ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে এক টুকরো চীন কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট

নিলু আক্তার

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ১৪ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশে এক টুকরো চীন কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট

চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের নাম আমরা প্রায় সকলেই জানি

চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের নাম আমরা প্রায় সকলেই জানি। তবে তাঁরই নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট সম্পর্কে আমরা কজনই বা জানি। বিশ্ব দরবারে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০০৪ সালে প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট যাত্রা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ থেকে শুরু করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অসংখ্য কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট রয়েছে এবং শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে একটি কনফুসিয়াস ক্লাসরুম রয়েছে। অবাক করার বিষয় হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঁচশোর মতো কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট এবং নয় শতাধিক কনফুসিয়াস ক্লাসরুম চলমান আছে। কেবল আমেরিকাতেই কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি। 
চীন-বাংলাদেশের মধ্যকার ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্য বিনিময় সহায়ক হিসেবে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ-চীন সরকারের যৌথ উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ছয় তলায় এ ইন্সটিটিউটের যাত্রা শুরু। ২০১৬ সালে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিন ফিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চীনের ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সহযোগিতায় পরিচালিত হয়।

বিগত বছরগুলোতে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট। এখানে দেখা মিলবে মনোমুগ্ধকর এক টুকরো চীনের, যেখানে সাড়ি সাড়ি লাল রঙয়ের লণ্ঠন দিয়ে সজ্জিত আছে করিডর। 
এ ইনস্টিটিউট নিয়ে শিক্ষার্থীদেরও কৌতূহলের শেষ নাই। প্রথম দেখায় যে কেউ চমকে উঠে। এত রঙ্গিন, এত চমৎকার ইন্সটিটিউটে কী পড়ানো হয় এখানে? এত বিদেশী মানুষজনই বা আসে কোথা থেকে? তাদের ভাষা তো কিছুই বুঝি না, খালি চেং-চুং বলে। এ ভাষা মানুষ শিখে কী করে? আবার অনেকে প্রশ্ন করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের সঙ্গে এর পার্থক্য কী? মজার বিষয় হলো, কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটের লাল রঙ্গে সজ্জিত করিডরে প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষার্থী আসে। কেউ আসে ভাইভা পরীক্ষা শেষে সুন্দর একটা ছবি তুলতে, আবার কেউ কেউ আসে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে চেং-চুং বলা চীনাদের সঙ্গে কথা বলতে। 
এবার কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক। 
বাংলাদেশে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসারের অন্যতম এক মাধ্যম হিসেবে কাজ করে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট। এখানে দক্ষতার সঙ্গে চীনা ভাষা শেখানো হয়। চীনা ভাষা শেখার ধাপ এইচএসকে (ঐঝক) প্রথম থেকে পঞ্চম পর্যন্ত শেখার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে এ যাবৎ সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী চীনা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছে এবং বর্তমানে ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী এ ভাষা শিখছে।

এখানে শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য অনলাইন এবং অফলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশে তিনটি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট থেকে প্রতি সেমিস্টারে বারো শতাধিক  শিক্ষার্থী চীনা ভাষা শিখে থাকে। এ সংখ্যা থেকে বাংলাদেশে তৃতীয় ভাষা হিসেবে চীনা ভাষার জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও আঁচ করা সম্ভব। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটে একজন চীনা পরিচালক, তেরোজন চীনা শিক্ষক এবং দুজন বাংলাদেশী শিক্ষক কর্মরত আছেন। এ প্রতিষ্ঠানের ভাষা শিক্ষার পরিধি দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ এবং এর বাইরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে চীনা ভাষার কোর্স প্রদান করে থাকে। যার মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, সংগঠন কৌশল এবং নেতৃত্ব বিভাগ, ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড গবেষণা কেন্দ্র এবং উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

