ঐতিহ্যবাহী নিলাম ঘর
পুরান ঢাকার নিলাম ঘর। সোয়া শ’ বছরের পুরনো একটি ভবন। মানে, প্রায় ১১৫ বছর আগের কথা। তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। এটিকে সাধারণ স্থাপনা ভাবার কোন কারণ নেই। নিঃসন্দেহে কালের সাক্ষী। ঐতিহ্যের অংশ। অথচ সে ঐতিহ্যে নির্মম কুঠারাঘাত করা হয়েছে। দ্বিতল ভবনের ওপরের তলা এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন।
হেমার শাবল ইত্যাদি দিয়ে পিটিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। খোদ ঢাকায় ঘটেছে এ ঘটনা। না, কোন ভূমিদস্যুর কাজ নয়। আইনজীবীদের একটি সংগঠন এ ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আরও ঘোরতর অভিযোগ এই যে, হাইকোর্টের নির্দেশনা সম্পূর্ণ অমান্য করে কাজটি করছেন তারা। এ ঘটনায় ঢাকার ঐতিহ্য সচেতন মানুষেরা যারপরনাই বেদনাহত। ক্ষুব্ধ। প্রতিবাদও অব্যাহত রেখেছেন তারা। ভবনের যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকুই সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা।
যত দূর জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে রায় সাহেব বাজার সংলগ্ন এলাকায় ভবনটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমান ঠিকানা ১৫, ১৫/১ কোর্ট হাউস স্ট্রিট। ঢাকা ডিসি অফিসের ঠিক পেছনে অবস্থিত। ইতিহাসবিদরা বলছেন, সেই কালে খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে অনেকের সম্পত্তি নিলামে তোলা হতো। নিলামে সম্পদ বিক্রির সমুদয় কাজ হতো অকশন হাউস বা নিলাম ঘরে। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত এ ঘরে নিলামে মালামাল বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা গবেষকরা।
নিলাম ঘর ইউরোপীয় নব্য ধ্রুপদ নির্মাণশৈলীর অনন্য নিদর্শন। সারিবদ্ধ খিলান ও করিন্থিয়ান কলাম ভবনটিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেয়। বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এবং ঐতিহ্যপ্রেমীরা নিলাম ঘর নিয়ে ভীষণ কৌতূহলী ছিলেন। বাইরের দেশ থেকে আসা পর্যটকরাও দীর্ঘ যানজট ঠেলে সেখানে ছুটে যেতেন। মুগ্ধ হয়ে দেখতেন চুন সুরকি পলেস্তরায় নির্মিত ভবন। ভবনের নির্মাণশৈলী, কারুকাজ প্রাচীন ঢাকার স্থাপত্য রুচি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে আসছিল দর্শনার্থীদের।
জানা যাচ্ছে, বর্তমানে নিলাম ঘরটি অর্পিত সম্পত্তি। সরকারের কাছ থেকে ১ বছরের জন্য লিজ নিয়ে এটি ব্যবহার করছে আইনজীবীদের সংগঠন ঢাকা আইনজীবী সমিতি। মাত্র কিছুদিন আগে লিজ নিয়ে এখন হঠাৎ করেই নিলাম ঘরটি ভাঙ্গা শুরু করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগকারীরা বলছেন, ঐতিহ্য বিনষ্ট করে এখানে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ করতে চায় আইনজীবী সমিতি। অনেক দিন ধরেই এমন অশুভ তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। সর্বশেষ গত রবিবার তারা ভবন ধ্বংসের কাজ শুরু করে।
পরদিন সোমবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সত্যি সত্যি ভবনের ওপরের তলা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওপরের দিক থেকে তোলা একাধিক ছবিতে যে অনন্য সাধারণ ভবনটি দেখা যেত এতদিন, সেটি এখন ধুলোবালির স্তূপ! ছবির সঙ্গে কোন মিল নেই। ভগ্নাংশ দেখে ভেতরটা হু হু করে ওঠে। রাজধানী শহরে, শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তিদের চোখের সামনে এমন ধ্বংসলীলা চালানো কী করে সম্ভব হলো? কে দেবে উত্তর? দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া গেল না। পরে জানা যায়, প্রথম দিনই নিলাম ঘর গিলে খাওয়ার প্রতিবাদে ভবনের সামনে সমবেত হয়েছিলেন আর্বান স্টাডি গ্রুপ নামের একটি সংগঠন। তাদের প্রতিবাদের মুখে আপাতত ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ রয়েছে।
পরে শাহবাগে গিয়ে দেখা যায়, আর্বান স্টাডি গ্রুপের সদস্য এবং সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে ঐতিহ্যপ্রেমীদের ভেতরের কান্নাটা অনুধাবন করা যায়।
প্রতিবাদে অংশ নেয়া তরুণ ফাইয়াজ বলছিলেন, ভবন ভাঙ্গা হচ্ছে খবর পেয়ে তৎক্ষণাত সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম আমরা। প্রতিবাদও করেছি। কিন্তু আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম। আইনজীবীরা ছিলেন বেশি।
ফাইয়াজের অভিযোগ, আইনজীবী হয়েও তারা চরম অন্যায় করেছেন। তাদের একটি অংশ প্রতিবাদকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে। ভবন ভাঙ্গার দৃশ্য ভিডিও করা হয়েছিল। সেগুলো ডিলিট করতে বাধ্য করেছেন তারা।
একই স্থানে কথা হয় গ্রুপের প্রধান নির্বাহী আর্কিটেক্ট তাইমুর ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকারের শর্ত অনুযায়ী, লিজ নিয়ে ভবনের কোন ক্ষতি করা যাবে না। সংস্কারের নামে স্থাপনার গায়ে হাত দেয়া যাবে না। ভাঙ্গা তো দূরের কথা। অথচ তারা ভবনটি গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন।
আগের কিছু তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের এক রিটের প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট ঢাকার মোট ২২০০ ভবন ভাঙ্গার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। নিলাম ভবন সেগুলোর অন্যতম। অথচ হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে আইনজীবীরাই ভবনটি ভাঙছেন। এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে?
এ ভবন ভাঙ্গা বা ভবনের স্থানে নতুন স্থাপনা নির্মাণ সম্পূর্ণ অবৈধ জানিয়ে তিনি বলেন, সারা দুনিয়াতেই প্রাচীন ভবন ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এমন অসংখ্য প্রাচীন এবং বিখ্যাত ভবনের কথা আমরা জানি। দেশেও এ ধরনের কিছু কাজ হচ্ছে। নিলাম ঘরটিও রিস্টোরেশনের মাধ্যমে সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি। বলেন, ভবিষ্যত প্রজন্মকে আমাদের অতীত সম্পর্কে জানতে দিতে হবে। তা না হলে সব উন্নয়ন ব্যর্থ হবে। নিশ্চয়ই আমরা এভাবে ব্যর্থ হতে চাই না।