
জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ ঈদে ১০ দিনের বর্ধিত ছুটির দাবিতে গাজীপুরের টঙ্গীর ক্রিয়েটিভ কালেকশন কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের সময় টঙ্গী শিল্প এলাকার মিল বাজার শহীদ সুন্দর আলী সড়ক ও এর আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় পুলিশের মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেটের মুখে শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সংঘর্ষে সাত পুলিশসহ অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত ১৩ শ্রমিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন মামুন (২৭), রবি (২১), লতিফ (১৯), ইমরান (১৯), রুবেল (২৪), রনি (২২), এহসানুল হক (৩৫), রাজিবুল (২৫), হাসান (২৫), হাসিনা (৪০), রুবেল (২২), সাব্বির (২২) ও সাবিনা (২৫)। গুরুতর আহত পুলিশের সিটি এসবি শাখার এএসআই রুবেলকে (৩০) টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে গাজীপুরের কয়েকটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানায় কর্মবিরতি পালন করে এবং ভাংচুর চালায়। এছাড়া ঈদের ছুটি বাড়ানোর দাবিতে রাজধানীর কালশীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। টানা তিন ঘণ্টা সড়ক অবরোধের ফলে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের মধ্যস্থতায় গার্মেন্টস মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ঈদে ১০ দিনের ছুটির দাবি মেনে নিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের।
টঙ্গী পশ্চিম থানা পুলিশের ওসি শাহ্ আলম জনকণ্ঠকে জানান, শ্রমিকরা রাস্তায় আন্দোলনে নেমে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। তাদের থামাতে গেলে পুলিশের প্রতি তারা আক্রমণ চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এ্যাকশনে যায়।
আন্দোলনরত শ্রমিকরা জনকণ্ঠকে জানান, তারা আরও আগে থেকেই আসন্ন ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে ১০ দিনের ছুটির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ৭ দিনের ছুটি দিতে রাজি হয়। পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে শ্রমিকরা ১০ দিনের ছুটি ভোগ করার জন্য বিগত দুটি বন্ধের দিন কাজ করেন। ঈদের ছুটির মধ্যেই আরও একটি বন্ধের দিন পড়ায় শ্রমিকদের হিসেবে তারা মোট ১০ দিনের ছুটি প্রাপ্ত হন। কিন্তু সোমবার সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগদান করতে এসে জানতে পারেন, তাদের ৭ দিনেরই ছুটি দেয়া হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে দশ দিনের ছুটির দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ জানান, অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কায় কারখানায় পুলিশ মোতায়েন করা হলে শ্রমিকরা পুলিশের সঙ্গে উচ্ছৃংখল আচরণ শুরু করে। একপর্যায়ে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশ শর্টগানের ফাঁকা গুলি ছোড়ে। শ্রমিকদের হামলায় শিল্প পুলিশের একজন এএসপিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন বলে তিনি দাবি করেন।
এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের ব্যাপক কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেটের মুখে শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে বেলা পৌনে ১টায় শ্রমিকরা পুনরায় একত্রিত হয়ে মিলগেট বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে হটাতে পুলিশও আরও শক্তি বৃদ্ধি করে। একপর্যায়ে বেলা সোয়া ১টায় কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও শর্টগানের গুলিবর্ষণ করে পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে পুলিশ প্রহরায় যানবাহন চলাচল শুরু হলে বেলা দেড়টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার মাসুদ রানা জনকণ্ঠকে জানান, পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষের ঘটনায় সোমবার বেলা দেড়টা পর্যন্ত ১৯ জনকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আনা হয়। তাদের মধ্যে বুলেটবিদ্ধ ১৩ শ্রমিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। পুলিশের একজন অফিসারকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আহত শ্রমিকদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ (রাবার বুলেট) বলে তিনি জানান। এছাড়া আহত নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগই কাঁদানে গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
গাজীপুরে কর্মবিরতি, ভাংচুর ॥ ঈদের ছুটি বাড়ানোর দাবিতে সোমবার গাজীপুরের কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা একটি কারখানায় ভাংচুর করেছে।
জানা যায়, কালিয়াকৈরের বিশ্বাসপাড়া এলাকার স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের স্টার লিঙ্ক ডিজাইন লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা গত কয়েকদিন ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে ঈদ উপলক্ষে ১২ দিন ছুটি দাবি করে আসছিল। সোমবার কারখানা কর্তৃপক্ষ ঈদের ৩ দিন ছুটি ঘোষণা দেয়। এতে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ছুটি বাড়ানোর দাবিতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে কারখানায় হামলা চালিয়ে ভাংচুর শুরু করে। তারা কারখানা থেকে বের হয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে অবরোধ তুলে দেয়। পরে পুলিশের মধ্যস্থতায় কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা শেষে কর্তৃপক্ষ ঈদের ছুটি ১০ দিন ঘোষণা করে। এছাড়াও একই দাবিতে ভবানীপুর এলাকার ফুওয়াং ফুড, নিশাদ নগর এলাকার তামিশনা ফ্যাশনসহ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি করেছে। পুলিশের মধ্যস্থতায় শ্রমিকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আলোচনা শেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
কালশীতে সড়ক অবরোধ ॥ ঈদের ছুটি বাড়ানোর দাবিতে রাজধানীর কালশীতে ফের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। টানা ৩ ঘণ্টা সড়ক অবরোধের ফলে আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের মধ্যস্থতায় গার্মেন্টস মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ঈদে ১০ দিনের ছুটির দাবি মেনে নিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার সকাল ৯টার দিকে মিরপুরের কালশীর ২২ তলা স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টস শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল করে কারখানার সামনে অবস্থান করে সড়ক অবরোধ করে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে শ্রমিকদের বুঝিয়ে দুপুর ১২টায় সড়ক থেকে তাদের সরিয়ে দেয়। পরে দুপুর ২টার দিকে আবারও শ্রমিকরা কারখানার সামনের সড়কে জড়ো হন।
আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, বছরের দুটা ঈদ ছাড়া বাড়ি যাওয়া হয় না। সারা বছর কাজ করতে হয়। কিন্তু এবার ঈদে মাত্র তিনদিন ছুটি দেয়া হয়েছে। ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড় যেতে-আসতে দুদিন শেষ হয়ে যায়। তাহলে কিভাবে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদ করব? ঈদে বাড়তি ছুটি পাব- এ আশায়ই তো বাড়তি কাজ করা। আগে মালিকপক্ষ বলেছিল ৮ দিনের ছুটি দেবে। কিন্তু সোমবার ঘোষণা দেয়া হয় ঈদের ছুটি ৩ দিন। তাই আন্দোলনে নেমেছি।
পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং মালিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চালায়। বিকেল ৩টার দিকে পল্লবী থানা পুলিশের মধ্যস্থতায় গার্মেন্টস মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ঈদের ১০ দিনের ছুটির দাবি মেনে নেয় এবং স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ছুটির ঘোষণা দেয়।
পল্লবী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ জানান, পুলিশের মধ্যস্থতায় মালিকপক্ষ ছুটির দাবি মেনে নেয়। শ্রমিকদের ঈদের ছুটি বাড়িয়ে ১০ দিন করা হয়। পরে শ্রমিকরা সোমবার ডিউটি না করে বাসায় ফিরে যায়।
এর আগে শনি ও রবিবার মিরপুরের বেশ কটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা একই দাবিতে রাস্তায় নামেন।