ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ থেকে চলে গেলে কালো তালিকাভুক্ত করে নিজ নিজ দেশে চিঠি পাঠানো হবে

কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার ॥ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:০০, ৫ এপ্রিল ২০১৭

কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার ॥ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে

আজাদ সুলায়মান ॥ কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে চলে গেলেও রেহাই পাবেন না অভিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকরা। তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে নিজ নিজ দেশে চিঠি পাঠানো হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে আবেদন জানানো হবে। সম্প্রতি ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে এ ধরনের অর্ধশতাধিক গাড়ি জব্দের পর প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এরপরই তাদের বিরদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্বান্ত নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান। তিনি জানিয়েছেন, এরই মধ্যে এ ধরনের অপকর্ম করে ঢাকা ত্যাগের পরও তাদের তলব করা হয়। সম্প্রতি ঢাকায় কর্মরত সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহমুদ ইজ্জত মিসর থেকে বাংলাদেশে এসে তার ব্যবহৃত গাড়ি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। তার মতো আরও এক ডজন কূটনীতিক ব্যাখ্যা দিতে ঢাকা আসছেন বলে জানা গেছে। এদের বিরুদ্বে শুল্ক আইন ভঙ্গের সঙ্গে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে। জানা যায়, ঢাকায় কর্মস্থলের সুবাদে কূটনীতিকসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের বিরদ্ধে শুল্ক ও মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরসহ সব ধরনের আইনী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে রাজস্ব বোর্ড থেকে অনুমতি নেয়া হয়েছে। এরপরই তাদের বিরুদ্বে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে সে জন্য রাজস্ব বোর্ড থেকে একটি গাইড লাইনও দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, কাগজে-কলমে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে, যেমন শুল্ক সুবিধার গাড়ি ব্যবহারের পর দেশত্যাগের সময় কমমূল্যে বাংলাদেশের প্রভাবশালী নাগরিকরদের কাছে বিক্রি বা হস্তান্তর অভিযোগই আমলে নেয়া হবে। এ ধরনের অভিযুক্ত কূটনীতিকদের কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হবে। যাতে ভবিষ্যতে কখনও বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেই তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেও অন্য কোন দেশে গিয়েও যেন তারা রেহাই না পান সে জন্য জাতিসংঘের সহায়তা নেয়া হবে। শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান মঙ্গলবার দুপুরে জনকণ্ঠকে জানান, গত দশ মাসে কূটনৈতিক সুবিধায় নিয়ে আসা শুল্কমুক্ত গাড়ির অপব্যবহারের অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার বেশকিছু গাড়ি জব্দ করা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে ঢাকাস্থ বিশ্বব্যাংকে। এ বিষয়টি রাজস্ব বিভাগসহ গণমাধ্যমে ব্যাপক আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড় চলে। এরপর কাগজপত্রসহ ১৬টি গাড়ি শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরে জমা দিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নোটিস পাঠানো হয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফানকে। বিশ্বব্যাংক তিনটি গাড়ি জমা দিলেও বাকিগুলোর বিষয়ে সময় নিয়েছেন তারা। এরই ধারাবাহিকতায় নোটিস পাওয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহমুদ ইজ্জত মিসর থেকে বাংলাদেশে এসে জবাব দিয়ে গেছেন। জানা গেছে, কূটনীতিক বা ডি কারেনট সুবিধায় নিয়ে আসার পর শর্ত ভঙ্গ করে সেটি বিক্রি কিংবা হস্তান্তর অভিযোগে এ পর্যন্ত ৫১টি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। যার মধ্যে কূটনীতিক ও বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার গাড়িও রয়েছে। এসব গাড়ি ওইসব সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা শর্ত ভঙ্গ করে বিক্রি বা হস্তান্তর করে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এদের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মকর্তা