শাহীন রহমান ॥ আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ, ভোট গণনা ও ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের দিকে নজর দিচ্ছে ইসি। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, এ জন্য অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার বিধানের পাশাপাশি ইভিএমে ভোট গ্রহণ ও গণনা ছাড়াও ডিজিটাল মনিটরের মাধ্যমে ফল প্রকাশের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণে যে কোন অনিয়মের সরাসরি অভিযোগ গ্রহণের জন্য ইসিতে বিশেষ সফ্টওয়ার ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে। এ সফ্টওয়ারের মাধ্যমে যে কেউ যে কোন সময় এসএমএসের মাধ্যমে ইসিতে অভিযোগ করতে পারবেন। কমিশন এসব প্রস্তাবনা অনুমোদন দিলেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার করার চিন্তাভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগেই জানিয়েছেন একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তবে তা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মূলত ভোট গ্রহণ দ্রুত ও সহজ করতেই ইভিএম মেশিনের বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে বলে জানা গেছে। ভোট গ্রহণ ও ভোট গণনার জন্য ইভিএম মেশিনের ব্যবহারের পাশাপাশি নির্বাচনের ফল প্রকাশের জন্য রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে ডিজিটাল মনিটর স্থাপন করারও চিন্তাভাবনা রয়েছে ইসির। যাতে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন ইসির ফলাফল ঘোষণার বিষয়টি সরাসরি দেখতে পারে।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন আগামী নির্বাচনে অন্তত ছয়টি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিধান। প্রার্থীরা সরাসরি রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসে না গিয়েও অনলাইনের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। নির্বাচনে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমাদানে কোন পক্ষ থেকে যাতে কোন ধরনের বাধার সম্মুখীন না হয় বিষয়টি মাথায় রেখেই এ ধরনের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিগত কমিশন স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার বিধান চালু করে। ওই সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ব্যাপকভাবে মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সরকারী দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা বেশি বাধার সম্মুখীন হন। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই কমিশন মনোনয়নপত্র অনলাইনে জমার বিধান চালু করে। এবার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পাশাপাশি আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। জানা গেছে আইন অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ কারণে কোন দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধার অভিযোগ না আসে সে জন্যই জাতীয় নির্বাচনেও এ বিধান রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া জানা গেছে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা দেয়া, নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও ভোট গ্রহণের যে কোন অনিয়মের অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণের জন্য বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এ সফ্টওয়ারের মাধ্যমে যে কেউ, যে কোন অভিযোগ যে কোন স্থান থেকে সরাসরি ইসিতে দাখিল করতে পারবেন। মূলত এই সফ্টওয়ার ব্যবহার করে এসএমএসে অভিযোগ সংগ্রহ করা হবে বলে জানান তারা।
এছাড়া ভোটের ফল প্রকাশের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থা রাখার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। জানা গেছে নির্বাচনে ফল প্রকাশের জন্য রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে ডিজিটাল মনিটরের মধ্যে প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া হবে। রাজধানীর গুলিস্থান, মৌচাক, শাহবাগ, ফার্মগেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ডিজিটাল মনিটরে ফল প্রকাশ করারও সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারের অন্য ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ভোটারদের তথ্য সরবরাহ এবং ব্যয় তদারকির বিষয়গুলো রয়েছে। আগামী ২৩ মে নির্বাচন কমিশনের সভায় এ প্রযুক্তি ব্যবহারের এসব প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। কমিশন অনুমোদন দিলেই আগামী নির্বাচনে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা কমিশনের রয়েছে।
এছাড়াও নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, আগামী নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয় তদারকির জন্যও সুপারিশ করা হয়েছে। এ জন্য আলাদা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। মূলত নির্বাচনেকালে টাকার খেলা বন্ধ করতেই প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন প্রার্থীরা নির্বাচনের পর ব্যয়ের যে হিসাব দাখিল করেন তার যথাযথ নিরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই প্রকৃত ব্যয় পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। কোন প্রার্থীর ব্যয় বেশি হলে তার বিরুদ্ধে তার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে নির্বাচিত হওয়ার পরও তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে ইসি। ইসি সচিব জানিয়েছেন প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মনিটরিং কমিটি গঠনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কমিশনের অনুমোদন পেলে আগামী নির্বাচনেই এটি কার্যকর করা হবে।
দেশে নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে বিগত শামসুল হুদা কমিশনের সময়। সর্বপ্রথম ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। তবে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন যখন এ পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেয়, তখন সন্দেহ থেকে এর বিরোধিতা করেছিল বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল। তবে চট্টগ্রামের সাফল্যের পর নায়ায়ণগঞ্জের কয়েকটি ওয়ার্ডে, নরসিংদী পৌরসভা ও ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের পুরো নির্বাচন ইভিএমে করা হয়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদায়ের আগে সংসদ নির্বাচনের জন্য ইভিএমের প্রস্তুতি রেখে গিয়েছিল শামসুল হুদার কমিশন। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর রাজশাহী ও রংপুরে ছোট পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। বর্তমান কমিশন ক্ষমতায় এসে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আবারও সামন্যে নিয়ে এসেছে। নির্বাচনী রোডম্যাপে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন ইভিএম ব্যবহারের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই কেবল সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জানা গেছে কমিশন অনুমোদন দিলে ইভিএম ব্যবহারসহ আরও ছয়টি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চায় ইসি।