ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

তিন বছরে নিহত ১৩ জন

রাজধানীতে দানবের মতো চলছে ময়লার গাড়ি

​​​​​​​ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

রাজধানীতে দানবের  মতো চলছে  ময়লার গাড়ি

.

বডি, হেডলাইট, ইন্ডিকেটর, রং দেখেই বোঝা যায় গাড়িটি ফিটনেসবিহীন। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে থাকা চালকদের অনেকেরই নেই ড্রাইভিং লাইন্সেস। কিশোর বয়সেই স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি নিয়ে দিনের পর দিন ছুটে বেড়াচ্ছে জনবহুল এই নগরীতে। কখনো কখনো আইন অমান্য করে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই চলছে উল্টো পথে। দিনের বেলায় চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মানা হচ্ছে না নিয়ম। সাইরেন বাজিয়ে যখন যে রাস্তায় মন চাচ্ছে, সে রাস্তায় ঢুকে যাচ্ছে চালক। চালকের কাছে মানুষকে যেন মানুষই মনে হয় না। অন্য গাড়িকেও পাত্তা দেন না তারা। যেন ট্যাংকার নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নগরীতে। রাজধানীতে এভাবে দানবের মতো চলাচল করছে সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়িগুলো। চালকদের এরূপ বেপরোয়া উগ্র মনোভাবের ফলে সংস্থার গাড়িগুলো দিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত তিন বছরে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, ব্যাংকার, গৃহবধূ, রিক্সাচালকসহ অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছেন। তবু টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। বরং সিটি করপোরেশন দায়ী চালকদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও এর মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি রয়েই গেছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সরকারি সংস্থার পরিবহন দ্বারা মানুষ নিহত হওয়ার পেছনে সংস্থার পরিবহন বিভাগের চরম অব্যবস্থাপনা নানা অনিয়মকে দায়ী করছেন। তাদের মতে, দুর্ঘটনাপ্রবণ রেখেই রাস্তায় গাড়ি চালানো হচ্ছে, তাই দুর্ঘটনা ঘটছে। আর এমন ঘটনা দুর্ঘটনা নয়; অবহেলাজনিত হত্যাকা- তবে সরকারি এসব গাড়ির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে কিছুটা সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। আর সিটি করপোরেশন দায় স্বীকার করে বলছে, পরিবহনের তুলনায় অর্ধেক সংখ্যক চালক রয়েছে তাদের। তা- অনেকের লাইসেন্স নেই। যেহেতু কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেহেতু লাইন্সেসধারী চালক নিয়োগ দিয়ে গাড়িগুলো চালানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ গাড়ির কাগজপত্র নেই, নেই ফিটনেসও। তা সত্ত্বেও কেবল সরকারি সংস্থা হওয়ায় এসব গাড়ি এর চালকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে না ট্রাফিক পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতেও মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মাহিন আহমেদ (১৩) নামে মতিঝিল আইডিয়ালের শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় চালক রুবেলের ড্রাইভিং লাইন্সেস পায়নি পুলিশ।

নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, ময়লার গাড়িটি খুব বেপরোয়াভাবে চলছিল। চালকও নেশাগ্রস্ত ছিল। প্রায়ই রাজধানীতে ময়লার গাড়িগুলো বেপরোয়া গতিতে চলতে দেখা যায়। অন্যান্য পরিবহনকে সুযোগ না দিয়ে কিংবা ধাক্কা দিয়ে, ট্রাফিক আইন অমান্য করে, উগ্রভাবে চলাচল করছে।

বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ময়লাবাহী গাড়িগুলো ময়লা নিতে এসে অনেক সময় যেখানে সেখানে পার্কিং করে রাখে। আবার যত্রতত্র ময়লা ফেলে চলাচল করে। আমরা তাদের কাজের সহযোগিতা করে থাকি। তবে আইন লঙ্ঘনের পর্যায়ে চলে গেলে আইনি ব্যবস্থাও নিয়ে থাকি। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করে থাকি। কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও সমন্বয় থাকে।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন এবং পুলিশ বিভাগ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এই দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকলে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বিষয়ে যদি সিটি করপোরেশন অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা নেয় তা হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।

