ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

বিজিএমইএ ভবন দ্রুত ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৯ নভেম্বর ২০১৬

বিজিএমইএ ভবন দ্রুত ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জলাধার রক্ষা আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় গড়ে ওঠা বিজিএমইএ (পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি) ১৮ তলাবিশিষ্ট অবৈধ ভবন ভেঙ্গে ফেলা সংক্রান্ত সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। রায়ে অবিলম্বে ওই ভবন নিজ খরচায় ভাঙতে বিজিএমইএকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিজিএমইএ এই নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে রায়ের কপি পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজউককে ওই ভবন ভাঙতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে আপীল বিভাগের চার বিচারপতির স্বাক্ষরের পর সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে ৩৫ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে ৯০ দিনের মধ্যে এই ভবন ভাঙতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন শুধু আপীল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। এদিকে ভবন ভাঙার আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করবে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারী ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনটির সহ-সভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির জনকণ্ঠকে এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আপীলের রায় প্রকাশ হয়েছে শুনেছি। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি (সার্টিফাইড) পেলে ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ করতে হয়। বিষয়টি নিয়ে আমাদের আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করব। তারপর আদালত যা বলবেন তাই মেনে নেব। রায়ের অনিুলিপি প্রকাশের পর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জনকণ্ঠকে জানান, রায়ে বলা হয়, ভবন ভাঙার সকল ব্যয়ভার বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হবে। এছাড়া ওই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধের বিষয়টি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটি অবৈধ ভবন, অবৈধভাবেই তৈরি করা হয়েছে। একইসঙ্গে ভবনের জায়গাসহ রাজধানীর কাওরানবাজারের বেগুনবাড়ি-হাতিরঝিল প্রকল্প মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে হবে বলেও রায়ে উল্লেখ করেছে আদালত। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় গড়ে ওঠা বিজিএমইএ (পোশাক প্রস্তুত ও রফতানি কারক সমিতি) ভবন ভাঙার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আদালতে বলেছিলেন, “বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যম-িত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রমিত করবে।” মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১০ সালের ২ অক্টোবর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ বিষয়ে একটি ইংরেজী দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মুনিরউদ্দিন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দেয়। রুলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙ্গার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এ রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এতে স্থগিতাদেশ চেয়ে করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ এপ্রিল চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায়ের ওপর ৬ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেয়। পরে এ সময়সীমা বাড়ানো হয়। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাইকোর্টের দেয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ওই বছর ২১ মে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ সুপ্রীমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপীল করে। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্ট রায়ে বেশ কিছু নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, এ জমির মালিকানা স্বত্ব বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষের নেই, সে কারণে তাদের ঐ জমি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। ভবনটি তৈরি করার কারণে বেগুনবাড়ি খালের পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং হাতির ঝিল প্রকল্পে বিঘœ ঘটাচ্ছে। তাই ভবনটি ভিত থেকে ভেঙে ফেলতে হবে। বেগুন বাড়ি খাল পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে এনে হাতির ঝিল প্রকল্পকে মূল নকশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে বলেছে আদালত। বিজিএমইএ ভবনের কিছু কিছু অংশ ইজারা এবং বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে উল্লেখ করে আদালত বলে, যারা এই ভবনে বিক্রি এবং ইজারার মাধ্যমে দখল পেয়েছেন তাদের বিনিয়োগের অগেই চিন্তা করা উচিত ছিল। তবে তারা চাইলে চুক্তি আইন ও জালিয়াতির অভিযোগে প্রতিকার চাইতে পারেন বলে আদালত জানিয়েছে। এ মামলাটি শুনানির জন্য এলে হাইকোর্ট ১০ আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে নিয়োগ দেন। এরা হলেন- ড. এম এ জহির (বর্তমানে মৃত), সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আকতার ইমাম, এ এফ এম মেজবাহ উদ্দিন, এ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী, এ্যাডভোকেট আনিসুল হক (বর্তমানে আইনমন্ত্রী), ব্যারিস্টার সারা হোসেন, এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ, ইকবাল কবির লিটন (বর্তমানে বিচারপতি) এবং এ্যাডভোকেট সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান। ্১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ী খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে। ওই বছরের ২৮ নবেম্বর ভবনটি তৈরির কাজ শুরু হয়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তারাই মোট ৬ দশমিক ২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে এর নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য বেআইনীভাবে প্রদান করে। অথচ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিল না। ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নকশা অনুযায়ী করা হয়নি বলে রাজউক বলে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনও ভবনটি ভাঙ্গার দাবি জানিয়ে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণী বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে এবং এতে এর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
×