ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাদা কিলিং মিশনে অংশ নেয় কিশোর সাফায়েতসহ ৭ জন

কুমিল্লায় একই রাতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল কর্মীকে হত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৯ মে ২০১৭

কুমিল্লায় একই রাতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল কর্মীকে হত্যা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুমিল্লা, ২৮ মে ॥ আধিপত্য বিস্তার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জের ধরে কুমিল্লায় শাহজাদা ইসলাম নামে এক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী খুন হয়েছে। এছাড়া জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে চাচার হাতে জিয়াউর রহমান সানি নামের এক ছাত্রদল কর্মী খুন হয়েছে। শনিবার রাতে নগরীর নজরুল এভিনিউ ও চর্থা তালতলা এলাকায় এ পৃথক খুনের ঘটনা ঘটে। নিহত শাহজাদা ইসলাম নগরীর সুজানগর এলাকার ব্যবসায়ী সহিদ মিয়ার ছেলে ও কুমিল্লা নগরীর পদুয়ার বাজার এলাকার ব্রিটানিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্রদল কর্মী জিয়াউর রহমান সানি নগরীর চর্থা তালতলা এলাকার আনিসুর রহমান জালালের ছেলে। এরমধ্যে ছাত্রলীগকর্মী শাহজাদা কিলিং মিশনে কিশোর সন্ত্রাসী সাফায়েতসহ তার ৭ সহযোগী অংশ নেয় বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে। রবিবার বিকেল পর্যন্ত উভয় খুনের ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শনিবার রাতে কিশোর সন্ত্রাসী সাফায়েত উল্লাহ সৈকতের (১৬) নেতৃত্বে তার ৬/৭ জন সহযোগী ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র শাহজাদাকে (২০) নগরীর নজরুল এভিনিউ এলাকায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ (কুমেক) হাসপাতাল এবং পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত শাহজাদার বন্ধু রুমান জানান, শনিবার বিকেলে শাহজাদা তারই বন্ধুর ছোট ভাই ফুয়াদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে মোটরসাইকেলযোগে দুই বন্ধু নিয়ে নগরীর নজরুল এভিনিউ এলাকায় আড্ডা দিতে আসে। সেখানে আসার পর পরিকল্পিতভাবে সাফায়াতসহ ৬/৭ মিলে শাহজাদাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় রুমানকেও কুপিয়ে জখমের চেষ্টা করলে সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। নিহত শাহজাদা তার ২ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ৩য় ছিল। এদিকে রবিবার ঢামেকে ময়নাতদন্তের পর শাহজাদার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হলে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ এ খুনের নেপথ্যে অনেক তথ্য পেয়েছে। বেড়িয়ে আসছে প্রধান ঘাতক সাফায়াতের অপরাধ জগতের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছাত্রলীগের জুনিয়র গ্রুপে আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব এসব বিষয় খুনের নেপথ্য কারণ হিসেবে নগরজুড়ে বেশ আলোচিত হচ্ছে। এ ঘটনায় পুলিশ ঘাতক সাফায়াতের মা ছাড়াও আরও কয়েকজন বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে ভার্সিটি ছাত্র শাহজাদা কিলিং মিশনে ঘাতক সাফায়েত ও তার আরও ৬/৭ সহযোগী অংশ নিয়েছিল বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে। হত্যাকা-ের পর থেকেই তাদের গ্রেফতারে পুলিশের কয়েকটি টিম মাঠে অভিযান শুরু করেছে। স্থানীয় সিটি কাউন্সিলর সৈয়দ মোঃ সোহেল জানান, এ ঘটনার নেপথ্যে আরও যারা জড়িত রয়েছে, সাফায়েত গ্রেফতার হলেই সব রহস্য বেড়িয়ে আসবে। কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সালাহ উদ্দিন জানান, পূর্ব বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকা-ে জড়িত প্রধান আসামি সাফায়েতসহ অপর ঘাতকদের গ্রেফতারে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। কে এই কিশোর সন্ত্রাসী সাফায়েত কুমিল্লা নগরীর ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র শাহাজাদা ইসলাম খুনের মূলহোতা স্কুলছাত্র সাফায়েত উল্লাহ সৈকত জেলার লাকসাম পৌরসভা এলাকার উত্তর-পশ্চিম গাঁ গ্রামের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আবু মুছা সেলিমের একমাত্র ছেলে। তার মা সাজেদা চৌধুরী কুমিল্লার একটি বেসরকারী হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে সেবিকার চাকরি করে আসছিল। গত ৩ মাস আগে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। সাফায়েত তার মায়ের সঙ্গে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের পেছনের গলিতে ‘দারুল জান্নাহ’ নামক ভবনের নিচতলায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে। সাফায়েত বর্তমানে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড মডেল কলেজের স্কুল শাখার অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের কারণে তাকে গত বছর ইস্পাহানী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। সূত্র জানায়, ইস্পাহানী কলেজে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে সাফায়েত তার এক সহপাঠীকে মারধর করার কারণে নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার রাব্বি-কিবরিয়া গ্রুপের হামলার শিকার হয়েছিল। ওই সময় ওই গ্রুপ তাকে কুমিল্লা টাওয়ারের সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেছিল। এ ঘটনায় তাকে ইস্পাহানী কলেজে থেকে তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। এতে ওই কলেজ থেকে সে ২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি। পরে সে এ তথ্য গোপন করে চলতি বছর লাকসাম আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে সপ্তম শ্রেণী পাস সার্টিফিকেট এনে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড মডেল কলেজে পুনরায় অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। ১৬ বছর বয়সী সাফায়েত ইতোমধ্যে নগরীর নজরুল এভিনিউ ও মডার্ণ স্কুল এলাকা, পূর্ব ঠাকুরপাড়া, শিক্ষাবোর্ড এলাকা, মনোহরপুর, রামঘাট এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ গড়ে তুলেছে। প্রায় দিন বিকেল ও সন্ধ্যায় ওই গ্রুপকে ওইসব এলাকায় মহড়া ও আড্ডা দিতে দেখা যেত। তাদের উৎপাতে স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ সাধারণ লোকজন অতিষ্ঠ ছিল বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। ছাত্রদল কর্মী খুন এদিকে জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে চাচার হাতে জিয়াউর রহমান সানি (২৬) নামের এক ছাত্রদল কর্মী খুন হয়েছে। শনিবার গভীর রাতে নগরীর চর্থা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত সানি চর্থা তালতলা এলাকার আনিসুর রহমান জালালের পুত্র। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শনিবার গভীর রাতে নগরীর চর্থা এলাকায় জিয়াউর রহমান সানিকে (৩৫) তার ২ চাচা ও চাচাত ভাইয়েরা মিলে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এ সময় আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে রাত ২টার দিকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ভর্তি করলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। সানির স্ত্রী ফারহানা হক লিমা অভিযোগ করে বলেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে সানির চাচা মিজানুর রহমান জামাল ও মফিজুর রহমান কামাল এবং তাদের সন্তানরা শনিবার রাতে তার ঘরে প্রবেশ করে পরিকল্পিতভাবে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর ও বুকে-পিঠে রড দিয়ে আঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় সানিকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানে তার মৃত্যু হয়। লিমার অভিযোগ, পারিবারিক সম্পত্তি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে সানির চাচারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মুজিবুর রহমান জানান, সানির বুকে ও পিঠে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি (তদন্ত) সালাউদ্দিন আহাম্মেদ জানান, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে সানিকে হত্যা করা হয়েছে। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুমেক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
×