ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাপপ্রবাহ না কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না

রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন সত্ত্বেও করতে হচ্ছে লোডশেডিং

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ০০:০৯, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন সত্ত্বেও করতে হচ্ছে লোডশেডিং

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে গত সোমবার। ওই দিন রাত ৯টায় উৎপাদিত হয় সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ১৬ হাজার না হলেও ১৫ হাজার ৯৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় মঙ্গলবারও।  কিন্তু তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭২০ মেগাওয়াট।

ফলে দেশজুড়ে লোডশেডিং করতে হয় ৭৩৮ মেগাওয়াট। তীব্র গরমে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা জনজীবন তখন ঘ›ণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকায় নাজেহাল হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে পল্লী এলাকার মানুষকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। তবে তাপপ্রবাহ না কমলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান।

বিদ্যুৎ বিভাগ দাবি করছে, বর্তমানে দেশব্যাপী চলা তীব্র তাপপ্রবাহে বিদ্যুৎ বিভাগ আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জনজীবনে স্বস্তি বজায় রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনেরও চেষ্টা চলছে। কিন্তু চাহিদা এত বেড়ে গেছে যে সর্বোচ্চ উৎপাদন হলেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, কাঠফাঁটা গরমের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে অফিস-আদালত-কলকারখানা পূর্ণদ্যমে চালু হয়েছে।

এমন অবস্থায় বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে পৌঁছাতে পারে সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াটে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি। তাই চাহিদা বাড়লেও সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না কেন্দ্রগুলো। এতে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। 
বুধবার জামালপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান লোডশেডিংয়ের বিষয়ে বলেন, তাপপ্রবাহের মধ্যে গ্রামে বিদ্যুৎ থাকছে না বিষয়টি আমরা জানি। এর কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় গ্যাসের স্বল্পতা এবং অতিরিক্ত চাহিদা। তবে তাপপ্রবাহ কমে গেলে লোডশেডিং স্বাভাবিক হবে বলে আমরা আশা করছি। তিনি বলেন, যা চাহিদা, তার তুলনায় একটু কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, এর জন্য লোডশেডিং হচ্ছে।

তবে হিটওয়েভ কমে গেলে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তখন আর লোডশেডিং থাকবে না। বোরো মৌসুমে সেচের জন্য আমরা অগ্রাধিকার দেই। যাতে সেচে কোনো বিঘœ না ঘটে। কেপিয়াই এরিয়াগুলোসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বাদ দিয়ে বাকি সব জায়গায় সমানভাবে লোডশেডিং দেওয়া হয়।
তাপমাত্রার পারদ যখন ছুঁয়েছে ৪২ ডিগ্রির ঘর তখন সপ্তাহের ব্যবধানে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারের তথ্যানুসারে দেখা যায়, গত ১৪ এপ্রিল দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট, যার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। ১৫ এপ্রিল চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার  মেগাওয়াটে, যার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৫৪৩ মেগাওয়াট।

এরপর ১৬ এপ্রিল বিদ্যুতের চাহিদা দঁাঁড়ায় ১৫ হাজার মেগাওয়াটে, যার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৮৯০ মেগাওয়াট। ১৭ এপ্রিল চাহিদা কিছুটা কমে ১৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে নেমে আসে, যার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৬ হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। ১৮ এপ্রিলও চাহিদা ১৪ হাজার ৮১ মেগাওয়াটে বজায় থাকে। তবে শনিবার আবার বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়।

সেদিন চাহিদার ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৩৫৮ মেগাওয়াট, ফলে লোডশেডিং দিতে হয় ১৪২ মেগাওয়াট। আর রবিবার বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে, যা গত এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি গরমে এই চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা আশঙ্কা করছি এই গরমে বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হতে পারে। এই চাহিদা পূরণ করে আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের বড় বাধা অর্থ। অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাসের জন্য উৎপাদন করতে পারছে না। অনেকে আবার সামান্য কিছু উৎপাদন করছে। এর একমাত্র কারণ টাকার অভাবে আমাদের এলএনজি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি কিছু অর্থ ছাড় করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তাই এ সময়টায় সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কোথাও কোনো সঞ্চালন বা বিতরণে সমস্যা থাকলে তা যেন দ্রুত কর্তৃপক্ষকে জানানো হতে হবে। 
তিনি বলেন, আমাদের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সরকার বদ্ধপরিকর। সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার মধ্যে দ্রুত সমন্বয় করা হচ্ছে। অগ্রধিকার অভ্যন্তরীণ ত্রুটি মেরামত করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রাথমিক জ্বালানি নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

শুধু অর্থমন্ত্রণালয়ের টাকা ছাড় না হওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) কেনা সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের অনেকগুলো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই প্রয়োজনীয় গ্যাসের অভাবে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আমরা বন্ড আকারে কিছু টাকা পেয়েছি। আগামী কিছু দিনের মধ্যে আরও কিছু টাকা পাব। তবে  সেটা অতি সামান্য।
লোডশেডিং কমাতে বিদ্যুৎ বিভাগের তৎপরতা :
এবারের গ্রীষ্মে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আগের চেয়ে বাড়বে অনেক বেশি। ভোগাতে পারে লোডশেডিংও। গরমের মওসুমে ২০২৩ সালে দেশে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখন জ্বালানির অভাবে উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে না পারায় লোডশেডিংয়ে নাকাল হতে হয়েছে  ভোক্তাদের। এক দিন সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গিয়েছিল গতবার।

এবার চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা বিদ্যুৎ বিভাগের। সে কারণে গ্যাসের প্রয়োজনীয় যোগান দিয়ে সাশ্রয়ী ও বড় ধরেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সুফল পাওয়ার দিকে নজর দিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যেই গত শনিবার নসরুল হামিদ আশুগঞ্জ পাওয়ার পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদন ইউনিটগুলো পরিদর্শন করেন। এ সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পূর্ণ সুফল পেতে করণীয় নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি।

একই ভাবে অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও পরিদর্শন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে জনগণকে যেনো দুর্ভোগ পোহাতে না হয়। আর এ লক্ষ্যে লোডশেডিং না করার জন্য আমাদের যা যা করণীয় সব করার চেষ্টা করছি। বাকিটা দেখা যাক কি হয়। তিনি বলেন, আমাদের চেষ্টা হচ্ছে দেশকে লোডশেডমুক্ত রাখা। এখন আমি ভয় পাচ্ছি যে, মধ্যপ্রাচ্যে যে  সঙ্কট তৈরি হচ্ছে সেটা আবার আমাদের দেশে নতুন সংকট তৈরি করে কি না? এটা একটা বড় বিষয়। সেটাকে মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।
লোডশেডিংয়ে নাজেহাল তৃণমূলের মানুষজন ॥ সম্প্রতি লোডশেডিংয়ে বেশি নাজেহাল হতে হচ্ছে সিলেট, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, বরিশাল অঞ্চলের বাসিন্দাদের। সরবরাহ না থাকায় বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন এসব এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত কর্মকর্তারাও। পিডিবি’র হবিগঞ্জ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকোশলী মঞ্জুর মোর্শেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের শহরে দৈনিক চাহিদা ১৭ থেকে ১৮ মেগাওয়াট পর্যন্ত। কিন্তু আমরা সরবরাহ পাচ্ছি ১২ থেকে ১৩ মেগাওয়াট। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কিছুটা ভোগান্তি হচ্ছে এক্ষেত্রে। তবে আশা করছি গরমের তীব্রতা কমলে লোডশেডিং কিছুটা কমবে। 
বিদ্যুতের সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় গত প্রায় একসপ্তাহ যাবত লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দারা। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, এই সিটিতে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা অন্তত : ১৫০শ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৮০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট। ফলে প্রতিদিন ৭০ থেকে একশ’ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

ফলে গরমে নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ক্ষোভ প্রকাশ করে নগরীর শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রুপক দাস বলেন, বছর বছর শুনি বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছে। কিন্তু কি লাভ যদি প্রয়োজনের সময় বিদ্যুৎ না থাকে। দিনে বাইরে থাকা যাচ্ছে না আবার রাতেও স্বস্তি নেই। এত কষ্ট আমাদেরই কেনো পোহাতে হতে হবে? 
একই অবস্থা ময়মনসিংহেও। বৃহত্তর ময়মনসিংহে এই কয়দিনে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০ মেগাওয়াটে।

কিন্তু বিপরীতে সরবরাহ পাচ্ছে মাত্র ১৬০ থেকে ১৮০ মেগাওয়াট। এতে করে এখানে লোডশেডিংও বেশি হচ্ছে। নগরীর কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তীব্র গরমে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা তখন ঘরে আসলে বিদ্যুৎ থাকছে না। এত বিদ্যুৎ কই যায়?

যদি সাধারণ মানুষকেই কষ্ট পোহাতে হয় তাহলে শতভাগ বিদ্যুতায়নের সুফল হলো কি? গত ১ এপ্রিল থেকে ময়মনসিংহ,  শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলায় এমন কোনো দিন নেই, যেদিন লোডশেডিং করতে হয়নি। টাঙ্গাইলের কৃষকরা জানিয়েছেন, সেচের অভাবে বোরো ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।

×