জুনিয়র প্রফেশনাল মিজ নিসকে জ্যানসেন, মিসরের বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহমুদ ইজ্জত, ইউএনডিপির সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর মি. স্টিফেন প্রিজনার, সাবেক কর্মকর্তা কিশোর কুমার সিং, বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা শকুন্তলা আকমিমানা, ক্যাথিনোয়েল খো, ভিনয়া সরূপ, ওসমান সেকেল, হোসেন এডগারদো লেডেজক্যামডস, মিরভা টোলিয়া, মি. ডেভিড, গ্রিনা ইগরসিনা, মৃদুলা সিং, তাহসিন সায়িদ খান, মায়ামি ইসোগেইন, তানিয়া মানা, সেরেন ওজের, ফ্যাবিও পিটালুগা, হেলেন জয় ক্রেইগ ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের প্রমিতা দাসগুপ্তও রয়েছেন। তাদের আলাদা আলাদা নোটিস পাঠানোর পর বেশ কজন চিঠির মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন। কয়েকজন সময় নিয়েছেন। ১৪ জন এখনও কোন জবাব বা সাড়া দেননি। এ অবস্থায় এদের বিরুদ্বে কি ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, একেক জনের অপরাধের ধরন একেক রকম। যেমন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অনেক বিদেশী নাগরিক আছেন, যারা দেশে আসার সময় শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি নিয়ে আসেন। যেগুলো আর ফেরত না নিয়ে কিংবা শুল্ক অধিদফতরকে না জানিয়ে বিক্রি করে দেন। আবার বিভিন্ন দাতা সংস্থা, এনজিও কিংবা কূটনৈতিক মিশনে চাকরি করছেন, এমন ব্যক্তিরাও শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যেও অনেকে আইন ভঙ্গ করে শুল্ক না দিয়ে গাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন। যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যিনি শুল্ক আইনসহ বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করছেন, তিনি চলে গেলেও তার প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান আছেন। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সনদের ভিত্তিতেই তাকে কাস্টমস থেকে পাসবুক দেয়া হয়েছে। সে জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরও এখানে দায়দায়িত্ব রয়েছে। যদি কোন কারণে কোথাও কোন গরমিল হয়, শুল্ক ফাঁকি হয়, মিশন প্রধান নিজে দায়িত্ব নিয়ে সেটা আদায়ের ব্যবস্থা করে দেবেন, সেটাই নিয়ম। তাই আমরা শুধু ব্যবহারকারীকে নয়, মিশনের প্রধানকেও এ দায় থেকে রেহাই দেব না। এ বিষয়ে তারা কী দায়িত্ব পালন করছেন, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গাড়ি ছাড়াও সংশিষ্ট ব্যক্তি পাসবুকের বাইরেও বাড়তি কোন সুবিধা নিয়েছেন কি না, তাও তদন্ত করা হচ্ছে। শুল্ক আইন ভঙ্গের সঙ্গে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে সেভাবেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশ ছেড়ে চলে গেলেই তারা রেহাই পেয়ে যাবেন এমনটি ভাবা ঠিক হবে না। যারা দেশে আছেন তাদের বিরুদ্বে যেমন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে, যারা চলে গেছেন তাদের বিরুদ্ধেও নেয়া হবে একই ব্যবস্থা। যদি তারা নাও আসেন, তাদের সদর দফতর তো রয়ে গেছে। এছাড়া প্রত্যেকটি সংস্থারই নিজস্ব নিয়মনীতি ও আইন রয়েছে। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। যদি কেউ তার পূর্ববর্তী কর্মস্থলে অপরাধ করে থাকেন, তা প্রমাণিত হলে বর্তমান কর্মস্থলেও তার বিরদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি তাকে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হবে। সেই বিষয়টি জানিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব বরাবরেও চিঠি পাঠানো হবে। যেন সে অন্য কোন দেশে গিয়েও আর কাজ করতে না পারে। এরই মধ্যে চিঠি প্রস্তুত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত দশ মাসে শুল্ক গোয়েন্দা ঢাকা চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ অন্যান্য এলাকায় অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। এগুলোর বেশিরভাগই ডি কারনেট বা শুল্ক সুবিধায় আনার পর আর আগের অবস্থানে ফিরিয়ে দেয়া হস্তান্তর করা হয়নি। বেশকিছু গাড়ি বিশ্বব্যাংক, উন্নয়ন সংস্থা ও দাতা গোষ্ঠীর কর্মকর্তারা ব্যবহার করলেও দেশ ছাড়ার সময় তা আইন মেনে হস্তান্তর করেননি। এরপর শুল্ক গোয়েন্দা মাঠে নেমে অভিযান শুরু করে এবং অর্ধশত গাড়ি আটক করে। আরও বেশকিছু গাড়ি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে গেছে বলে জানা যায়।
×