র কঠিন কণ্ঠে সমস্ত অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে খড়্গ হস্ত হতেও তাঁর হৃদয় কাঁপেনি। সময়ে তার যথার্থ প্রমাণ রাখতেও পিছপা হননি। 
১৯২০ সালে জন্ম নেওয়া জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু যে মাত্রায় গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে আন্দোলন আর সংগ্রামে তাঁর বিপ্লবী মনস্তত্ত্বকে লড়াইয়ে পরিণত করেন, সেটাও এক যুগোত্তীর্ণ ইতিহাস বৈকি। নিজের স্পষ্ট লেখনীতে মূর্তমান হয়, পুরো পরিবার ছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী শক্তি। যা বংশানুক্রমিক ধারার মতো বয়ে চলেছে। তেমন লড়াকু বংশ পরম্পরার সন্তান কিশোর মুজিবও নিজেকে ধারণ করলেন অগ্রজদের দৃষ্টান্তমূলক মহিমা।

যেখানে পরাধীনতার শৃঙ্খল যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ইংরেজদের হাতে কখনো কাবু হতে হয়নি শেখ বংশকে। ক্রমাগত লড়াই-সংগ্রামে ধ্বজা উড়িয়ে সম্পদ ক্ষয়ের নজির মিললেও বংশের গৌরবে সামান্যতম আঁচড়ও লাগেনি। সহায় সম্পদের ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণুতা দেখে দেখে বড় হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সঙ্গত কারণে শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে এক অনমনীয় সংগ্রামী অভিব্যক্তি ভেতরের বোধে জিইয়েও থাকত।

তেমন বৈপ্লবিক মনস্তত্ত্বে নিজেকে গড়ে তোলা এক উদীয়মান কিশোরের মানবিক ও মানসিক জগৎ। আর অবিভক্ত বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক পরিম-লে অস্থিরতার আমেজ আর বিক্ষুব্ধতার তা-ব সেটাও কিশোর মুজিবকে নানামাত্রিকে তাড়িত করত। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে, স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিভাবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত বনে গেলেন।

সেখানেও ঘটনা পরম্পরার এক ঝড় ঝঞ্ঝার উন্মত্ত প্রতিবেশ। শুধু তাই নয়, নিজ চোখে দেখেছেন দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ বপন, যা সারা ভারতবর্ষকে সাম্প্রদায়িকতার কোপানলে বিদ্ধ করে। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ জমিদার প্রথার নতুন মোড়কে যে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ভূমি মালিকানার প্রচলন করলেন, সেটাই সাম্প্রদায়িকতার বীজ উপ্ত করে বলে সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের লেখনীতে উদ্ভাসিত হয়।

মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় জমিদারি দেওয়া হয় হিন্দু জোতদারদের। আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার জমিদারি পায় মুসলমান ভূস্বামীরা। ফলে, জমিদার দ্বারা যে প্রজা শোষণ তা হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু দ্বারা মুসলমান কিংবা মুসলমান দ্বারা হিন্দু পীড়ন। অর্থাৎ শ্রেণি সংগ্রামের ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক ধারাকে মোড় ঘোরানো হয় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের দিকে। আর এখানে সুপ্ত হয়ে থাকে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষময় ফোড়া।

যার আঁচ আজ অবধি সংশ্লিষ্ট সকলেই বয়ে বেড়াচ্ছে। তেমন উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কট্টর পরিবেশ আর গড্ডলিকা প্রবাহে বঙ্গবন্ধুও একদিন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন বৈপ্লবিক চেতনায়। 
জাতির জনকের গড়ে ওঠার কাল শান্ত, স্নিগ্ধ তো ছিল না। বরং হরেক বিপর্যয়, পরাধীনতার গ্লানি ঔপনিবেশিক শাসকদের ক্রমাগত বঞ্চনা আর অত্যাচারের ইতিবৃত্তে তিনি  দেশ বিভাগের প্রাসঙ্গিক সংগ্রামকে আলিঙ্গনও করেন। তবে ভেতরের বোধে নিয়তই জিইয়ে থাকত স্বদেশী চেতনার অকৃতিম বোধ।

