ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তার পানি বণ্টন

মমতার বিকল্প প্রস্তাব আমলেই নিচ্ছে না ঢাকা-দিল্লী

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১১ এপ্রিল ২০১৭

মমতার বিকল্প প্রস্তাব আমলেই নিচ্ছে না ঢাকা-দিল্লী

তৌহিদুর রহমান ॥ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তা চুক্তির বিকল্প প্রস্তাব আমলেই নিচ্ছে না ঢাকা-দিল্লী। বাংলাদেশ ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মনে করে তিস্তা নিয়ে মমতা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা যথার্থ নয়। বিশেষ করে তিস্তায় যে পানি নেই, এটা উভয়পক্ষই মানতে নারাজ। এছাড়া কয়েকটি ছোট ছোট নদীর পানি দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পানি সমস্যা মেটানো কোনভাবেই সম্ভব নয়। নয়াদিল্লীর একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, তিস্তা চুক্তিতে মোদি সরকারের কোন আপত্তি নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তা চুক্তি করতে আগ্রহী। তিনি শুরু থেকেই এটা বলে আসছেন। তিনি মমতাকে পাশে নিয়েই এই চুক্তি করতে চান। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের বিকল্প প্রস্তাবে বিব্রত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। আর কেন্দ্রীয় সরকার মমতার এই প্রস্তাব মানতেও নারাজ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা, তোর্সা, মানসাই, ধানসাই ও ধরলা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে এই চারটি নদীই ছোট ছোট নদী। বিশেষ করে তোর্সা নদীর কথাই আলোচিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তোর্সা নদী তিব্বতের চুম্বি ভ্যালি থেকে উৎপন্ন হয়ে ভুটানের মধ্য দিয়ে ৩২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে নদীটি জলঢাকার সঙ্গে মিশেছে ও যমুনায় মিলিত হয়েছে। এর আরেকটি শাখা রংপুর সীমান্তে দুধকুমার নদীতে পড়েছে। তোর্সা নদীটি তিস্তার কিছুটা উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত। আর মানসাই নদীর উৎপত্তি হয়েছে সিকিমের বিদং হ্রদ থেকে। এই নদী পাটগ্রামে প্রবেশ করেছে। হিমালয় থেকে ধরলা নদী পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রবেশের পর নদীটি পাটগ্রাম থানার কাছে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। আবার ভারত থেকে অকস্মাৎ বাঁক নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধরলা নদী কুড়িগ্রামের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। বাংলাদেশ অংশে ধরলার দৈর্ঘ্য ৭৫ কিলোমিটার। এর গড় গভীরতা ১২ ফুট। তবে এসব নদীর কোনটিই তিস্তার বিকল্প হতে পারে না। কেননা তিস্তা নদী লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই নদীর মধ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশ অংশেই পড়েছে ১১৫ কিলোমিটার। আর তিস্তা থেকে মাসিক গড় পানি অপসারণের পরিমাণ ২৪৩০ কিউসেক। সূত্র জানায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা তোর্সা, মানসাই, ধানসাই, ধরলা নদীর পানি বণ্টনের যে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন, এসব নদীর কোনটিতেই ব্যারাজ নেই। সে কারণে এসব নদীর পানি বাংলাদেশ এমনিতেই পাচ্ছে। তবে তিস্তার ভারত অংশে গজলডোবা বাঁধ থাকায় তিস্তার পানি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুবিধামতো ব্যবহার করছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। তিস্তার ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশি। সে কারণে তিস্তা এসব নদীর কোন বিকল্প হতে পারে না। ১৯৮০’র দশক থেকে দুই দেশ তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গসহ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই ২০১১ সালে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। সে কারণে ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ারও কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা আটকে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় ভারত সরকার এই চুক্তি সইয়ের বিষয়ে আশ্বাস দিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। মমতার বিকল্প প্রস্তাবে সায় নেই বাংলাদেশ সরকারের। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, মমতার বিকল্প প্রস্তাবে সায় দিলে আর কখনই তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে তিস্তা চুক্তির পথ খুলতে পারে। এছাড়া মমতাকে বাদ দিয়েই এই চুক্তি করা সম্ভব কি-না সেটা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেছে ঢাকা-দিল্লী। নয়াদিল্লীর একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, মমতা নিজেই চাইছেন, তাকে বাদ দিয়েই এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই চুক্তি করে ফেলুক। তিস্তা চুক্তিতে মমতার রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও এই আশঙ্কা রয়েছে তার। তোর্সাসহ উত্তরবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে আরও তিনটি নদী প্রবেশ করেছে। এসব নদীর নাম, পানিবণ্টন নিয়ে যৌথ সমীক্ষা করার নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন মমতা। তবে এসব নদীর পানি নিয়ে যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব মানে সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করছেন বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। এছাড়া এসব নদীর পানি নিয়ে সমীক্ষার কিছু নেই। কেননা এসব নদীতে ব্যারাজ না থাকায় বাংলাদেশ এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে পানি পাচ্ছে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লী থেকে ঢাকায় ফিরেছেন। ঢাকায় ফেরার পরে এখন বাংলাদেশ ও ভারত উভয়পক্ষ আবার তিস্তা নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সরকারই তিস্তা সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। সে কারণে মমতার বিকল্প প্রস্তাবে না গিয়ে কিভাবে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সে বিষয়ে উভয়পক্ষ আবারও আলোচনা চালিয়ে যাবে। দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর মমতা বলেছেন, আমি একটি বিকল্প প্রস্তাব ভেবে দেখতে বলেছি সবাইকে। দুই সরকারকে। আমাদের কিছু ছোট ছোট নদী আছে যেগুলো জীবনে কখনও নার্চার হয়নি এবং যেগুলো দিয়ে বাংলাদেশে একটা কানেকশনও আছে। সেখানে যদি আমরা দুটো দেশ স্টাডি করে কোন ভায়াবিলিটি দেখতে পাই, তাহলে কিছুটা আমরা শেয়ার করতে পারি। মমতা বলছেন, বাংলাদেশ পানি পাক, তা তিনিও চান। কিন্তু তিস্তা থেকে দেয়ার উপায় তার নেই। তিনি আরও বলেন, আমি বলেছিলাম যে আমরা যদি একটু ভেবে দেখি, তিস্তায় যখন আমার প্রব্লেম হচ্ছে, আর যেহেতু আমার গজলডোবা ব্যারাজ আছে, আমার জলের প্রব্লেম আছে, ড্রিংকিং ওয়াটার, ফারমার্স, নানান প্রব্লেম আছে। এই হিসেবে আমি তিন-চারটি নদীর নামও বলে গেছি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তোর্সা, মানসাই, ধানসাই ও ধরলার মতো কয়েকটি ছোট নদী আছে যা বাংলাদেশে গিয়ে মিশেছে। যৌথ সমীক্ষা করে যদি সেসব নদী থেকে বাংলাদেশকে পানি দেয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে তিনি তাতে রাজি আছেন।
×