ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় প্রতারণা এখন তুঙ্গে, হুন্ডিতে রেমিটেন্স

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় প্রতারণা এখন তুঙ্গে, হুন্ডিতে রেমিটেন্স

রহিম শেখ ॥ দ্রুততম সময়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা পাঠানোর অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম এখন মোবাইল ব্যাংকিং। কিন্তু এই সেবার মাধ্যমে প্রতারণাও এখন তুঙ্গে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এ সেবার বিরুদ্ধে প্রতিদিনই জমছে অভিযোগের পাহাড়। বিভিন্ন ধরনের অপরাধে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নোবেল লরিয়েটের সঙ্গে ডিনার প্রোগ্রাম, সুলভমূল্যে ফ্ল্যাট-প্লট প্রদান ও জিনের বাদশার কথা বলে অর্থ আদায়, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, মানবপাচার, চুরি, হ্যাকিং, ন্যাশনাল আইডি কার্ড জালিয়াতি, সিএনজি ও অটোরিক্সা ছিনতাই প্রভৃতি। এছাড়া মাদকের টাকা অবৈধভাবে লেনদেন এবং এ সেবার মাধ্যম ব্যবহার করে ‘হুন্ডি’তে দেশে আসছে রেমিটেন্স। এ অভিযোগে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের আট এজেন্টকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। এই চক্রটির অবৈধ হুন্ডি তৎপরতায় রেমিটেন্সের প্রবাহ কমে যাচ্ছে বলে সিআইডি জানিয়েছে। এছাড়া আরও দুজনকে আটক করা হয়েছে মাদকের টাকা অবৈধভাবে লেনদেনের অভিযোগে। জানা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে অর্থ হস্তান্তরই নয়, এ সেবার মাধ্যমে আসছে রেমিটেন্স। দেয়া হচ্ছে বেতন-ভাতা। পরিশোধ হচ্ছে ইউটিলিটি বিল। মূলত ব্যাংকে গিয়ে অর্থ আদান প্রদানের ঝামেলা এড়াতে প্রতিদিনই বাড়ছে বিভিন্ন ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার গ্রাহক। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেশকিছু প্রতারক চক্র। গড়ে উঠছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট চক্র। থামানো যাচ্ছে না গ্রাহক হয়রানি। এক হিসাবে দেখা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকার লেনদেনই বেশি। সাধারণত যারা অল্প আয়ের মানুষ এবং যারা ব্যাংকে গিয়ে এ্যাকাউন্ট খোলার মতো দক্ষ নন, তাদের একটি বড় অংশ এ ব্যাংকিং সেবার দিকে ঝুঁকছেন। এতে একবারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা লেনদেন করা যায়। তবে কেউ চাইলে একাধিক এজেন্ট বা এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আরও অনেক বেশি টাকা লেনদেন করতে পারেন। তবে এই লেনদেনের তেমন কোন তথ্য থাকে না। এজেন্টের মাধ্যমে করলে যার কাছে টাকা পাঠানো হয়, তার মোবাইল নম্বর ছাড়া আর কোন তথ্যই থাকে না। আর সেটার সুযোগ নিয়েই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অবৈধ কাজে টাকা ব্যবহার হচ্ছে। ভুয়া মেসেজের মাধ্যমে এজেন্টরা যেমন টাকা দিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি গ্রাহকের টাকাও তুলে নেয়ার অভিযোগ বাড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে আসা সবচেয়ে বেশি অভিযোগ মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ বিকাশ ও রকেটের বিরুদ্ধে। একাধিক অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের অপরাধে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে, নোবেল লরিয়েটের সঙ্গে ডিনার প্রোগ্রাম, সুলভমূল্যে ফ্ল্যাট-প্লট প্রদান ও জিনের বাদশার কথা বলে অর্থ আদায়, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, মানবপাচার, চুরি, হ্যাকিং, ন্যাশনাল আইডি কার্ড জালিয়াতি, সিএনজি ও অটোরিক্সা ছিনতাই প্রভৃতি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এমনি অভিযোগ করেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, প্রথম বিকাশ কর্তৃপক্ষ পরিচয়ে +১৬২৪৭ নম্বর থেকে ফোন কল। পরে খুদে বার্তা। জানানো হলো, মোবাইলে ক্যাশ ইন করার ক্ষেত্রে কমিশন কাটা হবে বাজার মূল্যের অর্ধেক। পাবেন ভিআইপি গ্রাহকের মর্যাদা। এ ধরনের প্রলোভনের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে দুই দফায় নিজের নম্বরে ২০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করি। পরে দুটি ব্যক্তিগত নম্বরে টাকা পাঠানোর পর জানতে পারি আমি প্রতারণার শিকার। পরে রাজধানীর বাংলামোটরে বিকাশের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে গিয়ে অভিযোগ জানালে বলা হয়, যে নম্বরটি থেকে ফোন বা খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে সেটি তাদের নয়। বিকাশের নিজস্ব নম্বরে (+) শব্দটি নেই। কোন প্রতারক চক্র এটি করেছে। ব্যবসায়ী মোকারম হোসেন শামীম সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করে বলেন, গ্রামীণফোন সিম ০১৭৮০১৫৯৯৭৪ নম্বরের মাধ্যমে বিকাশে নিয়মিত লেনদেন করেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে সিম কার্ডটির রেজিস্ট্রেশন বন্ধ দেখায় এবং পরবর্তী সময়ে তার এ্যাকাউন্ট থেকে ভৌতিকভাবে ২২ হাজার টাকা উধাও হয়ে যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শামীম হারানো টাকা ফিরে পেতে বিকাশ হেড অফিস ও গ্রামীণফোন অফিসে ছুটে যান। কিন্তু এর কোন সুরাহা না পেয়ে দিশেহারা এই গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করেন। আবুল বাশার নামে অন্য এক গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে করা অভিযোগে বলেন, ব্যবসায়িক কাজে বিকাশে ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্ট খুলি। কিন্তু হঠাৎ চালু সিমটি বন্ধ দেখায়। রেজিস্ট্রেশন নষ্ট হয়েছে মনে করে পাশের এসটিপিতে গিয়ে দেখি তার এ্যাকাউন্ট থেকে ১০ হাজার ২০০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আসিফ হোসেন অভিযোগ করেন, গ্রামীণফোন সিম ০১৭০৯৩০৬১৯৫ নম্বর থেকে গত শুক্রবার একটি ফোন আসে। বিকাশ অফিসের কর্মকর্তা পরিচয়ে আমাকে বলা হয়, আপনার হিসাবে ২ হাজার ৪০ টাকা রয়েছে। তবে বর্তমানে এ্যাকাউন্টটি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। সক্রিয় করতে আমাদের নির্দেশনা অনুসরণ করুণ। মুহূর্তেই মোবাইলে থাকা ২ হাজার ৪০ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র। তিনি বলেন, এই প্রতারক চক্রটির সঙ্গে এজেন্টরা জড়িত থাকতে পারে। জানা গেছে, বাংলাদেশে এখন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিলেও এই খাতের বড় অংশের লেনদেন ব্র্যাক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির এক লাখ ৮০ হাজার এজেন্ট রয়েছে। সবগুলো ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট রয়েছে প্রায় ৫ লাখের বেশি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে সারাদেশে ২ হাজার ৮শ’ বিকাশ এজেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। এর মধ্যে ২৫টি এজেন্ট নম্বর থেকে বিপুল পরিমাণ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে জানতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশ থেকে ইলেক্ট্রনিক বার্তায় বাংলাদেশে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রাম, পাবনা কিংবা মাদারিপুরে টাকা পাঠাতে হবে। হুন্ডি দলে কিছু সদস্য দেশে ও দেশের বাইরে অবস্থান করে বাংলাদেশী ওয়েজ আর্নারদের নিকট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ করে তা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় টাকায় স্থানীয়ভাবে পরিশোধ করেছে। এরই জের ধরে অধিকতর তদন্তে নামে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। সংস্থাটি দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করে জানতে পারে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র রেমিটেন্স কমানোর পেছনে কাজ করছে। অবশেষে গত বুধবার রাতে আট এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মান্নান (৩০), পাবনার আমিনপুরের মনোয়ার হোসেন মিন্টু (২৯), একই এলাকার মোজাম্মেল মোল্লা (৩৩), বগুড়ার সঙ্গীত কুমার পাল (৪৫), সাঁথিয়ার জামিনুল হক (৩৮), বেড়ার হোসেন আলী, চট্টগ্রামের লোহাগড়ার দিদারুল হক (৩১) ও ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুরের আবু বকর সিদ্দিক। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা জানান, এই চক্রের যোগসাজশে বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনে প্রবাসীদের টাকা আসছে বাংলাদেশে। সঠিক নিয়মে বিদেশ থেকে টাকা না আসায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রেমিটেন্স থেকে। এই চক্রটির অবৈধ হুন্ডি তৎপরতায় রেমিটেন্সের প্রবাহ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ও দেশের বাইরে অবস্থান করা কিছু হুন্ডিকারী সদস্য এ কাজটি করছে। তারা বিদেশে অবস্থান করা বাংলাদেশীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে তা বৈধ পথে দেশে না পাঠিয়ে ওই সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে থাকা চক্রের মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রায় (টাকা) পরিশোধ করছে। দেশের ভেতরে এই টাকার লেনদেন হচ্ছে বিকাশের মাধ্যমে। তিনি বলেন, শুধু হুন্ডি নয়, ইয়াবা ব্যবসার টাকা অবৈধভাবে লেনদেন করার অভিযোগে বিকাশ এজেন্টসহ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন- মোঃ স্বপন এবং মোঃ সালাউদ্দিন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিকাশের এক কর্মকর্তা জানান, বিকাশ বা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের এ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হলেও, এসব এ্যাকাউন্টে সরাসরি বিদেশ থেকে টাকা আসে না। কারণ বিদেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি থাকলেও বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও সরাসরি বিকাশ থেকে লেনদেনের সুযোগ নেই। বিষয়টিকে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য অনেক দেশে অনেক মানি এক্সচেঞ্জ বা অর্থ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের দোকানে বিকাশ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখে। সেখানে থাকা বাংলাদেশী অভিবাসীরা মনে করে, এটাই বিকাশের শাখা। তাই তারা সেখানে দেশে সহজে টাকা পাঠানোর জন্য যান। সেখানে তারা দেশে থাকা কোন স্বজনের ফোন নম্বর দেন, যে নম্বরে এই টাকা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, এরপর এসব প্রতিষ্ঠান দেশে থাকা তাদের কোন এজেন্টকে ওই নম্বরে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিকাশ করার জন্য বলে দেন। সেই স্বজন হয়ত তখন তার মোবাইলের মাধ্যমেই টাকা পান। কিন্তু এক্ষেত্রে বিকাশ বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নাম ব্যবহার করা হলেও আসলে হুন্ডির মাধ্যমে টাকার লেনদেন হচ্ছে। সিআইডি যে ব্যক্তিদের গ্রেফতার করেছে, তারাও স্বীকার করেছে, প্রবাস থেকে আসা অর্থ তারা এভাবে বিকাশ ব্যবহার করে লেনদেন করেছে।
×