যুদ্ধে উন্মত্ত বিশ্ব যখন টালটামাল সে সময় ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় যে মহা মন্বন্তর, সেটাও বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য বিপন্নতা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তেমন দুঃসহ সামাজিক দুর্ভিক্ষ যেভাবে চিত্রায়িত করেন তা অবিশ্বাস্য এক লেখক সত্তা। তেমন মহা দুঃসময়ে বাজার সিন্ডিকেট যেভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্বিপাক সৃষ্টি করে, সেটাও উল্লেখ করেন মর্মাহত চেতনায়।

তাই বর্তমানে আমরা শুধু যে মুদ্রাস্ফীতি নয়, বরং বাজার সিন্ডিকেটের তা-বে ভারাক্রান্ত, সেটা সেই বিংশ শতাব্দী থেকে চলে আসা এক দুর্বিষহ কোপানল। নিজের জবানিতে যখন সাবলীলভাবে বর্ণনা করছেন, সেখানে শুধু জননায়ক নন, বরং নন্দিত শিল্পবোদ্ধা পাঠককেও চমৎকৃত করে। আরও কত দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে উদ্বেলিত করে, তাও সংশ্লিষ্ট মানুষ আর দেশের জন্য  অনন্য মমত্ববোধ, নিরবচ্ছিন্ন আবেগ। তিনি লিখলেন অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ আর মর্মাহত চেতনায় পাঠক যেন তেমন দুরবস্থাকে সামনেই অবলোকন করছে। 
শুধু ধর্মীয় সংস্কৃতিই নয়, বরং জাতিগত উদার মানবিক বোধে নিজেকে নতুনভাবে চিনতে খুব বেশি দেরি হয়নি বঙ্গবন্ধুর। ১৯৪৮ সাল থেকে বিভাজনের উত্তাল, বিক্ষুব্ধ রাজনীতি সারাদেশকে যে চক্রব্যূহে বেঁধে রাখে, সেখান থেকে সন্তর্পণে সযতেœ, সচেতন বোধে নিজেকে আলগা করে নিতেও বেশি সময় নেননি। আসলে বঙ্গবন্ধু গণমানুষের এক সংগ্রামী উদ্দীপ্ত মহানায়ক।

যিনি যেখানেই অত্যাচার, নিপীড়ন, অধিকার হরণ দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদী হয়ে ন্যায়ের সপক্ষে জোরগলায় আওয়াজও তুলেছেন। যা তাঁর ধারাবাহিক সংগ্রামী জীবনের এক সম্মিলিত পালাক্রম। কোথাও নিষ্ঠা বা আদর্শ বিচ্যুতি তো হয়ইনি, বরং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় বিন্দুমাত্র স্খলনও দৃশ্যমান হয়নি সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্যের গৌরবান্বিত অধ্যায়ে। 
বাঙালির চিরন্তন বোধ আর ঐতিহ্য সুরক্ষায় নিজের মূল্যবান জীবন, পরিবার, সুখ-শান্তি, অর্থবিত্ত সবই যেন দুমড়ে-মুচড়ে অতিক্রম করে গেছেন। মাথা উঁচু করে দর্পভরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে কণ্টকাকীর্ণ সমরাঙ্গনকেও ভ্রƒক্ষেপ করেননি। ৭ মার্চের সেই ভাষণ শুধু স্মরণীয়-বরণীয়ই নয়, বরং আজ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিলও। শত্রু পরিবেষ্টিত এক বিক্ষুব্ধ প্রতিবেশ, সামরিক শাসকের রক্তচক্ষুর সম্মুখে দুর্গম সময়ে উপস্থিত বাগ্মিতায় জনগণের নিমিত্ত তাঁর মুখ থেকে যে বাণী নিঃসৃত হলো তা যে কোনো ঐতিহাসিক পর্বের এক মহা মূল্যবান সম্পদ। 
লেখক : সাংবাদিক

×