ময়লার গাড়ি চাপায় তিন বছরে নিহত ১৩ কয়েক বছরে রাজধানীতে ময়লাবাহী গাড়ি চাপা ধাক্কায় বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। তবে এই সংখ্যা কোনো সংস্থার কাছে নেই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় ২০২১ সালেই সাতজন নিহত হওয়ার তথ্য জানা গেছে। আর ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এমনকি সংস্থাটির গাড়ির ধাক্কায় সংস্থার পরিচ্ছন্নকর্মী নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

২০২১ সালের ১৬ এপ্রিল যাত্রাবাড়ীতে ডিএসসিসির ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় মোস্তফা (৪০) নামের এক রিক্সাচালক নিহত হন। আহত হন রিক্সা আরোহী হরেন্দ্র দাস (৭০) ঘটনার পর পরই বিক্ষুব্ধ জনতা ময়লাবাহী গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে ১৭ জানুয়ারি গেন্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন বিভাগের স্টাফ খালিদ (৫০) নিহত হন। মে শাহজাহানপুর টিটিপাড়ায় ডিএনসিসির ময়লার ট্রাক চাপায় স্বপন আহমেদ দিপু (৩৩) নামে এক ব্যাংক কর্মচারী নিহত হন। আগস্ট শ্যামপুরের দোলাইরপাড় এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানার এক কর্মী নিহত হন। ২৪ নভেম্বর গুলিস্তানে ময়লার গাড়িচাপায় নাঈম হাসান নামে নটর ডেম কলেজের এক ছাত্র নিহত হন। নাঈমকে চাপা দেওয়া গাড়িটির আসনে ছিল পরিচ্ছন্নকর্মী। নাঈম হত্যার বিচারের দাবিতে টানা কয়েকদিন সড়ক অবরোধ নগর ভবন ঘেরাও করে আন্দোলন করেছিল নটর ডেমের শিক্ষার্থীরা। ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বসুন্ধরা সিটির উল্টোদিকে ময়লার গাড়ির চাপায় প্রাণ হারান প্রথম আলোর সাবেক কর্মী আহসান কবির খান। ২৩ ডিসেম্বর ওয়ারীতে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় স্বপন কুমার সরকার নামের আরেকজন নিহত হন।

২০২২ সালে ময়লার গাড়ি দুর্ঘটনায় অন্তত চারজন মারা যান। ওই বছরের এপ্রিল খিলগাঁওয়ে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান নববধূ নাসরিন খানম। ২৩ জানুয়ারি মহাখালীর উড়াল সড়কের কাছে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় শিখা রানী ঘরামি নিহত হন। তিনি ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন। একই বছরের জুলাইয়ে মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজের সামনে ময়লার গাড়ির চাপায় সাব্বির আহমেদ নামের এক তরুণ নিহত হন। ওই বছরের ৩১ মে রাতে মুগদার টিটিপাড়া মোড়ে ডিএসসিসির বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় নাজমা বেগম নামে এক পথচারী নারী নিহত হন।

গত বছরের মার্চ মিরপুর- সেকশনে ডিএনসিসির ময়লাবাহী গাড়িচাপায় মারা যান আবু তৈয়ব (২৬) নামের এক কাপড় ব্যবসায়ী। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে মুগদায় ডিএসসিসির ময়লার গাড়ি চাপায় সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিন নিহত হয়।

এসব দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডিএসসিসির গাড়ির ধাক্কায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় হতাহতের পরিবার মামলা করেছে। তবে গাড়ি চালক সরকারি সংস্থার হওয়ায় দোষীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের গা ছাড়া ভাব সব সময়ই রয়েছে। 

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের ময়লার অনেক গাড়ি চালাচ্ছে কিশোর। যার নেই লাইসেন্স কিংবা গাড়ি চালানোর কোনো অনুমতিপত্র। এমন বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি।

পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানায়, কাগজপত্র সবসময় অফিসে থাকে। কেননা এগুলো সিটি করপোরেশনের গাড়ি। এক চালক জানালেন, সিটি করপোরেশনের গাড়ি দেখে ট্রাফিক পুলিশ চেক করে না। তাই কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় না।

হারহামেশা দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনায় প্রাণহানির বিষয়ে জানতে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবহন বিভাগের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেননি। তবে যান্ত্রিক প্রকৌশলী বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের যে পরিমাণ পরিবহন রয়েছে, সেই সংখ্যক চালক নেই। বলা যায়, পরিবহনের তুলনায় অর্ধেক চালক রয়েছে। তাই অনেক সময় পরিচ্ছন্নকর্মীদের কেউ কেউ চালকের স্টিয়ারিংয়ে বসছে। তার মতে, ময়লাবাহী গাড়ির চালকদের কাগজপত্র আছে ঠিকই, তবে পেশাদার চালকের সংকট রয়েছে। লক্কড় ঝক্কড় ফিটনেস নেই এমন ৮০ শতাংশ গাড়ি নিলামে উঠানো হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ নতুন কেনা কিছু সংখ্যক গাড়ি দিয়ে ময়লা টানা হচ্ছে।

ডিএসসিসির তথ্যানুযায়ী, ডিএসসিসিতে যানবাহন আছে ৫১৩টি। এর মধ্যে ১৫০টি গাড়ি নিবন্ধিত। আর নগর সংস্থাটির নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা মাত্র ১৪৭। ২০০ গাড়ি চলে মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত চালক দিয়ে। বাকি ১৬৬টি গাড়ি কীভাবে চলে তার সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি ডিএসসিসির পরিবহন খাত। যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত, নিয়মের মধ্যেই অনিয়ম। নিবন্ধন ছাড়াই সড়কে চলছে গাড়িগুলো। এর মধ্যে কিছু গাড়ি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিবন্ধিত চালক ছাড়া ডিএসসিসির বাকি গাড়িগুলো চলে অদক্ষ অপ্রশিক্ষিত চালক দিয়ে। কখনো কখনো আবার ক্লিনারদেরও দেখা যায় চালকের ভূমিকায়। বৃহস্পতিবার রাতে শিক্ষার্থী মাহিন নিহতের ঘটনায়ও চালক রুবেলের ড্রাইভিং লাইন্সেস পায়নি পুলিশ। ফলে সংস্থার গাড়িগুলো দিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ময়লার গাড়ি বেপরোয়া গতিতে চালানোর অভিযোগ বহু পুরনো। বারবার দুর্ঘটনা ঘটালেও প্রতিকারে ব্যবস্থা নেয়নি নগর সংস্থা।

তবে বেশ কয়েকজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ময়লা বহনের গাড়ি যাকে তাকে দিয়ে চালানো হয়। গাড়ির তুলনায় চালকের সংখ্যা অনেক কম। যারা আছেন, তাদের অনেকে ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. হায়দার আলীকে ম্যানেজ করে ছুটিতে থাকেন। গাড়ি নিবন্ধন, পুরান গাড়ি নিলামে উঠানো নিয়ে অনিয়ম এবং মাস্টাররোলে নিজের পছন্দের চালকদের মুখের কথায় চাকরি দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে পরিবহন বিভাগের প্রধান এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বিষয়ে জানতে তাকে দুই দিন কয়েকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি এসএমএস করেও উত্তর পাওয়া যায়নি। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক  পরিচালক অধ্যাপক . মো. হাদিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের অব্যবস্থাপনা নানা অনিয়মের কারণেই সংস্থাটির ময়লার গাড়ি চাপায় মানুষ নিহত হচ্ছে। চালকের ঘাটতি থাকায় পরিচ্ছন্নকর্মী, সহকারী, কিশোরদের দিয়ে গাড়ি চালানো হচ্ছে। সংস্থাটির প্রশিক্ষিত চালক নেই, চালকদের অনেকের ড্রাইভিং লাইন্সেস নেই, আবার গাড়ির ফিটনেস নেই, নিবন্ধনও নেই। এমন দুর্ঘটনা প্রবণগুলো রেখে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা তো ঘটবেই। তাই এগুলো দুর্ঘটনা, নাকি অবহেলাজনিত হত্যাকান্ড তা নিয়ে ভাবতে হবে।

তিনি বলেন, সরকারি পরিবহন খাত বেসরকারি পরিবহনকে পথ দেখাবে। অথচ সরকারি সংস্থার গাড়িই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এমন হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য খারাপ নজির স্থাপন হবে। শুধু চালকদের দোষারোপ করলেই হবে না; আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের সংশ্লিষ্টদের জবাবহিদির আওতায় আনতে হবে। সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি গাড়ি হোক, আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শতভাগ আইন প্রয়োগ করতে হবে। কঠোর আইনের বিধান করা ছাড়া এমন দুর্ঘটনা কমবে না।

×