ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্প আরও এক বছর বাড়ানোর দাবি

আনন্দ স্কুলের কয়েক লাখ শিশুর লেখাপড়া বন্ধ হতে চলেছে

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ১১ মে ২০১৮

আনন্দ স্কুলের কয়েক লাখ শিশুর লেখাপড়া বন্ধ হতে চলেছে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আনন্দ নেই প্রাথমিক স্তরের শিশুদের ‘আনন্দ স্কুল’ শিক্ষা কার্যক্রমে! একদিকে নানা অনিয়মের কারণে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া অন্যদিকে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার সময় সামনে আসায় সঙ্কটের মুখে পড়তে যাচ্ছে ঝরেপড়া, নদীভাঙন ও চরাঞ্চলের বিদ্যালয় হাজার হাজার গরিব শিশু। আগামী ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। অথচ প্রায় দেড় লাখ শিশু এখন পড়ালেখা করছে তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীতে। ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হলে পঞ্চম শ্রেণীও শেষ হবে না প্রায় এক লাখ শিশুর। এ অবস্থায় অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধসহ শিশুদের কথা চিন্তা করে অন্তত এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। যে প্রকল্পের অধীন শিশুদের আনন্দ স্কুল সেই ‘রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক)’ প্রকল্পের নতুন পরিচালক মোঃ দেলোয়ার হোসেইন বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরে শেষ হবে প্রকল্পের মেয়াদ। কিন্তু যে অবস্থা তাতে শিশুদের সাইকেল (প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণী শেষ করা) শেষ করতে অন্তত এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো জরুরী। ডিসেম্বরে প্রকল্প শেষ হলে প্রায় এক লাখ শিশুর পঞ্চম শ্রেণী শেষ হবে না। আমি নতুন আসছি এ পদে। চেষ্টা করছি। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছেও একটি কর্মশালার মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত বলার মতো কিছু নেই। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, অনিয়মের কারণে এখন অনেকটাই অচল হয়ে পড়েছে ‘রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক)’ প্রকল্প পরিচালিত অধিকাংশ ‘আনন্দ স্কুল’। নানা কারণে গত এক বছরে প্রায় দুই হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। নিয়মিত বেতন-ভাতা ও শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, শিক্ষা উপকরণ ও অন্যান্য খরচ না দেয়ার কারণে বন্ধ হওয়ার পথে আরও সহ¯্রাধিক স্কুল। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ শেষে বর্ধিত সময় পার করেও বরাদ্দের প্রায় ৫০ শতাংশ অর্থ খরচ হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, কর্মশালা, সভা-সমাবেশের নামে ভুয়া ভাউচার বানিয়ে অর্থ লোপাট করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নতুন পরিচালক আসার আগে গত কয়েক মাস প্রকল্প পরিচালককের পদ ফাঁকা থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে বলছেন অনেক কর্মকর্তা। জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া, নদীভাঙন ও চরাঞ্চলের বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৩ সালে পাঁচ বছর মেয়াদে রস্ক-২য় পর্যায় প্রকল্পটি চালু করা হয়, যা ‘আনন্দ স্কুল’ নামে পরিচিত। আনন্দ স্কুলে শুধু ৮ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা ভর্তি হতে পারবে, যারা কখনও স্কুলে যায়নি বা প্রাথমিকেই ঝরে পড়েছে। একটি স্কুলে কমপক্ষে ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে। শহর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ বৎসরিক ৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং উপজেলা পর্যায়ে প্রায় দেড় হাজার টাকা দেয়া হয়। তবে কেউ সরকারী প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি থাকা অবস্থায় আনন্দ স্কুলে ভর্তি নেয়া হয় না। যেসব শিশু বিদ্যালয় যেতে পারেনি তাদের দ্বিতীয়বারের মতো লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করতে রস্ক প্রকল্পে দাতা সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ১০ হাজার ৮৫২ কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং সরকারী তহবিল থেকে ৫৮০ কোটি ৮৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। যার বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে দায়িত্ব দেয়া হয়। শুরুতে ১৪৮টি উপজেলায় ‘আনন্দ স্কুলের’ কার্যক্রম থাকলেও এখন তা কমে ১২৫টিতে দাঁড়িয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৪৮ জেলার ১২৫টি উপজেলায় ১১ হাজার ১৬২টি স্কুল স্থাপন করা হয়। এসব স্কুলে মোট প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী পাঠদান করছে। এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অর্থ খরচ করতে না পারায় দাতাগোষ্ঠীর মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। সে কারণে প্রকল্পের সব অর্থ ব্যয় করার জন্য ১১টি সিটি কর্পোরেশনের ৫০ হাজার বস্তির শিশুদের প্রকল্পের আওয়তায় আনার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব শিশুদের প্রকল্পের আওতায় আনা হলেও দেড় বছর পরে তারা কোথায় পড়াশুনা করবে, এ বিষয়ে কারো চিন্তাভাবনা নেই। এছাড়া রস্ক গ্রাজুয়েট অর্থাৎ যারা আনন্দ স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পাস করে মূল ধারার শিক্ষাগ্রহণ করছে না, তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ৩০টি উপজেলার এক হাজার ৫শ শিশুর জন্য ৬ মাসের ৩৬০ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তবে এটি ৬ মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স হলেও তিন মাসেই তা শেষ করা হয়েছে। প্রকল্প সংশোধন করে আরও ৯০টি উপজেলার ২৫ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রকল্পের অর্থ খরচ করার জন্যই এসব উদ্যোগ নেয়া হয় বলে এখন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, চলতি বছরের শুরু থেকে এ প্রকল্পের অভিভাবক ছাড়া চলেছে সকল কার্যক্রম। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে ডেপুটি প্রকল্প পরিচালক মোঃ শাহাদাত হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত পিডি (প্রকল্প পরিচালক) পদে বসানো হয়। দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্কুল না থাকলেও কাগজে-কলমে ভুয়া স্কুল দেখিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী বাবদ বরাদ্দ অর্থ তুলে নেয়ার ঘটনার জন্ম হয়। এ ঘটনা গড়ায় মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পের নিজস্ব চারটি গাড়ির অপব্যবহার, কয়েকজন কর্মকর্তার একই দিনে দুটি জেলায় ভ্রমণ, কর্মশালা, সভা-সমাবেশ না করেও ভুয়া-জাল ভাউচার বানিয়ে অর্থ আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
×