এ ইনস্টিটিউটটি দু’দেশের মধ্যকার ভাষা ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধ দৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এখানে শুধু চীনা ভাষাই যে শেখা যায় তা নয়, চীনাদের জন্য রয়েছে বাংলা ভাষা শেখার সুযোগ। বাংলাদেশী শিক্ষক চীনা ভাষা শেখানোর পাশাপাশি পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত চীনা প্রকৌশলীদের বাংলা ভাষা শেখান। এছাড়াও বিভিন্ন চীনা কোম্পানি এবং উদ্যোক্তাদের জন্য রয়েছে বাংলা ভাষা শেখার কোর্স। 
ভাষা শেখার অন্যতম উপলক্ষ হলো সে দেশের সংস্কৃতিকে জানা। ভাষা শেখার মাধ্যমে পরিচয় ঘটে ঐ ভাষার সংস্কৃতির সঙ্গে। কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটে শিক্ষার্থীরা ভাষা শেখার পাশাপাশি সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এখানে মার্শাল আর্ট থেকে শুরু করে ক্যালিগ্রাফি, চা সংস্কৃতি, লিখন পদ্ধতি হানজি, পেপার কাটিং, চিত্রাঙ্কনের কোর্স রয়েছে। যে কোনো শিক্ষার্থী বিনামূল্যে এ কোর্সগুলোয় অংশ নিতে পারে। 
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট প্রতিবছর চীনের বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী উৎসবের আয়োজন করে, যেখানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে উৎসবগুলো উদ্যাপন করেন। প্রতিবছর চীনের বসন্ত উৎসব বা নববর্ষ, লণ্ঠন উৎসব, ড্রাগন নৌকা উৎসব, মধ্য শারদীয় উৎসবের আয়োজন করে। এসব উৎসবে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের নাচ, গান, ঐতিহ্যবাহী নাটক, পাখা নাচ, ড্রাগন নাচ, সিংহ নাচ, খেলাধুলা যেমন থৌ হো, থি চিয়েন জি, মাস্ক অঙ্কনের আয়োজন করে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মজাদার ঐতিহ্যবাহী খাবার বিশেষ করে ড্রাগন নৌকা উৎসবে চুংজি, মধ্য শারদীয় উৎসবে মুন কেক, বসন্ত উৎসবে চিয়াওজি থাকে। এছাড়াও তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হানফু পরার সুযোগ থাকে। 
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট চীনা ভাষা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন ক্যাম্পের আয়োজন করে। চীনা ভাষা প্রতিযোগিতার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো- চীনা ভাষা সেতু, চীনা লাংসং, ক্যালিগ্রাফি, গান, ভিডিও, চিত্রাঙ্কন, রচনা প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এ প্রতিযোগিতায় ভালো ফলকারী শিক্ষার্থীরা চীনে বৃত্তি থেকে শুরু করে গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন ক্যাম্পে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে। গতবছর চীনা ভাষা সেতু প্রতিযোগিতার দুজন বিজয়ী চীন ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে সম্প্রতি চীন থেকে ঘুরে এসেছে। 
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট থেকে চীনা ভাষা শিখে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী চীনে পাড়ি জমায় উচ্চশিক্ষার জন্য। চীনের বিভিন্ন বৃত্তি যেমন : কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট চীনা ভাষা শিক্ষক বৃত্তি, চীন সরকারের বৃত্তি, প্রাদেশিক বৃত্তি, বিশ্ববিদ্যালয় বৃত্তিতে আবেদন করার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট সরাসরি সুপারিশের পাশাপাশি বিভিন্ন বৃত্তিতে আবেদনের ক্ষেত্রে সুপারিশ পত্র দিয়ে থাকে। 
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশী চীনা শিক্ষকদের চীনা ভাষাজ্ঞান ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধি করার লক্ষ্যে চীনা ভাষার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। এ বছরের জুন মাসে বাংলাদেশের পনেরো জন শিক্ষক বেজিংয়ে চীনা ভাষার প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করবে। এছাড়া ভাষা শিক্ষা উপকরণ, গবেষণার দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি। 
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট চীনা ভাষা শেখানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের চীনা ভাষার দক্ষতা যাচাই পরীক্ষার আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড চাইনিজ সেন্টার চীনা ভাষায় দক্ষতা পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। চীনে উচ্চশিক্ষা কিংবা বৃত্তির আবেদনের ক্ষেত্রে এ সকল পরীক্ষার সনদপত্র থাকলে অনেক সহজে বৃত্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটে চীনা ভাষায় দক্ষতা পরীক্ষা এক থেকে ছয় পর্যন্ত দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি দুই মাস পরপর এ পরীক্ষা নিয়ে থাকে। 
এ ইনস্টিটিউট চীনা ভাষা শিক্ষাদান, দু’দেশের সংস্কৃতি বিনিময় সম্পর্কিত অসংখ্য সেমিনারের আয়োজন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিবছর নভেম্বরে বাংলাদেশে চীনা ভাষা শিক্ষা বিষয়ক সেমিনার, চীনের সাংস্কৃতিক বিষয়ক ফোরাম, চীনে দারিদ্র্য বিমোচনের অভিজ্ঞতা বিষয়ক সেমিনার, চীন-বাংলাদেশ লোকসংগীত বিনিময় সভা, বেল্ট অ্যান্ড রোড সেমিনার ইত্যাদি বিষয়ক ফোরামের আয়োজন করে।

এসব ফোরাম এবং সেমিনার দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বিনিময় মাধ্যমকে আরো প্রসারিত করে তুলে। এছাড়াও চীন-বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, শিক্ষকের জন্য দু’দেশে গবেষণা ও ফোরামে অংশগ্রহণের আয়োজন করে। অদূর ভবিষ্যতে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরো বেশি ত্বরান্বিত হবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।

×