শংকর কুমার দে ॥ চলতি এপ্রিল মাসে আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নামের জঙ্গী সংগঠনের মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়ার বিরুদ্ধে। এক ডজনের বেশি প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার হত্যাকা-ের হুকুমদাতা বিশ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত মোস্ট ওয়ান্টেড এই জঙ্গী নেতা কোথায়- এটাই এখন প্রশ্ন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় আদালতে যে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে তাতে পলাতক আসামি দেখানো হয়েছে মেজর জিয়াকে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জঙ্গী সংগঠনের মাস্টারমাইন্ড মেজর জিয়াকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট যেসব প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার হত্যাকা-ের মামলার তদন্ত করছে তাতে প্রায় এক ডজন মামলার আসামি মেজর জিয়া। জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধানেরও দায়িত্বে আছেন তিনি। জঙ্গী সংগঠনের এই মাস্টারমাইন্ড নিজে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং আর্মি ট্রেনিং থাকায় কিলিং অপারেশন যারা চালাবে সেই সব জঙ্গীদের দেশের বিভিন্ন গোপন শিবিরে প্রশিক্ষণ দেন। তার সন্ধানে পুলিশ, র্যাব, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, গোয়েন্দা সংস্থা একযোগে দেশব্যাপী সাঁড়াশি ও কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করছে। সম্প্রতি সাভারের এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে দুই দিন অবস্থান করেন তিনি। সেখানে অবস্থানের সংবাদ পেয়ে পুলিশ সাভারের ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে। কিন্তু ধূর্ত মেজর জিয়া সেখানে নেই।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, আনসার আল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য আবু সিদ্দিক সোহেলের গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে তাতে সে উল্লেখ করেছে, ২০১৪ সালের নবেম্বর মাসে সে (বহিষ্কৃত মেজর জিয়া) মেসেজের মাধ্যমে আমাকে বেসিক দাওরা কোর্স করার নির্দেশ দেয়। সেই মাসেই তার নির্দেশ মতো আমি একদিন হাজী ক্যাম্পের সামনে গেলে আবীর ভাই আমাকে রিসিভ করে দক্ষিণখানের একটি বাসায় নিয়ে যান। সেখানে আমি, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, তালহা, হাবিব ওরফে মাসর’র দাওরা ট্রেনিং করি। ট্রেনিং করায় বড় ভাই মেজর জিয়া এবং আবীর ভাই। ট্রেনিংয়ের বিষয়বস্তু ছিল গেরিলা যুদ্ধের কৌশল, বাসা ভাড়া নেবার কৌশল, বাসায় বসবাসের নিয়ম, নিরাপত্তা কৌশল, কম্পিউটার চালনাসহ এলমি শিক্ষা। আনসার আল ইসলাম সদস্যদের ঢাকার অভিজাত এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর স্থানে রেকি করারও কিছু কিছু তথ্য পেয়েছেন। তবে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ এবং সংগঠিত হওয়ার দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার হওয়া আবু সোহেল সিদ্দিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, তাদের ‘বড় ভাই’ মেজর জিয়া সংগঠনের সব সদস্যের সঙ্গে সিক্রেট এ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকে। এমনকি প্রত্যেক সদস্যকে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেই এ্যাপসে হাজিরা দিতে হয়। এতে কারও ব্যত্যয় হলে প্রথমেই ধরে নেয়া হয়- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরে থাকতে পারে। তখন প্রাথমিকভাবে তার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে ইন্টেল গ্রুপ গোপনে তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে থাকে। শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই আবার তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাদের বড় ভাই জিয়াও প্রতিটি মুভমেন্টের আগে নিরাপত্তার বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই কোথাও যাতায়াত করে থাকে। এ কারণে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা ধরা পড়ে না, যদিও ধরা পড়ে তবে অন্য সদস্যদের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য দিতে পারে না। আর এ জন্যই জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের মাথা বড় ভাই মেজর জিয়া যতদিন পর্যন্ত গ্রেফতার না হবে ততদিন পর্যন্ত জঙ্গী সংগঠনটির তৎপরতা বন্ধ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়েই থাকবে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর এ ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করার পর সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত হয়ে আত্মগোপনে যান মেজর জিয়া। আত্মগোপনে থেকে জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা শাইখ জসিমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জসিমউদ্দিন রাহমানী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলে মেজর জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলাটিম প্রধানের দায়িত্ব নেন। মাস্টার প্ল্যান করে ব্লগার হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নামেন। যারা ইসলাম নিয়ে সমালোচনা করে তাদের বেছে বেছে হত্যা করার নির্দেশ দেন তিনি। তার পরিকল্পনার ধরন হচ্ছে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দুটি জঙ্গী সংগঠনের একটি আনসার আল ইসলাম, যার শীর্ষ নেতা বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হককে ধরতে পারা পুলিশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেজর জিয়ার নেতৃত্বেই এখন আনসার আল ইসলাম সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আনসার আল ইসলাম এবং মেজর জিয়াই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্য জিয়াকে ধরা তাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, সেনা বাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করার পর থেকেই সে পলাতক রয়েছে। প্রথম দিকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কথা বলা হলেও বর্তমানে সে আরেক নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা। দীর্ঘ দিন ধরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম নামে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী এই সংগঠনটির বেশিরভাগ সদস্যই উচ্চশিক্ষিত এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষভাবে দক্ষ। এ জন্যই মাঝে মধ্যেই তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সর্বশেষ প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলায় যে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে তাতে মেজর জিয়াকে পলাতক দেখিয়ে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। এরপর থেকে তাকে গ্রেফতারের জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, মেজর জিয়া খুব বেশি ধূর্ত প্রকৃতির। সে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলে অনেক ভেবেচিন্তে। নিজের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করার পরই কেবল সে সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বা কারও আস্তানায় যায়। মেজর জিয়া তার সংগঠনে অসংখ্য স্লিপার সেল গঠন করেছে। যারা ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। এ কারণে কোন একজন সদস্যকে গ্রেফতার করা গেলেও তার কাছ থেকে অন্যদের সম্পর্কে বেশি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এই কৌশলের মাধ্যমেই আনসার আল ইসলাম নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তাকে ধরতে গত বছরের ২ আগস্ট ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। আর এ বছর জিয়ার নেতৃত্বাধীন আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হয়েছে। মেজর জিয়া তার নিজের সামরিক প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে সদস্যদের ‘গেরিলা যোদ্ধা’ হিসেবে প্রস্তুত করছে। যাদের মূল লক্ষ্য হলো ‘টার্গেট কিলিং’। ২০১৩ সালে এই সংগঠনের টার্গেট গ্রুপ হলো ব্লগার, নাস্তিক, সেক্যুলার, রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের টার্গেট করে যাত্রা শুরু করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে জঙ্গী সংগঠনটির কোমর ভেঙ্গে গেছে, ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে জঙ্গী সংগঠনটির মাস্টারমাইন্ড মেজর জিয়া।