সঞ্জয় রায় চৌধুরী
ছিপখান তিন-দাঁড়, তিনজন মাল্লা, চৌপর দিন-ভোর দ্যায় দূর পাল্লা...। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি ছন্দের জাদুকর খ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত ‘দূরের পাল্লা’ কবিতায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচের চিত্র। বাস্তবে দেখা যায়, নৌকাবাইচে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরা দাঁড় টানেন আর সোল্লাসে মেতে ওঠেন, এ সময় তারা সরবে গেয়ে যান...হেইও, হেইও, হেইও...। তখন আনন্দিত করতালিতে মেতে ওঠেন দর্শকেরা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকাবাইচের প্রচলন সুদীর্ঘকালের। নির্মল বিনোদনের এ মাধ্যমটি এখনও অত্যন্ত জনপ্রিয়। বর্ষা মৌসুমে যখন নদীতে পানি থাকে, তখন নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়। এমনই এক নৌকাবাইচ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার ঝামা গ্রাম দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীতে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা উপলক্ষে এলাকায় বসেছিল বিরাট মেলা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণে এই নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে এলাকার মানুষ মেতে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধনে।
প্রতিবছরের মতো এবারও দুর্গাপূজায় বিজয়া দশমীর পরদিন এই নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়। প্রায় এক শ’ বছর ধরে এই নৌকাবাইচ ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই বাইচকে ঘিরে মানুষের মধ্যে ছিল ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। দুপুর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মধুমতি নদীর দুই পাশ দর্শকরূপী মানুষের আগমনে ভরে ওঠেÑদেখলে মনে হয়, এ যেন এক মহামিলনক্ষেত্র। এদিন প্রায় এক লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। লম্বা বিশাল আকারের নৌকাগুলো বাইচে অংশ নেয়। এক পোশাকে বাইচে অংশ নেয়া যুবকেরা প্রাণপণ জোরে নৌকা চালাতে থাকে। উৎফুল্ল দর্শক করতালি দিয়ে তাদের উৎসাহ দেয়।
বাইচে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার বড়গাঁও গ্রামের নজরুল ইসলামের নৌকা ১ম, মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার পাল্লা গ্রামের আনোয়ার হোসেনের নৌকা ২য় এবং ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা বড়গাঁও গ্রামের মানিক মোল্লার নৌকা ৩য় স্থান অধিকার করে। ৮টি নৌকাবাইচে অংশ নেয়। নৌকাবাইচ উপলক্ষে মাগুরার ঝামা গ্রামে বসেছিল বিরাট গ্রামীণ মেলা। প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গাজুড়ে আয়োজিত এ মেলায় নানা প্রকার মিষ্টি, প্রসাধনী কসমেটিক, চুরি-ফিতা, খেলনা, মাটির সামগ্রী, বাঁশবেতের সামগ্রী, মাছ ও সবজিসহ নানা নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর বিক্রির জন্য উঠেছিল। ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে নেন। মেলায় মাগুরা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। এ উপলক্ষে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজন ভরে গিয়েছিল। প্রতিটি পরিবারের জামাইরা নৌকাবাইচ দেখতে এসেছিলেন নিজ নিজ শ্বশুরবাড়িতে। তাদের এ সময়ে যার যার পরিবারের সাধ্যমতো আপ্যায়ন করা হয়। ফলে প্রতিটি বাড়িতে বিরাজমান ছিল মহামিলনের, উৎসবের আমেজ। সকলের অংশগ্রহণে জাতি-ধর্ম ও দলমত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ নৌকাবাইচ উপলক্ষে মেতে উঠেছিল। সৃষ্টি হয়েছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধনে। নৌকাবাইচ আয়োজক কমিটির সভাপতি আছাদ মোল্লার সভাপতিত্বে প্রতিযোগিতা শেষে প্রধান অতিথি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার এমপি বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন।